ভারতীয় সেনা বাহিনীর নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল যে উত্তরপূর্বে “সব চাঙ্গা সি” নয়

রাজনীতি

শনিবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২১ এ নাগাল্যাণ্ডে ছয়জন কয়লা খনি শ্রমিক সহ ১৪ জন গ্রামবাসীকে ভারতীয় সেনার গুলি করে মারার ঘটনা প্রমাণ করলো যে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ ও অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বে উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার যে দাবি করা হচ্ছে, তা ডাহা মিথ্যা এবং এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। ভারতীয় সেনা বাহিনীর নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড বিতর্কিত সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ১৯৫৮ (এএফএসপিএ), নিয়ে উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর জনগণের বিরোধিতা কে আরও একবার প্রকট করলো। 

সংবাদে প্রকাশ হয়েছে যে সেই শনিবার বিকেলে টিরু অঞ্চলের কয়লাখনির থেকে রবিবারের ছুটি কাটাতে একটি পিক আপ ট্রাকে চেপে মোন জেলার ওটিং গ্রামে তাঁদের বাড়ি ফিরছিলেন আটজন শ্রমিক। সেই দিনই ওটিং গ্রামের বাইরে সেনা বাহিনীর আসাম রাইফেলসের ২০ প্যারা কর্পস এর সৈনিকেরা একটি ঘেরাটোপ বানিয়ে জঙ্গী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত নাগালিমের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পরিষদ (খাপলাং-ইউং আউং) [এনএসসিএন (খা-ইউ)]এর জঙ্গীদের মারার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ট্রাকটি সেই ঘেরাটোপে প্রবেশ করা মাত্রই সেনাবাহিনী গুলি চালায় ও ঘটনাস্থলে ছয় জন শ্রমিক প্রাণ হারান। দুই জন গুরুতর আহত হন ও তাঁদের ডিব্রুগড়ের আসাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে (এএমসিএইচ) ভর্তি করা হয়।  

এই গুলি চলার আওয়াজ শুনে গ্রামবাসীরা ঘটনাস্থলে যান ও অভিযোগ যে তাঁরা দেখেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা মৃতদের শরীরে খাকি পোষাক পরিয়ে তাঁদের কে জঙ্গী সাজাবার চেষ্টা করছিল এবং মৃতদেহগুলো কে অসম্মানজনক ভাবে রেখেছিল। গ্রামবাসীরা এই ঘটনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন ও দেহগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন। কিন্তু সেই দাবিতে ভ্রুক্ষেপ না করে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা তাঁদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করে। ফলে সাত জন গ্রামবাসী সেখানে নিহত হন ও একজন পরে হাসপাতালে মারা যান।  

এই ঘটনায় মোট ১১ জন গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন ও একজন জওয়ানও জনতার পাল্টা আঘাতে প্রাণ হারান। এই সময়ে সেনাবাহিনীর গুলির থেকে বিজেপির নেতারাও ছাড় পাননি। মোন জেলার বিজেপি সভাপতি নিয়াওয়াং কোন্যাক স্ক্রল ওয়েবসাইট কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে তিনি, তাঁর ভাইপো, তাঁর প্রতিবেশী ও ড্রাইভার গুলি চলার কথা জানতে পেরে ওটিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হন। নিয়াওয়াং আদতে ওটিং গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি জানান যে সেনাবাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল আর যাকে পাচ্ছিল তাঁকেই মারছিল। 

নিয়াওয়াং জানান তাঁর গাড়ির বনেটে বিজেপির পতাকা থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী সেই গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায় এবং তিনি বেঁচে গেলেও তাঁর সাথে তিনজন গুরুতর ভাবে আহত হন ও পরে তাঁর প্রতিবেশীর মৃত্যু হয়। নিয়াওয়াং অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনী “খুশি খুশি গুলি চালাচ্ছিল”। 

সেনাবাহিনীর ৩ নং কোর নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে জানায় ভুল তথ্যের কারণে শনিবার সেনাবাহিনী কে ওটিং গ্রামে গুলি চালাতে হয়। ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে সোমবার, ৬ই ডিসেম্বর, সংসদে গৃহমন্ত্রী শাহ বলেন যে সেনাবাহিনী থামতে বললেও শ্রমিকদের ট্রাকটি না থেমে পালিয়ে যেতে চাইলে বাধ্য হয়ে সেনা গুলি চালায়। কিন্তু সেনাবাহিনী বা শাহ কিন্তু পরবর্তী কালে প্রতিবাদরত গ্রামবাসীদের উপর কেন জওয়ানরা গুলি চালালো সেই সম্পর্কে টু শব্দটিও খরচ করলেন না। 

নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে শাহের দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা নীতি নিয়ে শুধু যে নাগা বিদ্রোহী ও গণ সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ হয়েছে তাই নয়, বিজেপি-নেতৃত্বাধীন উত্তর পূর্ব গণতান্ত্রিক জোট (নেডা) শরিকেরা, বিশেষ করে নাগাল্যাণ্ডের শাসক দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল পার্টি (এনডিপিপি), মেঘালয়ের জাতীয়তাবাদী জনতা পার্টি (এনপিপি), প্রভৃতিও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল যে নাগাল্যাণ্ডের বিজেপি নেতৃত্ব এই হত্যাকাণ্ড কে বিজেপির জাতীয় নেতৃত্বের বিপরীতে গিয়ে “শান্তির সময়ে ঘটিত যুদ্ধাপরাধ” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। 

আর এই পরিস্থিতিতে নাগাল্যাণ্ড সহ গোটা উত্তর পূর্ব ভারতে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ১৯৫৮ (এএফএসপিএ), প্রত্যাহারের দাবি জোরালো ভাবে উঠেছে। এএফএসপিএ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলো কে মানবধিকার লঙ্ঘন করার অনুমতি দেয় “উপদ্রুত” হিসাবে চিহ্নিত অঞ্চলগুলোতে। এই আইনের অধীনে যে অঞ্চলগুলো পড়ে, সেখানে সৈন্য বাহিনী শান্তি রক্ষার নামে যাকে তাকে গুলি করে মারতে পারে, মানুষ কে বন্দী করতে পারে, তাঁদের বাড়ি যখন তখন বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি করতে পারে, তাঁদের ধরে অত্যাচার করতে পারে। 

দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইন হিসাবে চিহ্নিত হওয়া এএফএসপিএ প্রত্যাহারের দাবিতে মনিপুর, নাগাল্যাণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ আন্দোলন করলেও, একের পর এক দলের নির্বাচিত সরকার সেই দাবি নস্যাৎ করেছে। ২০০৪ সালে মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল শহরে মনোরমা দেবীর সামরিক বাহিনীর দ্বারা গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে গোটা মনিপুর উত্তাল হয়ে উঠলেও, তৎকালীন কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) সরকার সেই দাবিতে কর্ণপাত করেনি।  

আজ যদিও কংগ্রেস পার্টি ভারতীয় সেনা বাহিনীর নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে উদারনৈতিক গণতন্ত্রীদের আদর্শ জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারই ১৯৫৮ সালে এই দানবীয় আইন আনে ও নাগা, মিজো, মণিপুরী, ও পরবর্তী কালে কাশ্মীরে, এই আইনের প্রয়োগ করে মানবাধিকার হরণ করে সাধারণ মানুষের। 

 বিজেপি এই এএফএসপিএ-র সবচেয়ে বড় সমর্থক যেমন তেমনি সামরিক বাহিনীর সমস্ত মানবাধিকার বিরোধী অন্যায়কেও খোলাখুলি সমর্থন করেছে ও সেনার বিরুদ্ধে যাঁরাই অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের কে “দেশদ্রোহী” বলে চিহ্নিত করেছে। 

নাগাল্যাণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিয়ু রিও গণহত্যার শিকার হওয়া গ্রামবাসীদের শেষকৃত্যে যোগ দিতে গিয়ে জানান যে এএফএসপিএ একটি মানবতা বিরোধী আইন আর তিনি এর প্রত্যাহার চান। রিও বলেন রাজ্যে যখন বেশির ভাগ বিদ্রোহী সংগঠনের সাথেই কেন্দ্রীয় সরকারের যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হয়েছে, তখন এই আইন কেন নাগাল্যাণ্ডে বলবৎ আছে? তিনি জানান যে এই আইন আন্তর্জাতিক ভাবে নিন্দিত এবং এর প্রত্যাহার করা আবশ্যিক।  

এএফএসপিএ নিয়ে রিও-র পক্ষ নেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। ইন্ডিয়া টুডে কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সাংমা বলেন যে তিনি এএফএসপিএ প্রত্যাহার করা নিয়ে শাহের সাথে কথা বলবেন। মেঘালয়ের থেকে এএফএসপিএ ২০১৮ সালে প্রত্যাহার হয়। 

মোদী সরকারের গোদের উপর বিষফোঁড়া হয় যখন মণিপুরের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ নিজের রাজ্য থেকেও এই এএফএসপিএ প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। গোটা মণিপুরের মানুষই এই আইনের তীব্র বিরোধী। আর তাই সেখানে রাজনৈতিক ভাবে নিজের প্রতিপত্তি বাঁচাতে ও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আজ সেখানকার বিজেপি সরকার কেও সেই আইনের বিরোধিতা করতে হচ্ছে যা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন মোদী সরকার বাঁচিয়ে রাখতে চায়। 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর নাগাল্যান্ড হত্যাকাণ্ড দেখে বোঝা গেল যে এনএসসিএন (আইজ্যাক-মুইভা) এর সাথে মোদী সরকারের যে শান্তি চুক্তি ২০১৫ সালে সই হয়েছিল, তার ফলে নাগাল্যান্ডের অন্যান্য বিদ্রোহী জঙ্গী সংগঠন গুলোর কাজকর্মে কোনো প্রভাব পড়েনি, বরং সামরিক সংঘাত বজায় রয়েছে। যে ভাবে আসাম রাইফেলস এর সেনারা এনএসসিএন (খা-ইউ) জঙ্গীদের মারার জন্যে ওত পেতে বসে ছিল, তাতেই বোঝা যাচ্ছে যে নাগা  বিদ্রোহ কোনো ভাবেই শেষ হয়নি। সশস্ত্র বিদ্রোহ আজও নাগাল্যান্ডে চলমান। 

এর আগে ২০১৮ সালে এনএসসিএন (খাপলাং) গোষ্ঠীর গেরিলা আক্রমণে মণিপুরে প্রাণ যায় ১৮ জন সেনার। তারপরে যদিও ভারত সরকার দাবি করেছিল যে মায়ানমারে ঢুকে জঙ্গীদের “সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে” হত্যা করে সেই বদলা নেওয়া হয়েছে, এনএসসিএন (খাপলাং) গোষ্ঠী তা অস্বীকার করেছিল। এনএসসিএন (খাপলাং) ভারত সরকার কে নিহত জঙ্গীদের শব দেহ দেখাতে। সরকার তার কোনো জবাব দেয়নি। 

কিছুদিন আগেই, নভেম্বর মাসে মোন জেলায় এক এনএসসিএন (খা-ইউ) বিদ্রোহী কে হত্যা করে সেনাবাহিনী। এই ঘটনার পিছনে অক্টোবর মাসেই মোন জেলায় আত্মসমর্পণ করা কিছু এনএসসিএন (খা-ইউ) জঙ্গীর মদদ আছে বলে সাধারণ মানুষ সন্দেহ করেন। এর আগেও, জুলাই মাসেও এনএসসিএন (খা-ইউ) জঙ্গীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় সেনাবাহিনী। 

যে ভাবে গোটা উত্তর পূর্ব জুড়ে আজ ভারতীয় সেনা বাহিনীর নাগাল্যাণ্ড হত্যাকাণ্ড কে কেন্দ্র করে এএফএসপি প্রত্যাহারের দাবি উঠছে, যে ভাবে এনএসসিএন (আই-এম) খোলাখুলি জানিয়েছে যে তাঁরা এএফএসপিএ-র ছত্রছায়ায় কোনো রকম আলোচনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক নন, যে ভাবে নাগাল্যাণ্ডে গণ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তাতে মোদী সরকার যে চরম চাপে পড়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই এখন কত দিন মোদী সরকার আর বিজেপি নিজেদের দম্ভ বজায় রেখে সামরিক শাসন চালিয়ে জনতার গণতান্ত্রিক আশা ও আকাঙ্ক্ষা কে দমন করে পারে, সেটাই দেখার। 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


আপনার মতামত জানান