অতঃপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো খুললো ছাত্রদের জন্য। কি ভাবছেন তো এটি একটি অসম্পূর্ণ বাক্য, ভাবছেন তো আমি লিখতে ভুলে গিয়েছি যে স্কুল ছাত্র ও শিক্ষিকা এবং শিক্ষকদের জন্য খুললো। না আমি ভুল লিখিনি। খুব সচেতনভাবে লিখেছি। স্কুল কোনোদিন শিক্ষিকা – শিক্ষকদের জন্য বন্ধ ছিলই না, তো খোলার প্রশ্ন তো আসেই না। তাই না?
বিগত দু বছরে পেশাগতভাবে যদি কোন পেশাকে সবথেকে বেশি কলঙ্কিত করা হয়ে থাকে সেটি শিক্ষকতা পেশা। বাজারে, মলে, ই – রিক্সায় ধেয়ে আসে একটাই প্রশ্ন, কী দিদিমণি খুব তো বসে বসে মাইনে নিয়ে মোটা হয়ে গেলেন! না, এঁদের দোষ নেই। এই খামচা খামচির যুগে, প্রতি মুহূর্তে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রেণীর সবথেকে কাছের সফ্ট টার্গেট হলো শিক্ষিকা -শিক্ষকরা। শিক্ষিকা – শিক্ষকদের রাস্তা, ঘাটে, চলতে ফিরতে দেখা পাওয়া যায়। ক্ষোভ উগরে দেওয়া সহজ। রাষ্ট্র আর তার অঙ্গুলিহেলনে চলা কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম তাদের ন্যারেটিভ চালিয়ে ধীরে ধীরে গেঁথে দিয়েছে আপামর সাধারণ জনগণের মস্তিষ্কে যে শিক্ষকরা চোর, এঁরা বসে বসে মাইনে নেন। প্রশ্ন উঠতে পারে এতে রাষ্ট্রের সুবিধে কোথায়?
সুবিধে অনেক। সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষিকা – শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে যেকোনও বিপ্লবে বা আন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এমনকি বর্তমানেও শাসকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, নিজেদের চাকরির তোয়াক্কা না করে গর্জে উঠেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিক – শিক্ষিকারা।
শিক্ষকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দিলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে সুবিধা হয় যে শিক্ষক শ্রেণী ধান্দাবাজ , অতএব এঁদের কথা কেউ শুনবেন না। গ্রামের এক ছেলে যাকে কোন শিক্ষক সাম্যবাদের শিক্ষা দিচ্ছেন, ধর্ম নিরপেক্ষতার শিক্ষা দিচ্ছেন, তখন ছাত্রের মনের মধ্যে ঘুরছে আগের দিনের ডাইনিং টেবিলে বাবা আর মা এর কথোপকথন। যেখানে বাবা মা আলোচনা করেছেন যে মাস্টাররা পড়ায় না এখন, টিফিনের পর স্কুল ছুটি হয়, মাস্টাররা ফাঁকিবাজ। স্যার যেটা পড়াচ্ছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় ছাত্রর মনে।
বাবা মায়ের অজান্তে থেকে যায় মাস্টার মশায়রা দু হাজার ছাত্রী ছাত্রের স্কুলে মাত্র দশ জন। আটশো-র বেশি ছাত্র ছাত্রীদের খাওয়াতে টিফিনের পর আরও দুটো পিরিয়ড চলে যায়। তার উপর নানা সরকারি পরিকল্পনার নোডাল অফিসার হয়ে তার ফর্ম পূরণের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয়। রোজকার যাঁতাকলে পিষে যাওয়া ন্যুব্জ কাঁধের বাবা-মায়েদের মনে রাষ্ট্র গেঁথে দিতে সক্ষম যে মাস্টারদের কাজ নানারকমের শ্রী দেওয়া। শিক্ষা দ্বিতীয় স্থানে বা তৃতীয়, চতুর্থ বা কোন স্থানেই নেই।
গত দুবছরে নানা সময়ের শিরোনাম , “দু বছর বন্ধ থাকার পর খুলছে স্কুল” বা “দু বছর থেকে বন্ধ স্কুল!” আর তাই দেখে চাকরি হারানো যুবকের প্রশ্ন, কমিযে দেওয়া হোক মাইনে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের। স্কুল যদি শিক্ষিকা – শিক্ষকদের জন্য বন্ধই থাকতো তবে প্রতি মাসের মিডডে মিল বিতরণ, কন্যাশ্রী, ঐক্যশ্রী, আধার কার্ড সংক্রান্ত কাজ, জুতো বিতরণ, ড্রেস বিতরণ, BLO, স্কুল চলো অভিযান, সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেল বিতরণ, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংকের খাতা খোলা, স্কুল সার্টিফিকেট, স্কলারশিপের ফর্ম পূরণ ও ডাউনলোড, মূল্যায়ন এর প্রশ্ন বিতরণ, সেমিনার, খাতা দেখা-এর মত নানাবিধ কাজগুলো সম্পূর্ণ হলো কী ভাবে?
আরও একটা অভিযোগ শিক্ষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যে তারা এখন সবাই শহরমুখী। গ্রামের কথা আর ভাবেন না। কিন্তু প্রশ্ন এটাও কেন আজও শহরকে গ্রামে নিয়ে আসা গেল না। উন্নয়নের নিরিখে কেন গ্রাম ও শহরের আজও বিশাল বড় পার্থক্য?
প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই, প্রশ্নের থেকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র তার পপুলিস্ট এজেন্ডা পরিপূর্ণ করতে চূড়ান্ত ভাবে সফল। তাই আজ মাস্টারদের আর প্রশ্ন শুনতে হয়না যে আমার ছেলে বা মেয়ে কেমন পড়ছে। শুনতে হয়, “মাস্টার মেয়েটার বিয়ার আগত কন্যাশ্রীর টাকা পাম তো?” ( মাস্টার বিয়ের আগে কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়া যাবে তো?)
শিক্ষালাভের ফল সাথে সাথে পাওয়া যায় না, কিন্তু মাসের পাঁচশত টাকা দেখা যায় চোখে, সাথে সাথে। রাষ্ট্র, সরকার সেটা ভালোই বোঝে।
তাই মাস্টাররা ফাঁকিবাজ এই ন্যারেটিভ চালিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা পুঁজির হাতে তুলে দিলে ওয়েলফেয়ার স্টেটের জায়গা থেকে আলোকবর্ষ দূরে থাকা রাষ্টের মোক্ষ লাভের পথ সরল হয়ে যায়।
শিক্ষিত হয়ে কী হবে সাক্ষর হোক! তাতে লাঠিয়াল বাহিনীর অভাব হবে না। লক্ষ্য তো ক্ষমতা। শিক্ষা বড় কাঁটা সে পথের।