কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীথারামনের দ্বারা উপস্থাপিত কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট-বান্ধব অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলি প্রদর্শন করে। এই বাজেটে ভারতের কৃষক ও শ্রমিকদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কে রাষ্ট্র কল্যাণের পরিধি থেকে বাদ দিয়েছে আর ধনীদের ট্যাক্সের সুবিধা ব্যবহার করে আরও বেশি সম্পদ বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩-এর মূল ঘোষণাগুলি কী কী?

কেন কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ মূলত জনবিরোধী?

যদিও মোদী কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩-এর জন্যে সীথারামনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন যে “এই বাজেটটি আরও বৃদ্ধি, আরও লগ্নি, আরও পরিকাঠামো এবং আরও কাজের সুযোগের সম্ভাবনার সাথে পরিপূর্ণ”, তথ্যগুলি তাঁর দাবিগুলো কে খণ্ডন করে।

বেকারত্ব এখনও বাজেট থেকে অনুপস্থিত

যদিও মোদী শাসন ২০১৯ সাল থেকে বেকারত্বের তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে, তবে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE) এর নিজস্ব সমীক্ষার তথ্য দেখাচ্ছে যে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত দেশে গড় বেকারত্বের হার ছিল ৭.৯৫%। 

তাঁর আগের দুইটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট বক্তৃতার মতন, কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ বক্তৃতায় সীথারামন বেকারত্ব শব্দটি বাদ দিয়েছেন। যদিও তিনি পিএম গতিশক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন, তবে তিনি এই প্রকল্পের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা সম্পর্কে কোনও রূপরেখা প্রকাশ করেননি। 

সীথারামন সংসদে জানিয়েছেন যে পিএম গতিশক্তি প্রকল্পকে ‘উদ্ভাবনী’ তহবিল দ্বারা চালিত করা হবে। এই ঘোষণার থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে একটি পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল হিসাবেই পিএম গতিশক্তি প্রকল্প গড়ে উঠবে, যার মানে বড় পুঁজিপতিদের জন্যে সম্পদ তৈরি করতে জনসাধারণের অর্থ ব্যয় করবে সরকার। সীথারামনের ঘোষণা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে পিপিপি মডেল যুবকদের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীল কর্মসংস্থান প্রদান করবে না।

ধনীদের জন্য কর ছাড় এবং মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের জন্য কোনো ছাড় নেই

তাঁর বাজেটে সীথারামন ঘোষণা করেছেন যে কর্পোরেটদের প্রদত্ত ট্যাক্স সুবিধাগুলি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে। সীথারামন তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন: “৩১.০৩.২০২২-এর আগে প্রতিষ্ঠিত যোগ্য স্টার্ট-আপগুলিকে নিগমকরণের দশ বছরের মধ্যে পরপর তিন বছরের জন্য কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কোভিড মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে, আমি এই ধরনের ট্যাক্স ইনসেন্টিভ প্রদানের জন্য যোগ্য স্টার্ট-আপের অন্তর্ভুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করছি, অর্থাৎ ৩১.০৩.২০২৩ পর্যন্ত।” 

তিনি সংসদকে আরও জানান যে কর্পোরেটরা তাদের ট্যাক্স সুবিধা উপভোগ করতে থাকবে: 

“কিছু দেশীয় কোম্পানির জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে, আমাদের সরকার নতুন অন্তর্ভূক্ত দেশীয় উৎপাদন কোম্পানিগুলির জন্য ১৫% করের একটি রেয়াতযোগ্য ব্যবস্থা চালু করেছে। আমি ধারা 115BAB-এর অধীনে উৎপাদন বা উৎপাদন শুরু করার শেষ তারিখ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করছি, অর্থাৎ ৩১শে মার্চ, ২০২৩ থেকে ৩১শে মার্চ, ২০২৪ পর্যন্ত।” 

মোদী এবং বিজেপির দ্বারা খারিজ করে দেওয়া নানা ধরনের সমীক্ষা রিপোর্টগুলো, যেমন পিউ রিসার্চের সমীক্ষা, দেখিয়েছে যে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ২০২০ সালে মোট সংখ্যা ৩.২০ কোটি সঙ্কুচিত হয়েছে, যা মধ্যম আয়ের মানুষের——অর্থাৎ যারা প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে আয় করে—— সংখ্যায় বিশ্বব্যাপী পশ্চাদপসরণের ৬০%। একই সময়ে, প্রতিবেদনটি দেখায় যে কীভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা, অর্থাৎ, যারা দৈনিক মাত্র ২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত আয় করেন, একই সময়ে ৭.৫০ কোটি বেড়েছে। 

ভারতে অক্সফামের অসমতার প্রতিবেদনে বিস্ময়কর সম্পদের ব্যবধান দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে কীভাবে ধনীরা তাদের সম্পদকে আরও কেন্দ্রীভূত করছে এবং বছরের পর বছর বৃদ্ধি করছে, যখন লক্ষ লক্ষ ভারতীয় তাদের অতিসামান্য সঞ্চয়ও হারাচ্ছে। 

যাই হোক, বড় পুঁজিপতিদের দ্বারা প্রদত্ত তহবিলের উপর বিজেপির নির্ভরতার কারণে, কর্পোরেটপন্থী মোদী সরকার কখনোই ভারতের অতি ধনী পরিবারগুলির উপর একটি বাস্তবসম্মত সম্পদ করের দায় চাপিয়ে দেবে না রাজস্ব ঘাটতি সংকুচিত করতে।

কৃষিকে উপেক্ষা

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ এ কৃষকদের জন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সীথারামন বাজেট বক্তৃতায় কৃষি সংক্রান্ত আটটি ঘোষণা করেছেন:

প্রথম পয়েন্টটি প্রমাণ করছে যে মোদী সরকার এখনও এমএসপিতে সমস্ত ফসল সংগ্রহের নিশ্চয়তা দিয়ে একটি আইন প্রণয়নের জন্য কৃষকদের দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এর মানে হল, এই প্রকল্প থেকে গোটা দেশের মাত্র ১.৬৩ কোটি কৃষক উপকৃত হবেন। বলাইবাহুল্য যে তাঁরা সবাই ধনী কৃষক বা সামন্তপ্রভু শ্রেণীর মানুষ। দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্যে এই পরিকল্পনায় কোনো স্থান নেই।  

কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ২০২২-এ রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন যে চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে, কৃষকদের দাবি অনুযায়ী সরকার এমএসপি কমিটি গঠন করবে। এটি মোদী সরকারের একটি কৌশল, যা কৃষকদের দাবি কে নস্যাৎ করে, তাঁদের বোকা বানিয়ে এমএসপি নিয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। যেমন তোমর আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন, যা কৃষকদের এক বছরব্যাপী প্রতিবাদের পরে ২০২১ সালের নভেম্বরে বাতিল করা হয়েছিল, মোদী সরকার পুনরায় চালু করতে পারে, তাই, চার রাজ্যের নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে এমএসপি কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত সন্দেহজনক। 

যদিও ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষকদের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি, তবে অনুমান করা  হয় যে কৃষকদের সংখ্যা দশ থেকে ১৫ কোটির মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি (পিএম-কিষাণ) প্রকল্প, যার অধীনে কৃষকদের অ্যাকাউন্টে প্রতি বছর ৬,০০০ টাকা সরাসরি নগদ স্থানান্তর করা হয়, ১৪.৫ কোটি কৃষক পরিবারকে লক্ষ্য করেছে। এই পরিস্থিতিতে, শুধুমাত্র গম এবং ধানের উপর এমএসপি প্রদান করা, এবং তাও ১৫ কোটির মধ্যে মাত্র ১.৬৩ কোটি কৃষককে, কৃষকদের আর্থিক দুর্দশাকে উপহাস করার সমান। 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) দ্বারা নির্ধারিত মোদী সরকারের কর্পোরেট সেবার স্বার্থবহনকারী ও আর্থিক উদারীকরণের পক্ষে থাকা কৃষি নীতিগুলির ফলে আজ সারের দাম আকাশছোঁয়া। ডিজেলের উচ্চ মূল্য কৃষকদেরকেও প্রভাবিত করেছে কারণ তাঁদের বিক্রয় মূল্যের তুলনায় উৎপাদন খরচ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। 

২০২১-২২ অর্থবছরে সার ভর্তুকির সংশোধিত প্রাক্কলন (আরই) ১.৪০ লক্ষ কোটি টাকা হলেও, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অনুমান (বিই) ১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৩৪,৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি সারের উপর থেকে কমানো হয়েছে। বর্তমানেই অসাধু পুঁজিপতি ও সুদখোরদের কালোবাজারিরকারণে কৃষকরা সারের তীব্র সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে ভর্তুকি ছাঁটাই মানে হল মরার উপর খাঁড়ার ঘা মারা। 

শিল্প পণ্যের গ্রামীণ চাহিদা বাড়ানোর জন্য ইনপুট উপাদানগুলিতে ভর্তুকি এবং আর্থিক উদ্দীপনার মাধ্যমে ভারতের খাদ্য সরবরাহ সুরক্ষিত করতে কৃষকদের আর্থিক ত্রাণ দেওয়ার জন্য কোনও নীতি ঘোষণা করা হয়নি। সরকারের কাছ থেকে এই ধরনের সহায়তা ছাড়া, কৃষকরা ঋণ এবং চরম দেউলিয়াত্বের দুষ্ট চক্র থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারে না। স্বাভাবিক ভাবেই, এই বাজেট দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে দেশের কৃষক সংগঠনগুলি কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩-এর নিন্দা করেছে। 

তৈলবীজের ব্যাপারে বলতে গেলে, মোদী সরকার বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব প্রদেশ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাম তেলের চাষ প্রচার করতে আগ্রহী। এই নিবন্ধে, আমরা দেখিয়েছি যে কীভাবে পাম তেল চাষের পরিকল্পনাকে সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে, বিজেপির অন্যতম প্রধান অর্থদাতা গৌতম আদানি এবং টেলিভিশন যোগ প্রচারক-পুঁজিবাদী রামদেব-এর স্বার্থ রক্ষার জন্য। 

কৃষকদের ক্ষমতায়ন এবং গ্রামীণ স্টার্ট-আপগুলিকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনা এই সত্যটি আড়াল করার চেষ্টা করে যে মোদী সরকার কৃষির উপর, চাষ থেকে ফসল বিক্রির প্রক্রিয়া জুড়ে কর্পোরেটদের দাপট বৃদ্ধি করতে চায় ঘুরপথে। 

যদিও মোদী এবং তাঁর বিজেপি সর্বদাই পিএম-কিষাণ কর্মসূচি নিয়ে এবং “কৃষক কল্যাণ” উদ্যোগ নিয়ে গর্ব করে। তবে, ২০১৯ সাল থেকে, মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী হলেও সরকার কৃষকদের পিএম-কিষাণ প্রকল্পে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বাড়ায়নি। 

২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে এক একটি পরিবারে গড় ৪.৪৫ জন সদস্য রয়েছেন। এহেন কৃষক পরিবারের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা বরাদ্দের অর্থ হল প্রতি মাসে মাথা পিছু ১১২.৩৬ টাকা বরাদ্দ করা, যার মানে সরকার প্রতিদিন প্রতিটি নথিভুক্ত কৃষক পরিবারের সদস্যকে ৩.৭৪ টাকা প্রদান করছে এবং এত অল্প পরিমাণ অর্থে গ্রামীণ বাজারে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা কী ভাবে তৈরি করা সম্ভব তার উত্তর সম্ভবত মোদীই জানেন। 

আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে কৃষকদের বাঁচতে সাহায্য করার জন্য পিএম-কিষাণ প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে মাথা পিছু অর্থ বাড়ানোর পরিবর্তে, সরকার এই প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ অতি সামান্যই বৃদ্ধি করেছে। পিএম-কিষানের জন্য বিই ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৫,০০০ কোটি টাকা ছিল। এই অর্থবছরে আরই গিয়ে দাঁড়ালো ৬৭,৫০০ কোটি টাকায়। তা সত্ত্বেও, সীথারামন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বিই হিসাবে ৬৮,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন, অর্থাৎ মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। 

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের কৃষি ক্ষেত্রে ব্যয় কমেছে। যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিই ছিল ১.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা, সেখানে জানুয়ারির মাসের শেষেই আরই এসে দাঁড়িয়েছে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা৷ এখন, বর্তমান বাজেটের বিই নির্ধারণ করতে গত বাজেটের বিই কে ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করার ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে  সীথারামন বিই বাড়িয়ে ১.৫১ লক্ষ কোটি টাকা করেছেন। এই কম বরাদ্দ  দেখায় যে কৃষিতে সরকারের উদ্দেশ্য কৃষকদের দুর্দশা উপেক্ষা করে, তাঁদের চরম দুর্যোগে ঠেলে দিয়ে, অর্থাভাবে কর্পোরেটদের দাস শ্রমিকে পরিণত করা।

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ ধ্বংস

সীথারামন ভারতের বৃহত্তম গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প – মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (NREGA)-এর জন্য বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছেন। NREGA বিভিন্ন গ্রামীণ সম্পদ-সৃষ্টি প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্রদের বছরে ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রদান করে। যখন ২০২০ সালে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করেন মোদী, তখন শহরে কাজ হারিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এই NREGA প্রকল্পের সাহায্যে বেঁচে থাকার রসদ খোঁজেন ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোটি কোটি শ্রমিকেরা।  

এর ফলে, ২০২০-২১ অর্থবছরে NREGA-এর জন্য প্রকৃত বিই হিসাবে ১.১১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করার পরে,  সীথারামন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বিই কমিয়ে ৭৩,০০০ কোটি টাকা করেছিলেন। যদিও অর্থবছর ২০২১-২২-এর আরই ৯৮,০০০ কোটি টাকা হয়েছে, সীথারামন আবার অর্থবছর ২০২২-২৩-র জন্য মাত্র ৭৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এর অর্থ হল এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ২৫% বরাদ্দ কাটা যা প্রতি বছর সীমিত সময়ের জন্য কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করে। 

কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুসারে, ভারতে প্রায় ১৫.২৮ কোটি NREGA জব-কার্ডধারী রয়েছে এবং গোটা দেশের দৈনিক মজুরির গড় হল ২৪৫ টাকা। কলকাতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মী নির্বানের মতে, প্রায় ২.৯৭ কোটি জব-কার্ডধারীরা এই বরাদ্দে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০০ দিনের কাজ পেতে পারেন এবং ১২.৩০ কোটি জব-কার্ডধারী কোনও কাজই পাবেন না। এছাড়াও, যদি তহবিলটি সমস্ত জব-কার্ডধারীদের কাজ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে মাত্র ১৯টি কার্যদিবস গোটা বছরে তৈরি করা যেতে পারে। 

এই হিসাবগুলি মোটামুটি অনুমান-ভিত্তিক এবং কাঁচামাল এবং অন্যান্য ইনপুট খরচের হিসাব এতে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদি এই ধরনের খরচ বিবেচনা করা হয়, তাহলে উপকারভোগীর সংখ্যা আনুমানিক পরিসংখ্যানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম হবে। NREGA সংগ্রাম মোর্চার দেবমাল্য নন্দী দ্য হিন্দুকে বলেছেন যে প্রায় ১২,৩০০ কোটি টাকা এই খাতে বর্তমানে বকেয়া রয়েছে——যার মধ্যে ১,৪৬৪ কোটি টাকা মজুরি এবং ১০,৯০০ কোটি টাকা উপাদান খরচ ——যা বরাদ্দের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলবে এবং শুধুমাত্র ৬০,৭০০ কোটি টাকা বাকি থাকবে গোটা বছরের কাজের জন্যে।

জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ স্বাস্থ্যসেবার জন্য ৮৬,৬০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮৫,৯১৫ টাকার আরই-র থেকে ৬৯১ কোটি বেশি। এর আগে কোভিড-১৯ মহামারীর দ্বিতীয় বছর ২০২১-২২ অর্থবছরের বিই ছিল ৭৪,৬০২ কোটি টাকা আর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রকৃত অর্থ খরচ ছিল ৮০,০২৬ কোটি টাকা। 

যদিও মোদী সরকার ২০২১-২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের সময় প্রধানমন্ত্রী আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো মিশন (PMABHIM) ঘোষণা করেছিল, প্রকল্পটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সূচনা করা হয়েছিল। এই প্রকল্পের অধীনে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের থেকে শুরু করে ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করা হয়েছে।  

সীথারামন PMABHIM-এর জন্য বরাদ্দ ২০২১-২২ অর্থবছরের ৫৮৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪,১৭৭ কোটি টাকা করেছেন। তবে এই গতিতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো ভাবেই একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয় আর যে অর্থ এই খাতে বরাদ্দ হচ্ছে তাও যথেষ্ট নয়। 

যদিও কোভিড-১৯ মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জরাজীর্ণ অবস্থা ও দুর্বলতাগুলি উন্মোচিত হয়েছিল, সেখানে যখন একটি জনমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশের জিডিপির কমপক্ষে 5% স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হওয়া দরকার, মোদী সরকার স্বাস্থ্য খাতের লগ্নি কোনো ভাবেই জিডিপির ৩% এর বেশি যেতে দিতে চায় না এবং, এমনকি এই অবস্থাতেও, প্রাচীন ভারতীয় সুস্থতা ব্যবস্থার প্রচারের আড়ালে ছদ্ম-বিজ্ঞান প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে জনসমক্ষে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে একটি হাস্যকর ও উপেক্ষার যোগ্য ব্যবস্থা বানিয়ে ফেলেছে।

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ থেকে কারা উপকৃত হচ্ছেন?

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ ভারতের ৮৫% মানুষের বাজেট নয়, বরং মোদী সরকারের অন্যান্য বাজেটের মতন জন-বিরোধী চরিত্রের আরও একটি বাজেট। এই বাজেটটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে যখন দরিদ্ররা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, মোদী সরকার সেই সময় কর্পোরেট ট্যাক্স সুবিধার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধনীদের ত্রাণ দিতে বেশি আগ্রহী। 

সীথারামন কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ এ খাদ্য ভর্তুকি ২০২১-২২ অর্থবছরের আরই হিসাবে ধার্য ২.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২.০৭ লক্ষ কোটি টাকা করেছেন। এমনকি ২০২১-২২ অর্থবছরের বিই হিসাবে বরাদ্দ করা ২.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা ২০২২-২৩ এর বরাদ্দের চেয়ে বেশি ছিল। তার মানে, বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকি, যা গরিব মানুষের রেশনের চাল-গমের টাকা যোগায়, ৭৯,৬৩৮ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। এটি ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ প্রকল্প ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তাদের খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্তের অংশ। 

যদিও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দাম অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়েছে, মোদী সরকার এই সমস্যাটি মোকাবিলায় চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে, সীথারামন জ্বালানি ভর্তুকি হিসাবে ১৪,০৭৩ কোটি টাকার বিই বরাদ্দ করেছিলেন, তবে, RE আরই মাত্র ৬,৫১৭ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে, যা প্রকৃত বরাদ্দের থেকে ৪৬.৩০% কম৷ কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩-এ, সরকার জ্বালানি ভর্তুকি হিসাবে মাত্র ৫,৮১৩ টাকা বরাদ্দ করেছে, যা বর্তমান অর্থবছরের বিই এবং আরই-র থেকে অনেক কম এবং কয়েক বছরের মধ্যে জ্বালানি ভর্তুকি শেষ করার সরকারের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

মোদী সরকার যখন NREGA থেকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য এবং অন্যান্য ভর্তুকিতে সামাজিক কল্যাণ ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে, তখন বড় কর্পোরেটদের দেওয়া ভর্তুকি এবং বিদেশী ও দেশীয় ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ ব্যবহার করছে। সরকারের আয়ের প্রায় ২০% যাচ্ছে সুদ ও ঋণ পরিশোধে। সীথারামন যেমন অনুমান করেছেন যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৬.৪% রাজস্ব ঘাটতি থাকবে, তার ফলে এটাও বোধগম্য যে সরকার এই ব্যবধান মেটাতে আরও অর্থ বাজার থেকে ঋণ নেবে। সেই ঋণের বোঝা দিনের শেষে কার ঘাড়ে চাপবে? বৃহৎ পুঁজিপতি আর ধনকুবের ১৪২টি পরিবারের না সাধারণ মানুষের? 

মোদী সরকারের কর্পোরেট-পন্থী বাজেট পেশ করা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। উত্তর প্রদেশ সহ শাসক বিজেপির জন্য চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নির্বাচনে যাওয়ার সময়েও দরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রতি কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩ যে নিছক উদাসীনতা দেখিয়েছে তা বেশ লক্ষণীয়। এটি মোদী শাসনের আধিপত্য প্রদর্শন করে, যা বিশ্বাস করে যে ধর্মীয় মৌলবাদ ব্যবহার করে ভোটারদের বিজেপি বশ করতে পারে এবং বছরের পর বছর তাদের আর্থিকভাবে নিঃস্বও করতে পারে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla