গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ভারতীয় হিন্দু উৎসব রাম নবমী পালন করার নামে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার প্রতিযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। এই বছর এক হাজারের বেশী মিছিল করার ডাক দিয়েছিল কট্টরপন্থী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, যা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) একটি জঙ্গী সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাম নবমী উপলক্ষে দাপিয়ে বেড়ায় আরএসএস-র লোকজন। এই সব মিছিলে একাধিক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও দেখা মিলেছে।
উল্লেখ্য, এই বছর রাম নবমীর মিছিলে “হিন্দুদের আক্রমণ করা হয়েছে”, এই ছুতোয় হাওড়ার শিবপুর ময়দানে পথ অবরোধ এবং হাওড়ারই ফজির বাজারে কার্যত আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং তার যুব সংগঠন বজরং দল। অন্যদিকে, গায়ের জোর খাটিয়ে, ইচ্ছে করে বাঁকুড়ার মাচানতলায় রাম নবমীর মিছিল স্থানীয় মসজিদের সামনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে, দেশের বাকি অনেক রাজ্যের মতনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করে আরএসএস। পুলিশ বাধা দিলে প্রথমে বচসা হয়, ও পরে পুলিশকেই আক্রমণ করে আরএসএস-র মিছিল। এই ঘটনায় পুলিশ ১৭ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে।
মনে রাখা উচিত ২০১৮ সালের মার্চ মাসে, আসানসোল ও রানীগঞ্জ এলাকায় আরএসএস-র চক্রান্তে মুসলিম-বিরোধী হিংসা শুরু হয়। রাম নবমীর মিছিলে আসা গুন্ডারা রাস্তার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ও আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লাহ রাশিদীর ছেলে সিবাগত উল্লাহ রাশিদীকে। দাঙ্গার আগুনে পশ্চিমবঙ্গের বুকে পুড়ে ছাই হয়ে যায় একটি কিশোরের প্রাণ। এই হিংসায় সেই বছর রাজ্যের নানা প্রান্তে মানুষ প্রাণ হারান আর আরএসএস এর আক্রমণে একজন পুলিশ অফিসার কে তাঁর হাত হারাতে হয়।
হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আরএসএস এর ষড়যন্ত্রীদের নোংরা, ঘৃণ্য চক্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে জ্বলে যায় আসানসোল ও রাণীগঞ্জ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে জারি হয় কার্ফু, বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। আসানসোলের মুসলিম-বিরোধী হিংসার ঘটনায় নিজের সন্তান হারালেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আবেদন জানান ইমাম রাশিদী। ওনার আবেদনে সারা দিয়ে চারদিন পরে শান্তি ফেরে আসানসোলে। সাম্প্রতিককালে এই সন্তানহারা পিতাই বুকের দুঃখ কষ্ট চেপে রেখে তাঁর ছেলের হত্যা কাণ্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি কারণ তিনি জানান যে তিনি নিজের চোখে কাউকে হত্যা করতে দেখেননি। যদিও তাঁর সাক্ষ্য না দেওয়ায় দুই অভিযুক্ত বেকসুর খালাস হয়ে যান, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রমাণ আদালতে পেশ করেনি কোনো অজানা কারণে।
যদিও ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় পুলিশ ও প্রশাসন কে বিজেপি-আরএসএস-র হিংসার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেন, ২০২২ সালে, পুনঃ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসে সেই বন্দোপাধ্যায়ই উত্তর ভারতীয় উৎসবটি পালন করতে আরএসএস ও বিজেপিকে শুধু খালি মাঠই দেননি গোল করার জন্যে, তার সাথে সাথে তিনি তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস কেও পথে নামান সশস্ত্র মিছিল করতে। এই ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কাছে বন্দোপাধ্যায় খোলাখুলি আত্মসমর্পণ করে কী ইঙ্গিত দিলেন?
এই বছর বন্দোপাধ্যায়ের কঠোর আদেশ ছিল যে প্রশাসন যেন কোনো ভাবেই সশস্ত্র রাম নবমীর মিছিলে বাধা না দেয়। প্রশাসনকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল এই মিছিলগুলো কে সহযোগিতা করার জন্যে। যদিও, ২০১৮ সালে রাম নবমীর অস্ত্র নিয়ে মিছিলের ঘটনায় অস্ত্র আইনের ধারায় আরএসএস ও বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বন্দোপাধ্যায়ই।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ও পরে বন্দোপাধ্যায়ের এই ভোলবদল তাঁর ফ্যাসিবাদী চরিত্রকেই ক্রমাগত স্পষ্ট করে তুলছে।মুখে বিজেপির সমালোচনা করলেও, পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আরএসএস-র রাজনীতিকে সমর্থন করে বন্দোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে শাসক মাত্রেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীই, সে বিজেপি হোক বা তৃণমূল কংগ্রেস।
২০১৮ সালে আসানসোলের বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ ও আরএসএস-র ষড়যন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় কে সেই সময় একাধিক সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখতে দেখা গেলেও, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিনি বহাল তবিয়তে বিজেপি করে বতর্মানে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থীও। অদ্ভুত ব্যাপার হল যে এই বাবুল, যিনি ২০১৮ সালে মুসলিম অঞ্চলে সশস্ত্র রাম নবমীর মিছিলের পক্ষে ওকালতি করছিলেন ও বন্দোপাধ্যায় কে মুসলিম-তোষণকারী বলে গালাগাল করছিলেন, বর্তমানে বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের আগে মুসলিম অঞ্চলে মাথায় ফেজ টুপি পরে ইফতার করছিলেন, মুসলিমদের সাথে কোলাকুলি করছিলেন, আর তৃণমূল কংগ্রেসের যে নেতা আর কর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁরা আজ অস্ত্র হাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর আরএসএস-র সাথে রাম নবমীর মিছিল করছিলেন।
রাম নবমী উপলক্ষ্যে অস্ত্র হাতে মিছিল করা নিয়ে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ দম্ভের সাথে ঘোষণা করেন, “রামের নামে মিছিলে অস্ত্র নয় তো কি লাড্ডু থাকবে?” আসুন দেখে নিই রাম নবমী নিয়ে বিশিষ্ট পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বক্তব্য। পুরাণবিদ ভাদুড়ীর কথায়, “অতীতে কখনওই এই রেওয়াজ এ দেশে দেখা যায়নি। আমাদের বাংলাদেশে কোনদিনই এটা ছিল না। যাঁরা রামচন্দ্রকে আশ্রয় করে এখন রাজনীতি করেন, তাঁরা এগুলি করছেন। রাম নবমী উদযাপন চৈতন্য মহাপ্রভুর কারণে শুরু হয়। তিনি এসে রাম নবমী তিথি পালন করতে বলেছেন। যেহেতু ভগবানের পূর্ণ অবতার রামচন্দ্র, সেই সম্মান তিনি পান। কিন্তু এই যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল, এসব আমাদের দেশে কোনদিনই ছিল না। যাঁরা নতুন করে রামায়ণ লিখছেন, যাঁরা নতুন করে রামচন্দ্রকে চেনাচ্ছেন, এসব তাঁদের কাজ। একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল এটা করছে।”
একদিকে কর্মহীনতা বেড়ে যাওয়ায় সারা ভারতের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও বেকারত্বের পারদ উর্দ্ধগামী। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমির তথ্য অনুসারে মার্চ ২০২২-এ পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ৫.৬% ছিল যা বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশ (৪.৪%) ও গুজরাটের (১.৪%) চেয়েও খারাপ। এর মধ্যে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা তলানিতে গেছে। বিরোধী শিবিরের উপর নেমে আসছে একের পর এক আক্রমণ। আনিস খাঁ হত্যাকান্ড, রামপুরহাট গণহত্যা আর হাঁসখালি গণধর্ষণের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ আর বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশের বিভেদ মুছে দিয়েছে।
এর মধ্যে পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম উর্দ্ধগতিতে বেড়ে চলায় চরম সঙ্কটে পড়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলোর যে কোনো ফারাক নেই তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন। এর ফলে, একদিকে বন্দোপাধ্যায়ের সরকার পুলিশ দিয়ে গণআন্দোলন কর্মীদের “মাওবাদী” তকমা দিয়ে গ্রেফতার করে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন গড়ার পথে বড় বাঁধা সৃষ্টি করছে আর, অন্যদিকে, আরএসএস-র মতন সন্ত্রাসী ফ্যাসিবাদী শক্তি কে রাম নবমী উপলক্ষে সশস্ত্র মিছিল করার সুযোগ দিয়ে, সারা রাজ্যে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে সাম্প্রদায়িক অশান্তি করতে দিয়ে, সামাজিক বিভেদের ফাটল কে চওড়া করার সুযোগও করে দিচ্ছে। এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে মমতা বন্দোপাধ্যায় আর নরেন্দ্র মোদী শাসক হিসাবে একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। এদের শাসনে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে গরিব মানুষের।