নাড়িট, সীমানা গড়া, সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়া, বহু প্রচলিত পঞ্চায়েত আমতা ব্লক-২ এর। কৃষির উন্নয়ন কিংবা ১০০ দিনের কাজের উন্নয়নে এই গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েনি মানুষের মুখে মুখে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮ তারিখ রাতের অন্ধকারে বাড়িতে তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত রাজনৈতিক পুলিশ ঢুকে বাবার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে, প্রতিবাদী মুসলিম যুবক আনিস খাঁ কে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসের কথা কে প্রকাশ্যে এনেছিল। উত্তাল হয়েছিল গ্রাম থেকে শহরের মানুষ, আনিস হত্যার প্রতিবাদে বিচারের দাবিতে। সবার অভিযোগ, আনিসকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রী আশ্রিত দুষ্কৃতী’রাই খুন করেছিল সেই রাতে। যার সাথে সরাসরি জড়িত সেই গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান হাসু খাঁ ও বিধায়ক সুকান্ত পাল এবং আমতার তৎকালীন এসপি সৌম্য রায়। কে করবে এর বিচার তবে?
রাজ্য সরকার গঠিত সিট-এর তদন্ত প্রক্রিয়া আজ শেষ হয়ে গেছে। গত ৭ জুন, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা’র পক্ষ থেকে আনিস মামলার রায় স্থগিত রাখা হয়েছে। যদিও এখনো আনিসের পরিবার কোর্টের তত্ববধানে সিবিআই তদন্তের দাবিতেই অনড় রয়েছে। তবুও একটা বিষয় স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, শাসকশ্রেণী তার পুরানো ছকে সময়ের কারসাজিতে আইনি ছেলেখেলার মধ্যে দিয়ে এই মামলা ধামাচাপা দিতে চাইছে। যেমনটা হয়েছিল বামফ্রন্ট আমলে রিজওয়ানুর রহমানের ক্ষেত্রে।
আনিসের বাড়ি যাওয়ার আগের মোড়ে তাজপুর ক্লাবের বাইরে আনিস হত্যার বিচারের পোস্টার,ব্যানার এখনো ভাসছে সাদা দেওয়ালের গা জুড়ে। এই ক্লাবের পাশ দিয়েই পুকুরপাড়ের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে সোজা চলে গেলে পড়ে পাশের তাজপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। সারদা ও তাজপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত নাসিম উদ্দিন কাজী’র প্লাস্টার চটা দের তলার বাড়ি। নাসিম সম্পর্কে আনিসের মামা ছিলেন। নাসিমের বয়েস ২৪ ছুঁইছুঁই, বর্তমানে তিনি তার ভাগ্নে আনিসের হত্যার বিচার এবং গ্রামের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায় দিন গুনছেন। নাসিমের পিতা পেশায় দিনমজুর, সংসার কোন রকমে টেনেটুনে চলে যায় এই আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বাজারে।
নাসিমের পরিবারের অভিযোগ, তাদের কে ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হচ্ছে গত দুই মাস ধরে গ্রামের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-প্রধানদের পক্ষ থেকে। যার একটাই কারণ, এই মুহূর্তে সর্বক্ষণ আনিসের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে, আনিস মৃত্যুর বিরুদ্ধে এবং রাজ্যে শাসকদলের দুর্নীতি ও গ্রামে হাড় কাঁপানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার জন্যে। ইতিমধ্যে নাসিমকেও প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে তাজপুর পঞ্চায়েত প্রধান গোলাম খাঁ-র পক্ষ থেকে। আনিস বেঁচে থাকাকালীন ঠিক যেমনটা তার সাথেও চলেছিল, সারদা পঞ্চায়েত প্রধান হাসু খাঁ ও তার দলবলের পক্ষ থেকে।
আনিস হত্যার তিনমাস পরেই আরেকটা হত্যার হুমকি স্বাভাবিক ভাবেই স্পষ্ট করে দিচ্ছে, গ্রামে-গ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের নেতাদের বাড়বাড়ন্ত কতদূর এগিয়েছে, হয়তো সেটা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে ভয় পেয়ে রোধ করবার জন্যেই। কিন্ত এ আর কতদিন গ্রামের মানুষ মুখ বুঝে সহ্য করে যেতে পারে?
১৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে আমতা-২ ব্লক গঠিত, যার মধ্যে তিনটে পঞ্চায়েত নদীমাতৃক। এখানকার মানুষের প্রাথমিক পেশা কৃষি তার সাথে রয়েছে গবাদী পশুপালন, মূর্তি বানানোর কাজ প্রভৃতি। বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা প্রধান’রা গ্রামের ছোট কৃষকদের হাত থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার ফলে তাদের জীবন-যাপন নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া, টাকার অভাবে, ১০০ দিনের কাজ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়ার দরুন, অধিকাংশ মানুষ কেরালা, হায়দ্রাবাদ, সহ আরো বহু জায়গায় কম পয়সার মজুরিতে খাটতে রওনা হচ্ছেন। যার ফলে রাজ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবি মানুষকে কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার’কে পরাস্ত করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরেছিল গত বছর। কিন্ত তাদের গত একবছরের শাসনকালের দুর্নীতি, গুন্ডাপুলিশ মিলিত সন্ত্রাস ও সেগুলি রক্ষার্থে অগুনতি সমালোচকদের কালা আইনে হাজতে ভরা, আজ প্রমাণ করে দিয়েছে, কেন্দ্রের হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী নীতিকে সুপ্ত কৌশলে এ রাজ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতেই তৃণমূল কংগ্রেসের তৃতীয়বার ক্ষমতায়ন হয়েছিল। বিজেপিকে প্রধান বিরোধী বানিয়ে এই বাংলার বুকে তৃণমূল কংগ্রেস নিজের হিন্দুত্ব্ববাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে বিজেপির পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) পৃষ্টপোষকতায়।
সারদা গ্রামের প্রতিবাদী যুবক আনিস খাঁ কে প্রচুর হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছিল গত দুই বছর ধরে, তার হত্যার আগে। এবার তাঁরই মামা নাসিম উদ্দিন কাজীও প্রাণনাশের হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের গোলাম খাঁ এর শাসনে।বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে যখন সিট তদন্তের রিপোর্ট ঠান্ডাঘরে পাঠানো হয়েছে, আনিস খাঁর খুনিরা যখন বুক ফুলিয়ে বাইরে ঘুরছে তখন কি নাসিম উদ্দিন কেও উৎসর্গ করে দেওয়া যায় তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসের যূপকাষ্ঠে?