ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রাইজাল কমিটি (জিইএসি) দেশে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএম) সর্ষে চাষের অনুমতি দিয়েছে। এই সংক্রান্ত সুপারিশ কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের অনুমতির জন্যে জিইএসি পাঠিয়ে দিয়েছে। জিএম সর্ষে ফলন করার কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংস্থার সুপারিশ কৃষক সংগঠন ও পরিবেশ সংগঠনগুলোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এবং তাঁরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এর ফলে কৃষকদের, পরিবেশের ও জনগণের স্বাস্থ্যের নানা ধরণের ক্ষতি হতে পারে।
১৮ই অক্টোবর ২০২২ এ জিইএসি জিএম সর্ষের প্রস্তাব পাশ করে ও দুটি জিএম সর্ষের পরিবেশগত ছাড় দেয়। এই দুই ধরণ কে ব্যবহার করে নতুন অভিভাবক লাইন আর হাইব্রিড তৈরি করা যাবে ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের (আইসিএআর) নজরদারিতে। ধারা সর্ষে হাইব্রিড (ডিএমএইচ-১১) ধরণ কে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে দুইটি শর্তের ভিত্তিতে –– প্রথমতঃ এই ছাড়পত্র শুধুমাত্র চার বছরের জন্যে এবং প্রতি দুই বছরে তার নবীকরণ করতে হবে এবং দ্বিতীয়তঃ, এই জিএম সর্ষের ফসলে নিয়ন্ত্রিত ভাবে উদ্ভিদনাশক বা হার্বিসাইড ব্যবহার করা যাবে।
প্রসঙ্গতঃ জিএম সর্ষে কে এই প্রথম জিইএসি ছাড়পত্র দেয়নি, বরং এর আগে, ২০১৭ সালের মে মাসেও, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট এই জিএম ফসল কে বাণিজ্যিক ভাবে ফলনের অনুমতি দিয়ে নিজের প্রস্তাব জিইএসি পরিবেশ মন্ত্রকে পাঠায়। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে অসংখ্য কৃষক সংগঠন ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের বিক্ষোভের কারণে—যা মোটামুটি ২০১৫ সাল থেকেই গড়ে ওঠে ও ২০১৬ সালে দিল্লীর যন্তর মন্তরে ১২০টির উপর সংগঠন বিক্ষোভ দেখায়—পরিবেশ মন্ত্রক ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেয়। সেই সময়ে সমস্ত সংগঠনগুলো একযোগে সুপ্রিম কোর্টের কড়াও নাড়ে।
অভিযোগ করা হয়েছে যে জিএম সর্ষে ফসল উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণে হার্বিসাইড ব্যবহার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সেই হার্বিসাইড হবে গ্লুফোসিনেট যা স্নায়ুর পক্ষে প্রচন্ড ক্ষতিকারক এক বিষাক্ত উপাদান। ২০১৭ সালে পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (আইএআরআই) এর যে গবেষণার উপর ভিত্তি করে জিইএসি জিএম সর্ষের বাণিজ্যিক চাষের ছাড়পত্র কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রককে দেয়, তা নিয়ে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি বর্তমানে এই জিএম সর্ষের উপর হওয়া নতুন গবেষণার প্রক্রিয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এই জিএম সর্ষে চাষের উপর ও মানব শরীর সহ পরিবেশ ও কৃষির উপর তার বিরূপ প্রভাব নিয়ে করা গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে কৃষক সংগঠনগুলো ও পরিবেশ কর্মীদের তরফ থেকে।
ভারত বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ তৈলবীজ উৎপাদক দেশ। ভারতে উৎপাদিত সকল তৈলবীজের মধ্যে ২৮.৬% হল সর্ষে ও রাইসরিষা। বিশ্বে সোয়াবিন ও পাম তেলের পরে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভোজ্য তেল হল সর্ষে। যেখানে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৮৪.৩ লক্ষ মেট্রিক টন সর্ষে ও রাইসরিষা উৎপাদন হয়েছিল সেখানে ২০২২ সালে ১.১৪ কোটি মেট্রিক টন উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে সরকারি হিসাব অনুসারে। ভারতে সর্ষে ফলন মূলত রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে হয়। দক্ষিণের অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুতেও সর্ষের ফলন হয়।
ভারতীয় সর্ষে — হলুদ ও খয়েরি রঙের — মূলত রায়া ও তোরিয়া প্রজাতির হয়। যদিও অসম, বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে হলুদ সর্ষে রাবি ফসলের অন্তর্গত, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে এই সর্ষে কিন্তু একটি বাণিজ্যিক শস্য হিসাবে উৎপাদিত হয়। এত সত্ত্বেও ভারতে ভোজ্য তেল উৎপাদন কিন্তু দেশের চাহিদা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট নয় আর তাই ভোজ্য তেল আমদানি করতে ভারতের একটি বড় অঙ্কের বিদেশী মুদ্রা প্রতি বছর খরচ হয়।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার দেশে ভোজ্য তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানি কমানোর লক্ষ্যে নতুন পাম তেল নীতি গ্রহণ করে ২০২১ সালে, কিন্তু সেই নীতি পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক ও শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পৃষ্টপোষক হিসাবে চিহ্নিত গৌতম আদানির আদানি উইলমার এবং বাবা রামদেবের পতঞ্জলি কোম্পানির পক্ষপাতিত্ব করছে বলে অভিযোগ করা হয়। বর্তমানে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১,০০০ থেকে ১,২০০ কিলোগ্রাম রায়া ও তোরিয়া প্রজাতির সর্ষে উৎপাদন করা সম্ভব, আর সেই তুলনায় ডিএমএইচ-১১ নাকি ৩০% বেশি ফলন দেবে বলে গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।
বর্তমানে যদিও সরকারের লক্ষ্য হল দেশে জিএম সর্ষে উৎপাদন বৃদ্ধি করে ভোজ্য তেলের আমদানি কমানো, কিন্তু এই জিএম প্রক্রিয়ার মধ্যেই পরিবেশের পক্ষে, কৃষির পক্ষে ও জনগণের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক উপাদান আছে বলে অভিযোগ। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (হু) এর গবেষণায় দেখা গেছিল যে জিএম শস্য সেবন করার ফলে মানব শরীরে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর আর্থিক অনুদানে হওয়া গবেষণায় তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মধ্যেও এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
কিন্তু ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে জিএম পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া বিটি তুলা চাষ করে ব্যাপক সঙ্কটে পড়েছেন অন্ধ্র প্রদেশ, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষকেরা। বিটি তুলা চাষীদের এর আগে শ্বেত পতঙ্গ ও গোলাপি বোলওয়ার্ম বা এক প্রকারের শুঁয়া পোকার আক্রমণে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে, তেমনি বীজের ক্ষেত্রে তাঁদের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। জিএম বীজ ব্যবহার করা হলে যেমন প্রচুর পরিমাণে হার্বিসাইড লাগে, তেমনি সেই জমিতে অন্য বীজের ফলন হওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার হয়। ফলে কৃষকের নির্ভরতা বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর উপর বৃদ্ধি পায় ও বীজ বিক্রির ক্ষেত্রে একধরণের একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করে বিক্রেতা সংস্থাগুলো।
তুলা যেহেতু খাদ্য শস্য নয়, বরং একটি বাণিজ্যিক শস্য, ফলে বিটি তুলা উৎপাদনে সর্বস্বান্ত হয়ে ঋণের দায়ে দেনাগ্রস্ত কৃষকদের বড় সংখ্যায় আত্মহত্যার পরেও, এর সরাসরি কোনো প্রভাব দেশের জনগণের উপর পড়েনি। কিন্তু যেহেতু সর্ষে ও রাইসরিষা, বিশেষ করে ভোজ্য তেল বানাতে, গোটা দেশে ব্যবহার হয়, ফলে জিএম সর্ষে উৎপাদনের ফলে যে দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে এই নিয়ে বামপন্থী অখিল ভারত কৃষক সভা থেকে শুরু করে অতি দক্ষিণ ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ (বিকেএস)—বিজেপির অভিভাবক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) কৃষক সংগঠন—প্রতিবাদ করে এসেছে।
এই প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলে ২০১০ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ কে বিটি বেগুন ফলনের প্রস্তাব কে স্থগিত করতে হয় আর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জনস্বাস্থ্যের উপর এই জিএম ফসলের প্রভাব নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই একমাত্র জিএম শস্য ফলনের অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার এসে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে জিএম ফসল ফলানোর উপর জোর শুরু করে। এর ফলেই জিএম সর্ষে উৎপাদনের ছাড়পত্র পাঁচ বছরে দুইবার দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
আরএসএস এর কৃষক সংগঠন বিকেএস এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মোহিনী মোহন মিশ্র সম্প্রতি দ্যা হিন্দু পত্রিকা কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জিএম শস্য ফলন কে একটি “বৈজ্ঞানিক প্রতারণা” বলে চিহ্নিত করেছেন ও বলেছেন যে এই ধরণের ফসল মাটির, কৃষির উপযোগী সকল পোকা মাকড়ের ও মানব শরীরের পক্ষে প্রচন্ড ক্ষতিকারক। তিনি অভিযোগ করেন যে জিএম সর্ষের মাধ্যমে ভারতীয় খাদ্য শৃঙ্খলে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দ্বারা জিএম খাদ্য বস্তু ঢোকানোর ষড়যন্ত্র চলছে। এই ঘটনার জন্যে তিনি জিইএসি, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের খাদ্য সুরক্ষা ও মান কতৃপক্ষ (এফএসএসআই) এর একটি অক্ষ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
জিএম-মুক্ত ভারত জোটের তরফ থেকে কবিতা কুরুগান্তি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তিনিও সংবাদপত্রটিকে জানিয়েছেন যে যদিও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব এককালে নিজে জিএম শস্যের বিরোধিতা করেছিলেন, তবুও তাঁর মন্ত্রক জিইএসি-র তরফ থেকে কেন জিএম সর্ষে উৎপাদন করার ছাড়পত্র নিচ্ছে সেটা আশ্চর্যজনক।
এই মুহূর্তে জিএম সর্ষে উৎপাদন নিয়ে অন্যান্য গণ সংগঠনগুলোর তরফ থেকে কোনো প্রেস বিবৃতি বা বয়ান দেওয়া হয়নি, তবে অতীতের ঘটনাবলীর দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে যে কৃষক সভা সহ অন্য বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলোও কোনো ভাবেই জিএম সর্ষে ফলনের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। এর সাথেই, গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রায় এক বছর ধরে মোদী সরকারের তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান আন্দোলন করে জয়ী হওয়া কৃষকরা এখনো সরকারের তরফ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইন বানানোর টালবাহানা নিয়ে ক্ষুব্ধ, এর মধ্যে জিএম সর্ষে উৎপাদন সংক্রান্ত নয়া সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের মতন কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রগুলোয় আবার নতুন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনের ঢেউ উঠতে পারে স্বাভাবিক ভাবেই।
জিএম সর্ষে উৎপাদনের ফলে দেশে সর্ষে ও রাইসরিষা উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা যদি মানব শরীর ও পরিবেশের, এবং সর্বোপরি কৃষি ও কৃষকের, পক্ষে ক্ষতিকারক হয় তাহলে তাতে আপামর জনগণের কোনো লাভ হবে না। এই কারণে মোদী সরকারের উচিত কৃষকদের ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের সাথে আলোচনা করে, এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে দেশীয়, জৈবিক উপায়ে উৎপাদন বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া, যাতে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে সর্ষে সহ অন্যান্য ভোজ্য তেলের উপাদানের উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানি হ্রাস করা যায় ও মূল্যবৃদ্ধির কোপ থেকে সাধারণ মানুষ কে রক্ষা করা যায়।