ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীথারামান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফার সরকারের তরফে তাঁর শেষ পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেন বুধবার, ১লা ফেব্রুয়ারি। কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ ভারতবাসী কে, বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, জনগণের ব্যাপক অংশের জন্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও কোনো কথা এই বাজেট বলেনি।
সীথারামানের বাকি তিনটি কেন্দ্রীয় বাজেটের মতনই কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ শুধু ফাঁপা আশ্বাস দিয়েছে আর গরীব মানুষের জন্যে বরাদ্দে নানা ভাবে কোপ বসিয়েছে। দেশের বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ও ঊর্ধ্বগামী তেল ও গ্যাসের মতন জ্বালানির দাম কে রোধ করার পরিকল্পনা তো দুর অস্ত, এই কথাগুলোর উল্লেখ পর্যন্ত সীথারামান করেননি।
সরকারের আয়-ব্যয় আর আর্থিক ঘাটতি
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ সীথারামান দেখিয়েছেন যে সরকারের আয়ের সর্ববৃহৎ উৎস হল ঋণ আর ব্যয়ের সব চেয়ে বড় ক্ষেত্র হল সুদ মেটানো। এর ফলে আর্থিক ঘাটতি বর্তমানে ৬.৪% এ দাঁড়িয়ে আছে যা ২০২৪-২৫ এ ৪.৫% করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী ভাবে রাজস্ব ঘাটতি সরকার পূর্ণ করবে সেই নিয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
সরকারের রাজস্ব আয়ের উৎস
কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের হিসাব
রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকার নতুন অপ্রত্যক্ষ কর জনগণের ঘাড়ে চাপায় তাহলে তার ফলে বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি আর চরম বেকারত্বের পরিস্থিতিতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপর সেটা একধরণের বড় আঘাতই হবে। এ ছাড়া সরকার ব্যাপক হারে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করলে সুদ সহ মূল অর্থ ফেরৎ দিতে গেলে সেটা অর্থকোষের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ কী কী বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে
সীথারামান মূলধন খাতে ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা, যা গতবারের তুলনায় ৩৩.৪% বেশি, বৃদ্ধি করে ১০ লক্ষ কোটি টাকা করেছেন। তবে এই খরচের সাথে সরাসরি ভাবে কর্মসংস্থানের কোনো যোগসূত্র নেই। মোদী সরকারের মতে যেহেতু পরিকাঠামো বিকাশের ফলে সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তাই পরিকাঠামো উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
এই পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ভারতীয় রেল। সামগ্রিক ভাবে রেলের জন্যে সরকার ২.৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যার মধ্যে রেল লাইনের উন্নয়নের জন্যে বরাদ্দ আর্থিক বছর ২০২২-২৩ এর ১৫,৩৮৮.০৫ কোটি টাকার থেকে বাড়িয়ে ১৭,২৯৬.৮৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু রেলের অসংখ্য শূন্য পদে কবে যে নিয়োগ হবে সেই নিয়ে কোনো শব্দ সীথারামান উচ্চারণ করেননি।
এর সাথেই প্রতিরক্ষা খাতে ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের ৫.২৫ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় ৫.৯৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর সাথে ৩৫,০০০ কোটি টাকা পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে সেই বিদ্যুৎ কে উৎপাদন করবে ও ২০৩০ সালের মধ্যেই ভারতে ব্যাপক পরিমাণে সবুজ বিদ্যুৎ শক্তি কী ভাবে উৎপাদন করবে সেই নিয়ে কোনো বক্তব্য কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ নেই।
কর ছাড়
কর ছাড়ের ক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের জন্যে সামান্য ছাড় দেওয়া হয়েছে নতুন আয়কর ব্যবস্থার অধীনে, যদিও সেই ব্যবস্থায় আয়কর দাতারা তাঁদের বীমা, গৃহ ঋণ, বা সন্তানের শিক্ষার খাতে খরচ হওয়া অর্থের উপর কোনো ছাড় পান না। অর্থমন্ত্রক এখনো হিসাব দেয়নি যে কত শতাংশ আয়কর দাতা পুরানো ব্যবস্থার থেকে নতুন ব্যবস্থায় চলে এসেছেন, তবে আগামী দিনে নতুন করদাতারা যে স্বয়ংক্রিয় ভাবে নতুন ব্যবস্থার অধীনেই আসবেন —— অর্থাৎ লগ্নি বা খরচের ভিত্তিতে কর ছাড় পাবেন না —— সেই কথা সরকার জানিয়েছে। এর ফলে যে অনেকগুলো আর্থিক ক্ষেত্রে লগ্নি ব্যাপক পরিমাণে কমে যাবে ও তার ফলে নানা ভাবে সরকারি ঋণ বন্ড ও অন্যান্য বন্ডে লগ্নিও কমে যাবে সেই সম্পর্কে মোদী সরকার কিন্তু নীতিগত দিক থেকে এখনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।
তবে আয়করের ক্ষেত্রে অতিধনীদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অতিধনীদের ক্ষেত্রে বার্ষিক ৫ কোটি বা তার উপরের আয়ের উপর চাপানো ৩৭% কর কমিয়ে ২৫% করা হয়েছে, যা বর্তমানে ব্যাপক আর্থিক ঘাটতির মধ্যে সরকারের রাজস্ব আয় কে আরও কম করবে। সেই ঘাটতি কী ভাবে কম হবে সেই সম্পর্কে সরকার কোনো মন্তব্য কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ করেনি।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হল সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ হওয়া অক্সফামের একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে ভারতের অতি-ধনী ১% মানুষের কাছে ২০২১ থেকে দেশের ৪০.৫% সম্পদ রয়েছে। নিম্নের ৫০% মানুষের—৭০ কোটি মানুষের— মাত্র ৩% সম্পদের উপর মালিকানা আছে। করোনা অতিমারীর থেকে ২০২২ পর্যন্ত ভারতের অতি-ধনীদের সম্পদ গড়ে ১২১% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা হিসাব করলে একদিনে ৩,৬০৮ কোটি টাকা হয় বা মিনিটে ২.৫ কোটি টাকা। এই সময়ে অতি-ধনীদের করে ছাড় দেওয়া মানে হল রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি করে আর্থিক বৈষম্য কে আরও বৃদ্ধি হতে দেওয়া যার ফলে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণীগুলো আরও সঙ্কটে জর্জরিত হবে।
ব্যবসা ও বাণিজ্য
ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদিও স্টার্ট-আপগুলোর আয়করের উপর ছাড় দেওয়ার মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করে মার্চ ২০২৪ করা হয়েছে, কিন্তু স্টার্ট-আপ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এমএসএমই) ক্ষেত্রে সরকার কোনো ভাবেই ঋণ ছাড়া মূলধনের সমস্যা মেটানোর কোনো চেষ্টা করেনি। ২০২০ সালের অতিমারীর সময় থেকেই সরকার বারবার এমএসএমই ক্ষেত্র কে ঋণ দেওয়ার কথা বললেও, ব্যাপক জনগণের মাথা পিছু আয় কমে যাওয়ার ফলে বাজারে এমনিই সামগ্রিক চাহিদার একটা ঘাটতি আছে, আর সেই ক্ষেত্রে কেন এমএসএমই ক্ষেত্রের সংস্থাগুলো ঝুঁকি নিয়ে ঋণ তুলে উৎপাদন করতে যাবে এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে এমএসএমই মালিকেরা করে আসছেন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি দেখিয়ে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ কিন্তু একদিকে জিডিপির অনুপাতে দুই খাতেই সে ভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেনি। আর্থিক বছর ২০১৯-২০তে যেখানে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৪%, সেটা করোনা অতিমারীর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পায়, আর বর্তমানে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ জিডিপির ২.১% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে।
শিক্ষা খাতে আর্থিক বছর ২০১৯-২০ এ জিডিপির ২.৮% এর থেকে মাত্র ০.১ শতাংশ বিন্দু বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ জিডিপির ২.৯% বরাদ্দ করা হয়েছে। এই নামমাত্র বরাদ্দ বৃদ্ধি এমন সময় করা হয়েছে যখন প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পরে গত বছর থেকে স্কুল-কলেজ খুলেছে ও পড়ুয়ারা ক্লাস করতে পারছেন। এই সময়ে যে বিপুল পরিমাণের পড়ুয়ারা পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আর্থিক সঙ্কটের কারণে, তাদের ফেরত আনার কোনো প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকার হাতে নেয়নি।
বর্তমানে সর্ব শিক্ষা মিশনের মাধ্যমে যে ভাবে মিড-ডে মিল খাওয়ানোর জন্যে পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যে পড়ুয়া পিছু সরকার স্কুলগুলো কে ৬ টাকারও কম দিচ্ছে, সেখানে এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে——যা এখন পিএম পোষণ নামক প্রকল্পের অধীন——পড়ুয়াদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাওয়া জোগানোর জায়গায় কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ উল্টে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে।
২০২২-২৩ আর্থিক বছরে যেখানে পিএম পোষণ প্রকল্পের জন্যে বাজেট এস্টিমেট (বিই) ছিল ১০,২৩৪ কোটি টাকা সেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার ফলে রিভাইসড এস্টিমেট (আরই) বেড়ে দাঁড়ায় ১২,৮০০ কোটি টাকায়। কিন্তু সেই অনুপাতে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এর বিই তে বরাদ্দ না বাড়িয়ে গত বছরের বিই-র হিসাবে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১১,৬০০ কোটি টাকা। যা আরই-র তুলনায় ১,২০০ কোটি টাকা কম।
জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ জনকল্যাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত নানা প্রকল্পের বরাদ্দে কাঁচি চালিয়েছেন সীথারামান। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কর্ম গ্যারান্টি আইন (এমএনরেগা) প্রকল্পে ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের বিই ছিল ৭৩,০০০ কোটি টাকা, যা তার আগের বছরের, আর্থিক বছর ২০২১-২২ এর ৯৮,৪৬৮ কোটি টাকার আসল খরচের তুলনায় এমনিই কম ছিল। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে এমএনরেগা বা ১০০-দিনের কাজের প্রকল্পের আরই হয়েছে ৮৯,৪০০ কোটি টাকা যা বিই-এর তুলনায় অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এ ১০০-দিনের কাজের খাতে বরাদ্দ গত বছরের বিই-এর তুলনায় কম করে ৬০,০০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা রাজ্যে ১০০-দিনের কাজের বহুদিনের বকেয়া বাকি থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই দিক থেকে এমএনরেগা প্রকল্পে অর্থের বরাদ্দ না বাড়িয়ে বরং তা কমানো এই গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালানো কষ্টজনক করে তুলবে ও গ্রাম ছেড়ে কোটি কোটি মানুষ কে আবার কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শহরের দিকে যেতে বাধ্য করবে।
এমএনরেগা ছাড়াও সংখ্যালঘু উন্নয়ন, জাতীয় শিক্ষা মিশন, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি (কৃষকদের পেনশন), ফসল বীমা, খাদ্য ভর্তুকি, প্রভৃতিতে গত বছরের তুলনায় ব্যাপক বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।
বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের স্বীকৃতি প্রাপ্ত ২০২২-২৩ সালের আর্থিক সমীক্ষা ঘুরিয়ে স্বীকার করেছে যে দেশের সামগ্রিক কর্মসংস্থানের চিত্রটি খুবই করুণ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি (সিএমআইই) নিজের বেসরকারি সমীক্ষায় বর্তমানের বেকারত্বের হার কে ৭% এ বজায় রেখেছে। শহরাঞ্চলের সাথে গ্রামাঞ্চলেও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আদিবাসী স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ বাদ দিয়ে সরাসরি কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো কথা সীথারামান তাঁর বাজেটে বলেননি। উল্টে নানা ধরণের ঋণের কথা বলে কর্মসংস্থানের বলটিকে ঠেলে দিয়েছেন বেসরকারি ক্ষেত্রের, বিশেষ করে এমএসএমই ক্ষেত্রের, কোর্টে। এর ফলে সাধারণ নির্বাচনের আগের বছরের পূর্ণাঙ্গ বাজেট হিসাবে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ জনগণের জন্যে কোনো ধরণের নতুন আশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।