গত সাত দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের কারণে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। হঠাৎ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ শান্তির দূত হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ও বিশ্বের বুকে নিজেকে একটি আক্রান্ত শক্তি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছে। একটি দ্রুত-পরিবর্তনশীল বিশ্বে যেখানে মার্কিন আধিপত্য ক্ষয় হচ্ছে এবং ছোট দেশগুলিকে ওয়াশিংটন ভয় দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট হাস্যকর।

সম্প্রতি, নিজেকে আক্রান্ত হিসাবে চিত্রিত করার জন্য, মার্কিন নৌবাহিনী তাইওয়ান প্রণালীর একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে চীনের গণমুক্তি ফৌজের নৌবাহিনীর (পিএলএ-এন) একটি যুদ্ধজাহাজ আমেরিকান ডেস্ট্রয়ারকে প্রায় আঘাত করতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে পিএলএ-এনের একটি “অনিরাপদ” কৌশল বলে অভিহিত করেছে।

এই ঘটনাটি শনিবার, ৩রা জুন, তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডিয়ান নৌবাহিনীর যৌথ নৌ মহড়ার সময় ঘটে। মার্কিন নৌবাহিনীর ইউএসএস চুং-হুন এবং কানাডিয়ান ফ্রিগেট এইচএমসিএস মন্ট্রিয়েল চীন এবং তার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ‘তাইওয়ান’-এর মধ্যে তথাকথিত “ন্যাভিগেশনের স্বাধীনতা” ট্রানজিট পরিচালনা করছিল।

চীনা পিএলএ-এন যুদ্ধজাহাজ লুয়াং ৩ কে মার্কিন ডেস্ট্রয়ারের পথ তীব্রভাবে কাটতে দেখা যায়। এর ফলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজটি গতি ধীর করতে বাধ্য হয়। চীনা জাহাজটি তখন তার দিক পরিবর্তন করে এবং ইউএসএস চুং-হুনের সাথে সমান্তরাল পথে যাত্রা অব্যাহত রাখে।

এই ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভীত করেছে, যে এশিয়ায়, তার ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে, নৌ মহড়া চালাচ্ছিল। এই মহড়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল চীন কে ভয় দেখানো ও ‘তাইওয়ান’ দ্বীপের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি কে মদদ করা, যা হাস্যকর ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত ‘এক চীন নীতির’ পরিপন্থী। 

চীনা পিএলএর সিনিয়র কর্নেল শি ই তার প্রতিবেশী অঞ্চলে সমস্যা সৃষ্টির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাকে দায়ী করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই দেশগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে এবং বিদ্বেষপূর্ণভাবে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাকে তথাকথিত “তাইওয়ানের স্বাধীনতা” বাহিনীকে ভুল সংকেত পাঠানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন।

তথাকথিত “ইন্দো-প্যাসিফিক”, অর্থাৎ, সুদূর-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারণ এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে চীনকে ঘিরে ফেলার এবং নিজের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য কঠোর চেষ্টা করছে। এর কারণ হল ‘তাইওয়ান’ নামক দ্বীপ থেকে নিজের দেশ পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেন কে ওয়াশিংটন ডিসি যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে চায়। 

ঘটনার পরপরই, রবিবার, মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জে অস্টিন ৩ সিঙ্গাপুরে বলেছিলেন যে “ইন্দো-প্যাসিফিক” মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রধান ফোকাস এলাকা। যে এলাকাটি তার আশেপাশে নয় বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন সীমানা ভাগ করে না সেটি কেন তার ফোকাস এলাকা? কারণ স্পষ্টতই চীনকে নিরস্ত করা এবং বিশ্বে তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করা।

যাইহোক, কেন চীন তার সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার মাধ্যমে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার অধিকার পাবে না যেখানে সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং ভারী সশস্ত্র মার্কিন সামরিক বাহিনী ফোকাস করছে? এটি এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর পেন্টাগন বা অস্টিন দেবে না।

তারপরও, অস্টিন এই অঞ্চলের জলপথে চীনের “জবরদস্তিমূলক আচরণ” সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন, এই সত্যটিকে বাদ দিয়ে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে এই জাতীয় কোনও নৌ মহড়া করার অনুমতি দিত না এবং যদি পিএলএ-এন একটি জাহাজও সেখানে পাঠাতো তাহলে মার্কিন মুলুকে ও পশ্চিমী দুনিয়ায় ত্রাহি ত্রাহি রব উঠতো। 

তাহলে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সব মজা উপভোগ করার একচেটিয়া অধিকার থাকবে? কেন মার্কিন নৌবাহিনী বিশ্বের যে কোনো স্থানে ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন করার স্বাধীনতা পাবে? সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করে সেই দেশগুলো কে মন্দ বলে যারা অন্য দেশে সরকার উৎখাত করার জন্যে বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেনি?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আগ্রাসনকে আরও মোকাবেলা করার জন্য, চীনা এবং রাশিয়ানরা জাপান সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের উপর আকাশপথে আধিপত্য বিস্তারের জন্য হাত মিলিয়েছে। মঙ্গলবার, ৬ই জুন, উভয় দেশ, চীন-রাশিয়ার বার্ষিক সামরিক সহযোগিতার সময়সূচীর অংশ হিসাবে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ব্লক এবং জাপানের রক্তচাপ বাড়িয়ে আকাশপথে তাদের ষষ্ঠ যৌথ বিমান কৌশলগত বায়বীয় টহল পরিচালনা করেছে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা বানাতে চায়, তবে তার উচিত বিশ্বের প্রতিটি কোণায় নাক গলানো থেকে বিরত থাকা এবং ‘সার্বভৌমত্ব’ কাকে বলে তা শেখা ও তাকে সম্মান করা। এতদিন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার অধিকারে সারা বিশ্বে একের পর এক যুদ্ধ চালাচ্ছিল আমেরিকা, আজ তার সাথে পাঞ্জা লড়তে একটি আর্থিক ভাবে সাবলীল রাষ্ট্র দেখে তার এত ভয় হচ্ছে কেন?

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে, বিশেষ করে ইউক্রেনকে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করার পরে, বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে সোচ্চারভাবে ওকালতি শুরু হওয়ার পরে, হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগন উন্মাদের মতন আচরণ করছে। খুব ভালোভাবে জেনেও যে তার বিশাল সামরিক বাজেট এবং যুদ্ধবিগ্রহ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কোনো সুবিধা দেবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বকে প্রতারণা করার জন্য শান্তিপ্রিয় সন্ন্যাসীর পোশাকে অবতীর্ণ হয়েছে।

শুধুমাত্র সময়ই দেখাতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আক্রান্ত হওয়ার খেলার নতুন কৌশল ব্যবহার করে তার হারানো কোনো অঞ্চল ফিরে পাবে কিনা। যাইহোক, এর কৌশল থেকে যা স্পষ্ট তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বহুমেরুর বিশ্বের দাবিকে ভয় পায়। নিজের আধিপত্য রক্ষার জন্য যে কোন পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারে এবং ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla