শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দক্ষিণ দিল্লীর সাংসদ রমেশ বিধুরি নতুন সংসদ ভবনে বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) সাংসদ দানিশ আলীকে তাঁর ধর্মীয় পরিচয় তুলে গালাগাল করার পর থেকে দেশের রাজনীতির প্রাঙ্গনে এক নতুন উদ্দম নৃত্য শুরু হয়েছে। একদিকে বিরোধীরা তারস্বরে বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তি নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, অন্যদিকে বিজেপি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ও লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে।
বিরোধীদের অভিযোগ যে দক্ষিণ দিল্লীর কুখ্যাত সাংসদ বিধুরি নতুন সংসদ ভবনে এসে যেটা করেছেন তা সংসদীয় গরিমা নষ্ট করেছে। আবার অনেকের মতে এই কর্মকান্ডের বর্তমানে বিজেপি যতই নিন্দা করুক দলের মধ্যে বহমান ইসলামবিদ্বেষে বলীয়ান হয়েই দক্ষিণ দিল্লীর বাহুবলী সাংসদ আলী কে অশালীন কথাবার্তা বলতে পেরেছেন। কিন্তু ঘটনাটি এত সরল নয়। আলী হতবাক হলেও ভারতে বাস করা অধিকাংশ মুসলিমের জীবনে এই রকম আক্রমণ মোটেই নতুন নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুসলিম গণহত্যার ঘটনায় বিচারপ্রার্থী, ওই গণহত্যায় নিহত প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির বিধবা জাকিয়া জাফরি অভিযোগ করেছিলেন যে যখন তাঁদের সোসাইটিকে ঘিরে ধরেছিল উন্মক্ত গেরুয়া সন্ত্রাসীরা তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কাতর আবেদন করেছিলেন নিহত সাংসদ। তাঁর টেলিফোন পেয়েই মোদী নাকি জাফরি কে অশালীন ভাষায় তাঁর ধর্ম তুলে গালাগালি করেন ও বলেন যে তিনি অবাক হয়েছেন যে জাফরি তখনো জীবিত।
বিচারের বাণী যেহেতু নীরবে নিভৃতে কাঁদে, তাই ন্যায় কাকে বলে সেটা এখনো জাকিয়া দেখতে পারেননি। তাঁর স্বামীর হত্যার অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরাই নাকি আজ দেশের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন এবং দেশের সমস্ত ধরণের প্রতিষ্ঠানের উপরই তাঁদের নাকি অতি-সাংবিধানিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু তাঁর এই অভিযোগ কিন্তু অল্প হলেও বুঝতে সাহায্য করে যে কিসের ভিত্তিতে একজন নির্বাচিত সাংসদ কে সংসদ ভবনের ভিতরে অশালীন ভাষায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করতে সাহস পান বিধুরির মতন রাজনীতিবিদেরা।
মুসলিমদের ধর্ম নিয়ে কটূক্তির শীর্ষে বিজেপি
বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সংসদীয় গণসংগঠন বিজেপি সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নেতা ও কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে আসছেন। বিজেপি শাসিত নানা রাজ্যে আরএসএস-র সাথে যুক্ত সংগঠনের লোকেদের আক্রমণে নানা জায়গায় গত আট বছরে অসংখ্য মুসলিম প্রাণ হারিয়েছেন। বারবার নানা ধরণের উত্তর ভারতীয় হিন্দু উৎসব পালনের নামে মুসলিমদের উপর নেমে এসেছে ভয়ানক আক্রমণ। বাদ যায়নি রাজধানী দিল্লীও, যেখানে ২০২০ সালের ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যায় নিহত হন সরকারি হিসাবে ৫৩ জন।
নুপুর শর্মা কান্ড
২০২২ সালে হঠাৎ একদিন টেলিভিশনে একটি বিতর্ক চলার সময় বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মা ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে কটূক্তি করেন যা ভারতে ও বিদেশে মুসলিমদের ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। যদিও ভারতের ও বিদেশের মুসলিমেরা ভারতীয় মুসলিমদের উপর ২০১৫ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে চালিত নৃশংস অত্যাচার নিয়ে খুব একটা সোচ্চার হননা, নবীর অসম্মানের ঘটনায় কিন্তু সবাই ধর্মের নামে তেড়ে ফুঁড়ে ওঠেন।
গোটা ইসলামিক বিশ্বের থেকে, যেখানে মোদী সরকার নিজের প্রতিপত্তি বাড়িয়ে চীন কে ঠেকাতে চাইছে, শর্মার নবী কে নিয়ে করা কটূক্তির বিরোধিতার ঝড় উঠতে দেখে বিজেপি প্রমাদ গোনে। যদিও শর্মার বিরুদ্ধে সরকার কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়না অন্য ধর্মের অসম্মান করার অভিযোগে, তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। তবে তাতে শর্মার প্রতিপত্তি খর্ব হয়নি স্বাভাবিক কারণেই, এবং তিনি হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর থেকে সমর্থন পান তাঁর কর্মকান্ডের জন্যে।
বিজেপি সংসদ পারভেশ ভার্মা
শর্মার ঘটনার রেশ কাটার আগেই, দিল্লীর এক প্রয়াত বিজেপি নেতা সাহিব সিংহ ভার্মার পুত্র, সাংসদ পারভেশ ভার্মা ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে দিলশাদ গার্ডেনে আরএসএস-র শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি সভায় যোগ দেন। সেই সভায় তিনি মুসলিম সম্প্রদায় কে বয়কট করার ডাক দেন হিন্দুদের। এহেন সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের পরেও ভার্মা বিজেপির কাছে একজন সম্পদ।
তবে ভার্মার জীবনে এই প্রথম ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এর আগেও তিনি ২০২০ সালে দিল্লীর শাহীনবাগ ও অন্যান্য অঞ্চলে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) ও নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী মুসলিমদের অবস্থান কে কটাক্ষ করে ডাক দেন “দেশ কে গদ্দারো কো, গোলি মারো সালো কো” (দেশের বিশ্বাসঘাতকদের, গুলি করো শালাদের), যা মুসলিমদের দেশ-বিরোধী হিসাবে তুলে ধরে এবং এর পরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠিত দিল্লীর মুসলিম গণহত্যায় এই স্লোগান বারবার তোলে নানা ধরণের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।
এই ঘটনায় ভার্মার সাথে যোগ দেন হিমাচল প্রদেশের বিত্তশালী পরিবার থেকে বিজেপির সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া অনুরাগ ঠাকুরও। তিনিও বারবার এই “গোলি মারো” স্লোগান তুলে দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের আগে জনগণ কে তাঁতিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করে যান। বিজেপির কাছে এক নিমেষেই ‘নায়ক’ হয়ে যান এই দুই কিংবদন্তি মুসলিম-বিদ্বেষী সাংসদ।
অন্যান্য বিজেপি নেতা ও সাংসদেরা
বিজেপির অন্যান্য ‘তারকা’ সাংসদেরাও মুসলিম-বিরোধী, ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন ক্রমাগত। যদিও তাঁরা সরাসরি সংসদ ভবনের মধ্যে বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তির মতন কিছু করেননি। তবে বিজেপির মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করে যে রকম ভাবে খ্যাতি পাওয়া যায়, তার ফলে এটাকেই সাফল্যের সোপান হিসাবে বেছে নেন বিজেপির নেতারা।
সাক্ষী মহারাজ নামক বিজেপির এক সাংসদ চিরকাল মুসলিম-বিরোধী মন্তব্য করে খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন। কখনো গো-হত্যা নিয়ে তো কখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে তিনি মুসলিমদের নিশানা করেছিলেন। ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁর করা ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্যে তৎকালীন সমাজবাদী পার্টির সরকারের তরফ থেকে মামলাও করা হয়।
উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোরক্ষপুরের সাংসদ থাকাকালীন শুধু ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেননি, বরং কংগ্রেসের শাসনকালে তিনি গোরক্ষপুরে এক বড় মাত্রার মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক হিংসার চালকের আসনে বসেন বলে অভিযোগ করা হয়। তাঁর এই ভূমিকার জন্যেই তাঁকে ভারতের সর্বাধিক জনসংখ্যার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন বিরোধীরা।
হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী ঘটনায় অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞা কে মোদী সরকার গঠনের পর যেমন জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) একদিকে ক্লিনচিট দিয়ে তাঁর উপর মামলা লঘু করে দেয়, তেমনি তাঁকে লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দিয়ে বিজেপি জাহির করেছিল যে মুসলিম-বিরোধী মুখ হিসাবেই তাঁকে সংসদে দরকার গেরুয়া শিবিরের। প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন মোহনদাস গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কে মহিমান্বিত করেছিলেন, যার নিন্দা সেই সময় প্রধানমন্ত্রীও করেন, কিন্তু তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তির পরে কি এই পর্বের সমাপ্তি হবে?
১৭তম লোকসভার কার্যকাল প্রায় শেষের মুখে। ২০২৪ সালে আবার সাধারণ নির্বাচন হবে। আর তখন কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যাবে যে বিজেপি এই সব ইসলামবিদ্বেষী কথাবার্তা বলা লোকেদের পুনরায় মনোনয়ন দিচ্ছে। এর কারণ হল সারা দেশে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর, বিশেষ করে খাদ্যবস্তু ও জ্বালানির, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেহাল দশা এবং সরকারের বেড়ে চলা ঋণের বোঝার কারণে বিজেপির কাছে ধর্মীয় মেরুকরণ ছাড়া নির্বাচনে জেতার আর কোনো পথ খোলা নেই।
এ ছাড়াও যেহেতু বিরোধী দলগুলির অধিকাংশ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স বা ইন্ডিয়া জোট গঠন করেছে, তাই বিজেপি-বিরোধী ভোট নানা রাজ্যে ভাগ না হতে পারে। ফলে বিজেপির পক্ষে নিজের জেতা আসন ধরে রাখা মুশকিল হবে যদি না ধর্মীয় মেরুকরণ তীব্র মাত্রায় করা হয়।
এর মধ্যে ইন্ডিয়া জোটের অধিকাংশ দল কিন্তু জাত গণনার পক্ষে সায় দেওয়ায় বিজেপি চরম বিপদে পড়েছে। কারণ এর ফলে বিজেপির অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির (ওবিসি) ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে পারে। আর এই ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক বিজেপির পক্ষে জরুরী তাই সেটা রক্ষা করতে বিজেপিকে বারবার হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী প্রচার কে তুঙ্গে তুলতে হবে। ফলে বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তি এই সব ক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে।
তবে অন্যদিকে মোদী বিজেপিকে বারবার মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাতে পাসমান্দা বা দলিত ও ওবিসি মুসলিমদের কাছে টানার পক্ষে ওকালতি করেছেন। এই ক্ষেত্রে বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তি, যা একজন পাসমান্দা মুসলিমকে লক্ষ্য করে করা হয়েছিল হিতে বিপরীত ফল দিতে পারে। কিন্তু ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক কে বিজেপি যদি হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের ফাঁদে আটকে রাখতে সক্ষম হয় তাহলে মুসলিম ভোট চলে গেলেও গেরুয়া শিবিরের কোনো ক্ষতি হবে না কারণ দেশের ১৪% মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক সার্বিক নির্বাচনী ফলাফল কে প্রভাবিত করতে পারবে না।
ফলে আগামী বছর হতে চলা সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরেও কোনো ভাবেই বিধুরির ইসলামবিদ্বেষী কটূক্তির মতন ঘটনা কমবে না বরং ভোটব্যাঙ্কের তাগিদে বিজেপিকে এহেন আচরণ কে আরও বেশি করে প্রশ্রয় দিতে হবে, যা দেশের প্রান্তিক মুসলিমদের জন্যে আরও বেশি দুর্দশা আগামী দিনে ডেকে আনতে পারে।