পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের মুখ্য শরিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] বর্তমানে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। সিপিআই (এম) এর রাজনৈতিক সঙ্কট ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে শুরু হলেও, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে সেই সঙ্কট অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক ভাবে নিজেকে পুনর্জীবিত করার জায়গায় সিপিআই (এম) একই ভ্রান্ত প্রক্রিয়ায় লিপ্ত থেকে এই সঙ্কট কে ঘনীভূত করে চলেছে।
কলকাতা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) ও এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) গত ১৯ মাস ধরে কয়লা ও গরু পাচার এবং স্কুল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, সিপিআই (এম) সেই মামলাগুলোকেই নিজের রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে এবং এর বাইরে নিজের রাজনৈতিক গতিবিধিকে চরম ভাবে রাজ্যে নিয়ন্ত্রিত করেছে। তবে সিপিআই (এম)-র এই তদন্ত-নির্ভর ও কেন্দ্রীয় এজেন্সি-নির্ভর কার্যকলাপে দলটির রাজনৈতিক সঙ্কট মোচন হয়নি, বরং তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচনের তথ্য সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।
বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বা সাম্প্রতিক ধূপগুরি বিধানসভা উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট ভাল ফল করতে পারেনি। সিপিআই (এম) এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসন নিয়ে গলা ফাটলেও নির্বাচনের ফলাফল দেখাচ্ছে যে রাজ্যের ভোটাররা বামেদের কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান বিপক্ষ হিসাবে স্বীকার করেনি। বরং তাঁরা সেই জায়গায় বেছে নিয়েছেন ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি)। এর ফলে, কংগ্রেসের সাথে জোট করা বামেরা পিছনের সারিতেই রয়ে গেছে, এগিয়ে যেতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বামেদের সঙ্কট দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বড়ই বিপদজনক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। যদিও বামফ্রন্টের বৃহৎ শরিক দলের রাজ্য নেতৃত্বের কথায় তাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক লাইনটি, যে লাইন অনুসারে তাঁরা বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস কে একই পংক্তিতে বসিয়ে দুই পক্ষেরই বিরোধিতা করে, যার মধ্যে বিজেপির বিরোধিতা কম আর তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা বেশি থাকে, সবচেয়ে সঠিক অবস্থান। তবে এই সঠিক অবস্থান কেন তাঁদের ভোট বাড়াচ্ছে না সেই নিয়ে দলের তরফ থেকে কোনো মন্তব্যই করা হয়নি।
কিন্তু এই দুর্নীতির বিষয়ে মজে থেকে সিপিআই (এম) কিন্তু রাজ্যের ব্যাপক শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর সম্ভাব্য আন্দোলনগুলোতে নজর দেয়নি। ফলে সেই জায়গায় কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর মধ্যে নিজের প্রভাব কে অক্ষুন্ন রাখতে সফল হয়েছে। অন্যদিকে সিপিআই (এম) এর প্রস্তুত করা দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন, প্রভৃতির থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। তাই পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) রাজনৈতিক ভাবে আরও প্রান্তিক হয়েছে আর তার ফলে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতি হয়েছে বামফ্রন্টেরও।
কোথায় ভুল সিপিআই (এম) এর?
(১) শ্রেণীর থেকে বিচ্ছিন্নতা
সিপিআই (এম) কয়লা ও গরু পাচার বা স্কুল শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি কে নিয়ে বেশি গলা চড়ালেও, রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষদের ব্যাপক অংশ কে আকর্ষিত করার জন্যে কোনো ধরণের পরিকল্পনা সামনে রাখেনি। ফলে রাজ্যের থেকে প্রতিনিয়ত কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সাথে সিপিআই (এম) দলটির কোনো সংযোগ থাকছে না। রাজ্যেও অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মেহনতি মানুষের সাথে দলটির বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে।
এই কারণে, বাইরের রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমজীবীদের একটা বড় অংশকে যেমন নানা ধরণের শোষণ, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, প্রভৃতির সাথে নিজেদের শক্তিতেই লড়তে হচ্ছে, কারণ বামপন্থীদের সাথে তাঁদের যোগসূত্র আর নেই, তেমনি গুজরাট, উত্তর প্রদেশ ও দিল্লী-এনসিআর অঞ্চলে এদের কে বিজেপির পৈতৃক সংগঠন ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের জনক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-র সাথে যুক্ত সংগঠনগুলো ইসলামবিদ্বেষী তাস খেলে নিজেদের দলে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই শ্রমজীবী মানুষদের, প্রান্তিক মানুষদের একটা বড় অংশ রাজ্যে ফ্যাসিস্ট শক্তির লেঠেল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
শহর থেকে গ্রামে ফেরার পরে, বা পশ্চিমবঙ্গে ফেরত আসার পরে, এই শ্রেণীর একটি বড় অংশই আরএসএস-র অধীনে কাজ করা শুরু করে। বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট কর্মসূচীতে এরা অংশগ্রহণ করছে। অথচ যদি সিপিআই (এম) ও অন্য বামদল গুলো একসাথে প্রয়াস করে এই শ্রমজীবী মানুষের অন্য রাজ্যে যাওয়া আটকাতে পারতো রাজ্যে তাঁদের জীবিকার দাবি নিয়ে আন্দোলন কে তীব্র করে, তাহলে কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ অন্য খাতে বইতো। কিন্তু সেই কাজ করতে তাঁরা হয় ব্যর্থ হয়েছেন না হয় অনিচ্ছুক থেকেছেন। কোথাও গ্রামের কৃষিতে আয় বৃদ্ধি করার, সেচের বন্দোবস্ত করা এবং ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করার দাবিতে আন্দোলনও তাঁরা গড়ে তোলেননি।
এই সব উপেক্ষা করে যে শ্রেণীর সমর্থনের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট ও বাম শক্তি পশ্চিমবঙ্গে আবার নিজের মাটি খুঁজে পেতে পারতো, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বামফ্রন্ট। ফলে, এই শ্রেণীগুলোর উপর এখন দক্ষিণপন্থী তৃণমূল কংগ্রেস আর ফ্যাসিস্ট বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে চূড়ান্ত হারে। ফলে কাদের ভিত্তিতে সিপিআই (এম) ক্ষমতায় ফিরতে চায় সেই প্রশ্নটা আবার বড় করে সামনে এসেছে? দলটি কি নিজেকে শ্রমিক-কৃষকের দল মনে করে না কি শুধুই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি মনে করে, সেই প্রশ্নটাও বড় ভাবে উঠে এসেছে।
(২) মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিকতা
সিপিআই (এম) গত শতকের নয়ের দশক থেকেই মেহনতি মানুষের ওকালতি বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত তোষণে ব্যস্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে দলটির শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সংগঠন নড়বড়ে হয়ে যায় এবং মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিক একটি বাবু পার্টিতে পরিণত হয়। এর সাথে সাথেই কিন্তু রাজ্যের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে —দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে—সিপিআই (এম)-র দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে দলটির ভিত হয় শহুরে সাবর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত, যাদের সাথে রাজ্যের আপামর খেটে খাওয়া মানুষের কোনো সম্পর্কই নেই।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, বিশেষ করে ২০০৬-১১ পর্বে, শ্রেণীর থেকে বিচ্ছিন্নতা, শ্রমিকদের জঙ্গী আন্দোলনে ছেদ টানা এবং বলপূর্বক কৃষি জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে সিপিআই (এম) যেমন শ্রমজীবীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিক হয়ে পরে, তেমনি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সিপিআই (এম)-র তৈরি করা শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে ও রাজ্যের শ্রমিক-কৃষক রাজনীতিকে ডান দিকে পরিচালনা করা শুরু করে।
যদিও সিপিআই (এম) ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে অনেকে ভেবেছিলেন যে তাঁদের নেতৃত্ব নিজেদের শ্রেণীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভুল স্বীকার করবেন এবং শিকড় কে আঁকড়ে ধরে নতুন ভাবে দলটিকে পুনর্জীবিত করবেন। কিন্তু সে আশা গুড়ে বালিতে পরিণত হয়েছিল, কারণ সিপিআই (এম) নেতৃত্ব প্রথমত মেনেই নিতে পারেননি যে তাঁরা ক্ষমতায় নেই, আর দ্বিতীয়ত, এই কারণে নিজেদের পুরানো দম্ভ তাঁরা ত্যাগ করেননি।
যদিও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরিত্র হল সর্বদা শাসকদলের দিকে ঝুঁকে থাকা, নিজ স্বার্থ আদায়ের জন্যে, তাও সিপিআই (এম) দুর্নীতি-বিরোধিতার মতন মধ্যবিত্ত-সুলভ রাজনৈতিক আন্দোলনে নিজেদের আটকে রাখে, যার ফলে যে জনমত তৈরি হয় সেটাকে কাজে লাগায় বিজেপি। ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনুভূতি কে প্রভাবিত করলেও, এর ফল সবসময় ভোগ করে ফ্যাসিস্ট শক্তি।
বিশ্বের নানা দেশেই—এবং ভারতেও—দুর্নীতি-মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে অতি-দক্ষিণপন্থীরা, আর তাদের আসার রাস্তা প্রশস্ত করতে নিজ শ্রেণী কে বাদ দিয়ে সিপিআই (এম) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকে। সিঙ্গুরে টাটার কারখানা খোলার মতন পুরানো বস্তা পঁচা কর্মসূচী নিয়ে বারবার নির্বাচনে পরাস্ত হয়েও দলটির হুশ আসেনি।
(৩) শত্রু ও মিত্র চেনার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি
সিপিআই (এম) রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের মতন একটি অসংগঠিত, লুম্পেন বাহিনীর সাথে আরএসএস-বিজেপির মতন সুসংহত ও সংগঠিত ফ্যাসিস্ট শক্তিকে একই পংক্তিতে বসিয়ে, এবং শুধুই তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির ভাষায় আক্রমণ করে বন্দোপাধ্যায় আর বিজেপির লাভ করে দিয়েছে। মাঝখানে, এর ফলে সিপিআই (এম) সহ সম্পূর্ণ বামফ্রন্টের জনপ্রতিনিধির সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে।
সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের সংখ্যা শূন্য হয়ে যাওয়া মানে আইনসভার ভিতরে শ্রমিক ও কৃষকের দাবি নিয়ে লড়াই করার কেউ না থাকা। এর ফলে কিন্তু চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ। বিজেপি সরকার একের পর এক শ্রমিক-বিরোধী ও কর্পোরেট-বান্ধব নীতি লাগু করতে পারছে সংসদে বিনা বাঁধায় কারণ বাম শক্তি সেখানে নগন্য। অথচ সেই বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ না রেখে কয়েক হাজার মধ্যবিত্ত সরকারি চাকরীপ্রার্থীদের, যাঁরা চাকরী পেয়ে শাসকদলেরই কাজ করবে, স্বার্থে সিপিআই (এম) নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে।
একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস যখন রাজ্যের বকেয়া টাকার দাবিতে, শ্রমজীবী মানুষের ১০০-দিনের কাজের টাকার দাবিতে রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, যখন তাঁরা সদলবলে দিল্লী গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে, পুলিশের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে, তখন অন্যদিকে এই গরিব মানুষের দাবিকে খর্ব করে সিপিআই (এম) বিজেপির ভাষায় বন্দোপাধ্যায়ের সরকার ও ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দোপাধ্যায় কে আক্রমণ করছে। তাঁরা দিল্লী যাওয়া কৃষকদের নিয়ে খিল্লি করছে ও এই ভাবে নিজের বন্ধু শক্তির থেকে নিজের দূরত্ব বৃদ্ধি করছে।
এর ফলে সহজেই তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করতে পারছে যে সিপিআই (এম) বিজেপির হাতে তামাক খাচ্ছে। এর অভিযোগের সাথে যখন গরিব মানুষেরা দেখছেন যে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের দাবিতে আন্দোলন করছে, তাঁদের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাজধানী দিল্লী গিয়ে পুলিশের দমনপীড়ন সহ্য করছে, অন্যদিকে সিপিআই (এম) পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে শুধু তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতারের দাবি তুলতে মিছিল করছে, তখন তাঁদের মধ্যেও বামেদের প্রতি আক্রোশ বাড়ছে।
একদিকে যখন ইউনিয়ান সরকারের পশ্চিমবঙ্গকে তার বকেয়া টাকা—বিশেষ করে ১০০-দিনের কাজের পারিশ্রমিক—দিচ্ছে না, তখন তাঁদের বকেয়া টাকার দাবির আন্দোলনে আর রাজভবন ঘেরাও কর্মসূচীতে শ্রমজীবী ও বঞ্চিত মানুষ কিন্তু লাল ঝান্ডা কে দেখছেন না, দেখছেন তৃণমূল কংগ্রেস কে। যার ফলে তাঁদের একটা বড় অংশই এখন তৃণমূলের সাথে থাকছেন। এর ফলে সিপিআই (এম) ও তার সাথে বামফ্রন্ট জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ও তার শত্রুরা শক্তিশালী হচ্ছে।
অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধী গরিবেরা নানা কারণে কিন্তু বিজেপিকেই বেছে নিচ্ছেন কারণ গ্রামে-গঞ্জে তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণ থেকে প্রতিহত করার মতন যথেষ্ট পেশিশক্তি গেরুয়া বাহিনীরই রয়েছে। প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী কে রুখে দিতে সার্বিক ভাবে সিপিআই (এম) ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সেখানেও প্রধান বিরুধী হিসাবে উঠে আসতে সিপিআই (এম) ব্যর্থ হয়েছে। এই শূন্যতা ভরাট করেছে বিজেপি। বামেদের সরিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা এখন রাজ্যের পরিষদীয় ক্ষেত্রেও প্রধান বিরোধীর জায়গায়।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেও দেখা গেছিল যে রাজ্যে একটি বিজেপি-বিরোধী মেরুকরণ হয়েছিল যার লাভ তোলে তৃণমূল কংগ্রেস। যে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যের জনমত শক্তিশালী, সেই বিজেপি কে রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে আড়াল করে, তারই ভাষায় ও পদ্ধতিতে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস কে আক্রমণ করে এবং বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের গোপন আঁতাতের অভিযোগ, যা ২০২১ সালেও রাজ্যের জনগণ মেনে নেননি, তুলে দুই দল কে এক করে দেখানোর প্রচেষ্টার ফলে মূল শত্রু কে সেটাই সিপিআই (এম)-র গুলিয়ে গেছে। আর এর ফলে প্রতিটি নির্বাচনেই খেসারৎ দিতে হচ্ছে সিপিআই (এম) ও বামফ্রন্ট কে।
সিপিআই (এম)-র কী করণীয় ছিল?
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস শুধু রিগিং করে বা ভোট লুঠ করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখেনি। বন্দোপাধ্যায়ের সরকার টিকে আছে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রকল্পগুলো কে কাজে লাগিয়ে, সন্তপর্নে সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিজেপির জূজূ দেখিয়ে।
তৃণমূল কংগ্রেস কে নির্বাচনে হারাতে সিপিআই (এম) ও বামফ্রন্টের দরকার আরও বেশি করে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো নিয়ে আন্দোলন করা, সেগুলোর সুবিধা বৃদ্ধির দাবি করা, বিভিন্ন ভাতার অঙ্ক বৃদ্ধি করার দাবি করা ও এর সাথে সাথে রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের অন্য রাজ্যে যাওয়া আটকাতে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করতে ব্যাপক পরিকাঠামো গড়ার ও কৃষি পণ্যের জন্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দাবি করার দরকার আছে।
এর সাথেই, রাজ্যের প্রতি ইউনিয়ন সরকারের বঞ্চনা নিয়ে যে আন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেস নিজের স্বার্থে করছে, বামেদের উচিত ছিল সেই আন্দোলন নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলে দিল্লীর রাস্তায় সেটিকে সংগঠিত করা ও সেই আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবী মানুষের, গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে নিজের ভিত মজবুত করা। তাঁদের বোঝানো যে তাঁদের স্বার্থে বামেরাই লড়ছে।
রাজ্যের বন্ধ কারখানা খোলার দাবির চেয়েও বেশি করে বর্তমানে চলমান কারখানাগুলোয় পূর্ণ সময়ের শ্রমিক নিয়োগ, রাজ্যে ভূমিপুত্রদের সংরক্ষণ—এমনকি বেসরকারি ক্ষেত্রেও—ও শ্রমজীবী মানুষের যে অংশটি কৃত্রিম মেধা ও অন্য ধরণের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্যে কাজ হারাবেন, তাঁদের জন্যে সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে কারিগরী প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করাও বামেদের উচিত। এর ফলে বর্তমান শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সকল ধরণের আন্দোলনে, সে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হোক বা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন হোক, বামেদের সবচেয়ে আগুয়ান হতে হবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে বারবার তাঁদের শ্রেণীর প্রশ্নটি, জীবন ও জীবিকার প্রশ্নটি সামনে আনতে হবে ও রাজ্যের গরিব মানুষকে আরএসএস ও বিজেপির প্রভাব থেকে মুক্ত করার অবিরাম প্রচেষ্টা করতে হবে।
রাজ্যজুড়ে বন্দোপাধ্যায়ের সরকার যে মোদী সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) তৈরি করার জন্যে জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জী (এনপিআর) আপডেট করছে নানা ভাবে আর এর ফলে যে রাজ্যে বসবাস করা কয়েক কোটি উদ্বাস্তু মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই নমঃশূদ্র – মতুয়া সম্প্রদায়ের, বেনাগরিক হয়ে যাবেন, সেই নিয়ে প্রচার চালানো ও নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলন চালানোর কাজেও বামফ্রন্টকে এগিয়ে আসতে হবে। এই উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশ হল বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক, তাই তাঁদের সামনে সত্যটা তুলে ধরতে পারলে এবং তাঁদের আসন্ন বিপদ নিয়ে তাঁদের সচেতন করতে পারলে কিন্তু আখেরে গেরুয়া বাহিনীর ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে বাধ্য।
সিপিআই (এম) কি ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেবে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে সিপিআই (এম) যখন পশ্চিমবঙ্গে কোনো ধরণের বিজেপি-বিরোধী আন্দোলনে নেই এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকেও বিধানসভা নির্বাচন গণ্য করে শুধুই তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছে, তখন এই দলটির রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ সিপিআই (এম)-র অত্যাধিক তৃণমূল কংগ্রেস ফেটিশের কারণে সুবিধা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসেরই।
যখন রাজধানী দিল্লীতে উগ্র চীন-বিরোধিতার ধুঁয়ো তুলে মোদী সরকার সিপিআই (এম)-ঘনিষ্ঠ নিউজক্লিক পোর্টালের অফিসে হামলা করলো, সিপিআই (এম) সদস্য ও পোর্টালের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান অমিত চক্রবর্তীকে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিষেধক) [ইউএপিএ] আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হল, এমনকি সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির দিল্লীর সরকারি বাসভবনেও পুলিশ হানা দিল, তখনও পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই (এম) রাস্তায় নামলো না।
বরং দেশের অন্য প্রান্তে বামেরা বিজেপির বিরুদ্ধে, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো কে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মুখ বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেও, পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলে মিছিল করে আসলে বিজেপির হাত যেমন শক্ত করলো, তেমনি রাজভবন ঘেরাও থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের রাশও তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে নির্দ্বিধায় তুলে দিল।
এই ঘটনাগুলো ইঙ্গিত করছে যে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) বামফ্রন্ট কে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাঁড় করাতে এই জোটের সর্ববৃহৎ দল হিসাবে শুধু অপারগই নয় বরং অনিচ্ছুকও। এর ফলে কী ভাবে রাজ্যের রাজনীতিতে সিপিআই (এম) বামফ্রন্টের হারানো জমি ফিরে পাবে সেই প্রশ্ন আবার বড় ভাবে দেখা দিচ্ছে।
কুপমুণ্ডুকতার রাজনীতি যে বাম আন্দোলনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে ও বিজেপির মতন ফ্যাসিবাদী শক্তি কে না রুখতে পারলে যে আগামী দিনে মূলস্রোতের বাম রাজনীতির কোনো সুযোগই দেশে থাকবে না, সে কথা সিপিআই (এম) নেতৃত্ব বোঝেন না তা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় রাজনীতির স্বার্থে যখন দেশের সর্ববৃহৎ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে সিপিআই (এম)-র মতন বাম দল ফ্রি পাস দেয়, তখন তার রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক।