লোকসভা নির্বাচনের আগে ভেঙে যাওয়া মতুয়া উদ্বাস্তু ভোটব্যাঙ্ক কে জোড়া লাগাতে আবার মিথ্যার বেসাতি নিয়ে কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাজারে এসেছে? সম্প্রতি মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব নিয়ে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী অজয় কুমার মিশ্র (টেনি)। এই মন্তব্যের জেরে এখন বিজেপি আবার পশ্চিমবঙ্গে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে সম্প্রদায়ের ভোটের মেরুকরণ করার চেষ্টা করবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী ও বনগাঁ সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মতুয়া উদ্বাস্তুরা সারা ভারতে যেখানে খুশি থাকতে পারেন, কাজ করতে পারেন বলে জানান টেনি। এর সাথেই তিনি জানান যে মোদী সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯), যা ২০২০ সালের ১০ই জানুয়ারি থেকে প্রণয়ন করা হয়, ব্যবহার করে মতুয়া সম্প্রদায় কে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে বদ্ধপরিকর। টেনির এই দুইটি দাবিকে কেন্দ্র করেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে যাতে তাঁকে দলের বিধায়কেরই কোপে পড়তে হয়েছে। 

মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব নিয়ে কী বললেন টেনি?

রাস পূর্ণিমার উৎসব উপলক্ষে রবিবার, ২৬শে নভেম্বর, উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন টেনি। সেখানে তিনি বলেন, “২০২০ সালের ১০ই জানুয়ারি সিএএ (২০১৯) চালু হয়ে গিয়েছে। নিয়ম-কানুন তৈরি হচ্ছে। কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। আমরা (কেন্দ্রীয় সরকার) সেই সব সমাধানের চেষ্টা করছি। তা ছাড়া বিরোধী দল ও বিরোধী মনোভাবাপন্ন লোকজন সিএএ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন। শুনানি আছে ৬ই ডিসেম্বর। আপনাদের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, শীঘ্রই আমরা নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু করবো”।

এখন টেনি’র এই মন্তব্যের মধ্যেও অসংখ্য মিথ্যা লুকিয়ে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরীর আন্দোলনরত কৃষকদের হত্যার ঘটনার মুখ্য অভিযুক্ত, তাঁর পুত্র আশীষ মিশ্র কে আইনের হাত থেকে নিজের প্রভাব ব্যবহার করে বাঁচানোর ঘটনায় অভিযুক্ত টেনি যে মিথ্যাগুলো বলছেন সেগুলো মতুয়াদের ২০১৯ সাল থেকে ক্রমাগত শুনিয়ে এসেছেন তাঁর দফতরের মন্ত্রী অমিত শাহ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গো-হারা হারার পরে শাহ আর মতুয়াদের নিজে প্রতিশ্রুতি দেননা, ফলে সেই কাজ এখন টেনিদের দিয়ে করাচ্ছেন। 

প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকার যদি মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তাহলে আইনের নিয়মাবলী বার করা হয়নি কেন? আর যদি চার বছরে সরকার নিয়মাবলী প্রকাশ করতে ভয় পায়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে এই আইনে কোনো ভাবেই কোনো মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। 

দ্বিতীয়ত, যদি বিরোধীদের মামলার উপরই প্রতিমন্ত্রী দোষ দেন, তাহলে ঘটনা হল কেন্দ্রীয় আইনে সুপ্রিম কোর্ট কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি বা স্টে অর্ডার দেয়নি। ফলে চার বছরে মামলার জন্যে আইন প্রণয়ন করা যাচ্ছে না বলাটাও একটি মিথ্যা কথা। 

তৃতীয়ত, তিনি বলেছেন শীঘ্রই নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু হবে। এই শীঘ্রই কথাটাও শাহ দীর্ঘদিন শুনিয়ে এসেছেন। কিন্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো কাজই হয়নি। কিন্তু ২০১৫ সালের পাসপোর্ট ও বিদেশী আইনের নিয়মাবলীর সংস্কারের মাধ্যমে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বেশ কিছু আইনত স্বীকৃত শরণার্থী পরিবার কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। ফলে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে যদি সত্যিই সরকারের কোনো সদিচ্ছা থাকতো তাহলে সেই তালিকায় তাঁদের জোড়ার জন্যে একটি নিঃশর্ত নাগরিকত্বের আইন প্রণয়ন করা যেত। 

মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র 

দীর্ঘদিন ধরে ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন মতুয়া মহাসঙ্ঘ ৮৫ টাকার বিনিময়ে উদ্বাস্তু মতুয়াদের কাছে একটি পরিচয়পত্র বিলি করছে যাতে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রীর সই থাকছে সঙ্ঘের প্রধান হিসাবে। বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ঠাকুর দাবি করে আসছেন যে মতুয়াদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কাজে এই পরিচয়পত্র অনেক কাজে আসবে। এবার এই প্রচারে হাওয়া দিলেন টেনি। 

“নাগরিকত্ব না পাওয়ার কারণে আপনাদের আধার কার্ড নেই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কেন্দ্রের আয়ুষ্মান কার্ড নেই। আপনারা কেন্দ্রের অনেক প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমি শুনলাম, আপনারা যাত্রা করতে ঘাবড়ে যাচ্ছেন। আমি বলে যেতে চাই, আপনাদের দিকে আঙুল উঠবে না। শান্তনু ঠাকুর যে কার্ড আপনাদের দিচ্ছেন সেই কার্ড নিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারেন, ওই কার্ড আপনাদের সারা দেশে ঘোরার জন্যে পর্যাপ্ত”, টেনি বলেন। 

টেনির বক্তব্যের সমর্থনে ঠাকুর বলেন, “মন্ত্রীর এ কথা বলার উদ্দেশ্য, যত ক্ষণ না আমরা নাগরিকত্ব পাচ্ছি, তত ক্ষণ পর্যন্ত মতুয়াদের পরিচয়হানি হচ্ছে। জিআরপি (রাজ্য সরকারের রেল পুলিশ), ডিআইবি (গোয়েন্দা বিভাগ) হেনস্থা করছে। অনেক জায়গায় মতুয়াদের সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের মাধ্যমে মতুয়াদের পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। কার্ড দেখলে সকলেই বুঝতে পারবেন এঁদের জন্যে সিএএ চালু হয়েছে।”

এর সাথে আবার ঠাকুর রাজ্য সরকার যে সিএএ চালু না হওয়ার জন্যে দোষী সাব্যস্ত করেন। “রাজ্য সরকার শুইয়ে সিএএ কার্যকর হতে দিচ্ছে না তাই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে এই কার্ডের মান্যতা দিতে হচ্ছে।” 

দুই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র ও সিএএ সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো একদিকে চরম মিথ্যায় ভর্তি আর অন্যদিকে চরম হাস্যকর। আমরা এক এক করে দেখবো যে কী ভাবে এই দুই প্রতিমন্ত্রী আসন্ন লোকসভা নির্বাচন কে পাখির চোখ করে মতুয়াদের মিথ্যা কথা বললেন। 

প্রথমত, একটি বেসরকারি সংস্থার দেওয়া পরিচয়পত্র কী ভাবে একজন মানুষের নাগরিকত্বের অভাব কে পূর্ণ করবে? কী ভাবে মতুয়া মহাসঙ্ঘের দেওয়া পরিচয়পত্র দেশের অভিন্ন পরিচয়পত্র তৈরির যে কাজ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) করবে, তার বিকল্প হতে পারে? এই কার্ড দেখিয়ে যদি সব মতুয়ারা নির্ভয়ে সারা দেশে ভ্রমণ করতে পারেন, হোটেলে থাকতে পারেন, ট্রেনে দেখাতে পারেন, তাহলে কেন কেন্দ্রীয় সরকার একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভারতে এই কার্ডটিকে সরকারি ভাবে বৈধ একটি পরিচয়পত্র হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না? মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদেরা সভায় দাঁড়িয়ে যে প্রতিশ্রুতি দেন তার মূল্য কানাকড়ি হলেও, সরকার লিখিত ভাবে যে আদেশ/নির্দেশ বা আইন প্রণয়ন করে তা সর্বদা মান্য হয়। বিজেপির মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার যদি এত ইচ্ছা থাকে তাহলে সেই সংক্রান্ত বিধি লিপিবদ্ধ করতে তাঁদের কে বাঁধা দিচ্ছে?

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী টেনি তাঁর বক্তব্যে আধার কার্ড না থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি এটা বলেননি যে আধার সরকারি হিসাবে কোনো নাগরিকত্বের পরিচয় নয়, বরং ভারতে ছয় মাসের উপর বসবাসকারী যে কেউই আধার বানাতে পারেন। আধার কার্ড হল এনআরসি তৈরির প্রথম ধাপ, অর্থাৎ জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জির (এনপিআর) অংশ। অন্যদিকে তিনি এটাও বলেননি যে গুয়াহাটি হাই কোর্টের নির্দেশ অনুসারে ভোটার পরিচয়পত্র, প্যান কার্ড, প্রভৃতি কিছুই ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, কারণ এগুলো নাকি প্রতারণা করে বানানো যায়। ফলে যে সব মতুয়াদের এই সব পরিচয়পত্র আছে এবং যাঁরা নির্বাচনে ভোট দেন—এবং বিজেপিকেই দেন—তাঁদেরও নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত নয় এবং তাঁরাও এনআরসির শিকার হবেন। 

তৃতীয়ত, ঠাকুরের বক্তব্য, যা বিজেপিরও বক্তব্য, শুনে মনে হতে পারে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার, রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের, মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার তথাকথিত আইন সিএএ ২০১৯ প্রয়োগ করছে না। এখন প্রশ্ন হল নাগরিকত্ব দেওয়া বা কেড়ে নেওয়া সংবিধানগত ভাবে কেন্দ্রের এক্তিয়ারভুক্ত। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে রাজ্যের কিছুই করার থাকে না। অথচ এমন একটা প্রচার চলছে, এবং যাতে বন্দোপাধ্যায়ও বারবার উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে সায় দিয়েছেন, যে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের আপত্তির কারণে পশ্চিমবঙ্গে সিএএ ২০১৯ অনুসারে মতুয়া উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না। তাহলে প্রশ্ন হল বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুরা কি বিজেপি-শাসিত আসাম, ত্রিপুরা, প্রভৃতি রাজ্যে সিএএ ২০১৯ অনুসারে নাগরিকত্ব পাচ্ছেন? যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে ঠাকুর কি জানাবেন যে ওখানে মতুয়াদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে কী বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

দীর্ঘদিন ধরে মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র বানিয়ে ভারতের নাগরিকত্ব —সিএএ ২০১৯ অনুসারে— পাওয়া যাবে বলে বিজেপি প্রচার করছে উত্তর ২৪ পরগনা সহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায়। অসংখ্য মানুষ এই পরিচয়পত্র করিয়ে ফেলছেন ৮৫ টাকা করে দিয়ে আর এই বিপুল অর্থের বিনিময়ে যে পরিচয়পত্র তৈরি হচ্ছে, তার তথ্যের সুরক্ষার কী বন্দোবস্ত আছে সেটা সাধারণ মানুষ জানেন না। এই তথ্য দিয়ে কি বিজেপি আগামী দিনে এনপিআর-র তালিকা প্রকাশ হলে এনআরসি করে এই মতুয়াদের বেনাগরিক করে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তরও কারুর জানা নেই। 

এর মধ্যে বিজেপি বিধায়ক ও মতুয়া নেতা অসীম সরকার বলেছেন যে মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ হতে পারে না। খুব বেশি হলে সেটা হিন্দুত্বের প্রমাণ হতে পারে। আর তাই তিনি এই নিয়ে কোনো মিথ্যা কথা মতুয়াদের বলতে পারবেন না। ঠাকুরবাড়ির আর এক সদস্যা, মমতাবালা ঠাকুর আবার অভিযোগ করেছেন যে কেন্দ্রীয় গৃহ প্রতিমন্ত্রী টেনি তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে ঠাকুরের মতুয়া মহাসঙ্ঘ কে টাকা উপার্জনের একটা রাস্তা তৈরি করে দিলেন। 

এই মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র নিয়ে বিরাট বিভাজন দেখা গেছে উত্তর ২৪ পরগনা ও নদীয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করা মতুয়া সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা এতদিনে এই পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়েছেন, তাঁরা ভয়ে আছেন যে এই পরিচয়পত্র আদেও কোনো কাজে আসবে কি না, আর যাঁরা বানাননি, তাঁরাও দ্বন্দ্বে আছেন যে আদেও এই পরিচয়পত্র তাঁরা বানাবেন কি না। 

মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে মিথ্যাচার

 উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী বিজেপি পার করলেও, এই নিয়ে তারা কোনো সচেতন প্রয়াস করেনি, বরং অভিযোগ যে মতুয়াদের সাথে প্রতারণা করার জন্যে সিএএ ২০১৯ আনা হয়, যার মধ্যে  উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বছর পার হতে চললো, কিন্তু কোনো ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনের বিধি প্রণয়ন করেনি, বরং বারবার নানা কারণ দেখিয়ে বিধি প্রণয়ন করার মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে।

সিএএ ২০১৯ কে ভারতের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশগুলোর—আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—থেকে ধর্মীয় নিপীড়ণের কারণে বিতাড়িত হয়ে ২০১৫ সালের আগে ভারতে শরণার্থী হয়ে আসা হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ কে নাগরিকত্ব আইন অনুসারে বেআইনী অভিভাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে না ও তাঁরা নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারবেন বলা থাকলেও, এই আইন পাশ হওয়ার আগে, ২০১৫ সালে বিদেশী আইন ও পাসপোর্ট আইনের নিয়মাবলী সংশোধন করে ভারত সরকার, যাতে আবার ২০১৬ সালেও সংশোধন করে আফগানিস্তান কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

এই সংশোধিত নিয়মাবলী আসলে সিএএ ২০১৯ এর জায়গায় কাজ করছে, যার মাধ্যমে এই তিনটি দেশ থেকে ভারতে এসে আঞ্চলিক বিদেশী পঞ্জীকরণ দফতরে (এফআরআরও) নিজেদের ধর্মীয় নিপীড়ণের কারণে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা বৈধ ভাবে পঞ্জীকৃত করানো নিয়মাবলীতে উল্লেখিত ছয়টি অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা সিএএ ২০০৩-এর, যা ভারতে বসবাসকারী অসংখ্য মূলনিবাসী মানুষকে এবং হিন্দু উদ্বাস্তুদের বেআইনী অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে, থেকে ছাড় পাবেন। এ ছাড়াও ভারতে চলমান এনআরসি থেকে বাদ যাওয়ার থেকেও রক্ষা পাবেন।

কিন্তু ঘটনা হল যে এই সংশোধিত নিয়মাবলী, যার কারণে সিএএ ২০১৯ আনা হয়েছে, কোনো ভাবেই বাংলাদেশ ও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা কোটি কোটি বাঙালি নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের, মতুয়াদের নাগরিকত্ব পেতে সাহায্য করবে না বরং তাঁদের কে বেআইনী অভিবাসী চিহ্নিত করার জন্যে একটি ফাঁদ হিসাবে কাজ করবে। কারণ অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু আর নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুই বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় ভারতে এসেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোয়। তাদের না আছে এফআরআরওতে নাম নথিবদ্ধ, না আছে ধর্মীয় নিপীড়ণের প্রমাণ। তাই তাঁরা আইনের চোখে, বিশেষ করে সংশোধিত নিয়মাবলীর ফলে, বেআইনী অভিবাসী হিসাবেই রয়ে গেছেন। 

অন্যদিকে, এই সমস্ত প্রমাণ ও তথ্য নিয়েই ভারতে এসে শরণার্থী হিসাবে রয়েছেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, প্রভৃতি অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা বিশেষত মোদীর রাজ্য গুজরাট, অথবা রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লী, জম্মু ও উত্তর প্রদেশে বাস করেন। এই উদ্বাস্তুরা যেহেতু পাসপোর্ট ও ভিসা সহ বৈধ ভাবে সীমানা পার করে ভারতে এসে এফআরআরও-তে নিজেদের নাম নথিবদ্ধ করেছেন, তাই ভারতের নাগরিকত্ব এদের অনেকেই পেতে পারেন। সিএএ ২০১৯ এর বিলটি নিয়ে সংসদে আলোচনা চলার সময়ে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের তরফ থেকে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) যে পরিসংখ্যান দিয়েছিল তার হিসাবে এই আইনে ভারতে ৩১,৩১৩ জন নাগরিকত্ব পাবেন, যাঁদের সকলকেই কেন্দ্রীয় সরকার আগেই দীর্ঘ-মেয়াদি ভিসা দিয়েছে। 

ফলে, কোটি কোটি মতুয়াদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ সিএএ ২০১৯ রাখেনি। কিন্তু মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন রাখতে ঠাকুর ও বিজেপি বারবার তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ঘটনা হল, যেহেতু মতুয়াদের একটা বড় অংশ বিজেপির প্রতিশ্রুতির উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন, এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গেছে যে তাঁদের মধ্যে বিজেপির সমর্থন ভিত্তি হ্রাস পাচ্ছে, তাই বিজেপি এখন নতুন নতুন ফন্দি নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla