সচরাচর ডিসেম্বর মাসে সংবাদ মাধ্যমে বিগত মাস গুলোর বিশেষ খবর গুলি আবার তুলে ধরা হয়, যাতে বছরের শেষে পাঠকেরা বছরটিকে ফিরে দেখতে পারেন। তবে এই ডিসেম্বরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী কি আগামী বছরের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে? রাজনৈতিক পন্ডিতেরা সদ্য সমাপ্ত পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ নিয়ে তরজায় মেতে আছেন। সবার আগ্রহের বা আলোচনার বিষয়বস্তু হল তিনটি রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনে জয়। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় অনেকগুলো রাজনৈতিক প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরলো যার জবাব খোঁজা এই মুহূর্তে জরুরী।
কোন সমীকরণে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় সম্ভব হল?
ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। বিরোধীদের ও স্বাধীন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই দাবি যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী তাস খেলে, জনমানসে ইসলামবিদ্বেষের বিষাক্ত বাষ্প ছড়িয়ে, বিজেপি এই তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছে। এখন এই অভিযোগের সারবত্তা খোঁজা কঠিন হলেও এ কথা অস্বীকার করে কোনো লাভ নেই যে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের পিছনে কিন্তু হিন্দুত্ববাদী প্রচারের অনেক বড় ভূমিকা আছে।
কিন্তু শুধুই কি বিজেপি হিন্দুত্ববাদের ঘাড়ে চেপে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ভোটে জিতেছে? শুধুই কি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফসল ঘরে তুলেছে বিজেপি? ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের জন্যে শুধুই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ কে দায়ী করলে যেমন একদিকে অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে তেমনি এর ফলে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো প্রশ্নও অধরা থেকে যাবে।
এই প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান দিয়ে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের কারণ না খুঁজে, চেষ্টা করা হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর নজর দেওয়ার যাতে এই ঘটনার পিছনের আসল কারণগুলোকে অনুসন্ধান করে বের করা যায়। যদিও এই প্রবন্ধটি দীর্ঘায়িত না করার জন্যে অনেক তুচ্ছ বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়া হবে।
ছত্তিশগড়ে বিজেপির জেতার কারণ কী?
ছত্তিশগড়ে ২০১৮ সালে কংগ্রেস সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর শাসন করা বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দীর্ঘদিন ধরে শাসন করার ফলে রমন সিংহ এর বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে বস্তার অঞ্চলে তাঁর আমলে আদিবাসী জনজাতির মানুষের উপর যে হারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বেড়েছিল বলে অভিযোগ, সেটার উপর ভিত্তি করে কংগ্রেস সেবার ক্ষমতায় আসে।
আর এই বিগত পাঁচ বছরে কিন্তু বিজেপি কোনো ধরণের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। অনেকেরই অভিযোগ যে বিজেপি নাকি ছত্তিশগড়ে নির্বাচনে জেতার পরিকল্পনাও করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। কিন্তু তবুও খেলা ঘুরে গেল, তবুও কংগ্রেস হেরে গেল তার কারণ যেমন কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তেমনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেলের বিরুদ্ধে ওঠা নানা কেলেঙ্কারির অভিযোগ–যার অন্যতম হল মহাদেব নামক একটি বেটিং অ্যাপের সাথে তাঁর যোগাযোগ।
কংগ্রেস দলের ভিতর বাঘেল ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী টিএস সিংহ দেও-র মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ক্রমাগত একটি ভয়ানক রূপ ধারণ করে এবং বারবার এই দ্বন্দ্বে বাঘেল ও দেও-র মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হয় কংগ্রেস দলের হাইকমান্ড কে। ফলে পার্টির ভিতরে ঐক্য বলে কিছুই ছিল না। এর মধ্যে নানা ধরণের সমীক্ষায় বাঘেল জানতে পারেন যে নির্বাচনের আগে তাঁর পক্ষেই রাজ্যের মানুষের সমর্থন রয়েছে, ফলে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে তিনি ভোটে লড়তে নামেন।
কংগ্রেসের যা দুর্বলতা, তাই বিজেপির শক্তি। কংগ্রেস মাওবাদী উগ্রপন্থার সমস্যার প্রতি নরম মনোভাব দেখাচ্ছে থেকে শুরু করে নানা হিন্দুত্ববাদী প্রচার শুরু করে বিজেপি শক্তিশালী সরকার গড়ার নামে। এর মধ্যে তরুপের তাস ছিলেন মোদী নিজে। যিনি রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের মতন কোনো স্থানীয় নেতা কে ছত্তিসগড়ের নির্বাচনে মুখ হিসাবে তুলে না ধরে নিজেকে তুলে ধরেন। মোদী দেখান যে তিনি একাই কংগ্রেস ও সমস্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম। এর ফলে বিজেপি কিস্তি মাত করতে পারে।
মধ্যপ্রদেশে বিজেপির জেতার কারণ কী?
মধ্যপ্রদেশে বিজেপির ১৮-বছর পুরানো সরকার পড়ে যাবে বলে কংগ্রেস গভীর ভাবে আত্মবিশ্বাসী ছিল। কংগ্রেস নেতারা মনে করতেন যে তাঁরা এমনিই বিজয়ী হবেন কারণ ২০১৮ সালে কংগ্রেস মধ্যপ্রদেশে বিজেপি কে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও, ২০২০ সালে কংগ্রেসের মধ্যে ফাটল দেখা দেয় ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া সদলবলে বিজেপিতে যোগ দিয়ে কমল নাথের সরকার কে ফেলে দেন। তাই কংগ্রেসের ধারণা ছিল যে ভোটাররা বিজেপির এই নিকৃষ্ট কর্মের জন্যে তাঁদের শাস্তি দেবেন এবং কংগ্রেস কে আবার মসনদে বসাবেন।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে কংগ্রেসের নাথ, যিনি নির্বাচনী রণনীতি ও রণকৌশল নিজেই ঠিক করেন, নিজের দলের লোকেদের কারুর মতামত ও পরামর্শ কে গ্রাহ্য করেননি। তিনি যেখানে দরকার মনে করেছেন সেখানে সভা করেছেন আর নয়তো নিজের পরিকল্পনা অনুসারে দলীয় নেতৃত্বকেও ব্যবহার করেছেন।
যেখানে নাথ এমন ঔদ্ধত্য নিয়ে চলছিলেন, সেখানে হেরে যাওয়ার ভয় থেকে, বিশেষ করে রাজ্যজোড়া প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া থাকার কারণে, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান কিন্তু দলে কোনঠাসা হয়েও, প্রথম তালিকায় স্থান না পেয়েও, শুধু টিকে থাকার তাগিদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারে, বিশেষ করে তাঁর সরকারের শুরু করা লাডলি বেহনা প্রকল্পের সুফল বুঝিয়ে মানুষ কে টেনে আনতে। তুলনায় কংগ্রেস অনেক গা ছাড়া ভাব নিয়েই মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরোধিতা করেছে। এমন কি বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারের বিরুদ্ধে না গিয়ে, নাথ কিন্তু নরম হিন্দুত্ববাদ প্রচারের রাস্তায় গিয়ে কংগ্রেস কে বিজেপিরই নরম সংস্করণ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
এ ছাড়াও নাথের নেতৃত্বে কংগ্রেস রাজ্যব্যাপী কোনো বিজেপি-বিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক বা সংখ্যালঘুদের উপর ঘন ঘন আক্রমণের বিরুদ্ধে, গড়ে তোলেনি গত পাঁচ বছরে। বিবৃতি আর পাল্টা বিবৃতির যুদ্ধে আটকে থেকে, কংগ্রেস বিজেপি সরকার কে যেমন শ্রম আইন সংস্কার করে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত শ্রমিকদের খাটাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তেমনি হিন্দুত্ববাদী শিবিরের প্রতি বছর রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী, প্রভৃতি অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলা, ধর্মান্তকরণের অভিযোগ তুলে খ্রিস্টানদের উপর হামলা, প্রভৃতি ঘটনার কোনো প্রতিরোধ কংগ্রেস গড়ে তোলেনি।
ফলে, এক হাতে হিন্দুত্ববাদ আর অন্য হাতে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির টোপ ব্যবহার করে চৌহান বিজেপি কে এই যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন এবং নিজের সামর্থ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। এ ছাড়াও বিজেপি নেতৃত্ব রাজ্যের জনমানসে প্রবাহমান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ধারা যাতে কোনো ভাবে গেরুয়া শিবির কে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে তার জন্যে দলের হেভি ওয়েট নেতাদের, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এবার মধ্যপ্রদেশে প্রার্থী করে। এবং সেই খেলায় বিজেপি জিতে যায়।
রাজস্থানে বিজেপির জেতার কারণ কী?
যদিও বলা হয়ে থাকে যে রাজস্থানে নাকি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তন হয়েই থাকে, তবুও এবার মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোত খুব আশাবাদী ছিলেন যে পুরানো পেনশন প্রকল্প, সস্তা গ্যাস, নারীদের জন্যে প্রকল্প বা জাতি গণনার মতন প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে কংগ্রেস অনায়েসে রাজস্থানে জিতে যাবে। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। জিতেছে বিজেপি। আর বিজেপির জেতার পিছনে দুইটি বড় কারণ রয়েছে।
প্রথমতঃ দীর্ঘ দেড় দশক ধরে রাজস্থানে ধীরে ধীরে নিজের শক্তি বাড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। গো-হত্যার অভিযোগ কে কেন্দ্র করে এক প্রকারের পাল্টা প্রশাসন তৈরি করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) আর বজরং দল। বিশেষ করে জয়পুর-গুরুগ্রাম জাতীয় সড়কে এই বাহিনী দাপিয়ে বেরিয়েছে ও একের পর এক হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে থেকে শিরোনামে এসেছে। এ ছাড়াও রাজসামন্দে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, কুপিয়ে ও পরে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের থেকে রাজস্থানে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক মোহাম্মদ আফরাজুল কে, যা বীভৎসতার মাপকাঠিতে ছিল অতুলনীয় একটি কান্ড।
তবুও ২০১৮ সালে বিজেপি সামান্য আসন সংখ্যার ব্যবধানেই কংগ্রেসের কাছে হেরে যায় কারণ গেরুয়া শিবিরের মধ্যেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজেকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও বিরোধিতা ছিল। বলা হতো যে বিজেপির কর্মীরা মোদী কে ভোট দেবেন কিন্তু কোনো ভাবেই রাজেকে বরদাস্ত করতে পারবেন না। ফলে ২০১৮ সালে রাজ্যে বিজেপি হেরে গেলেও ব্যাপক ভোটে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবির জিতে যায় রাজস্থান থেকে।
এর মধ্যে ২০২০ থেকে যে তীব্র ইসলামবিদ্বেষী প্রচার শুরু করে বিজেপি। ফি বছর রাম নবমী বা হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষ্যে রাজস্থানের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন জ্বালায় ভিএইচপি আর বজরং দল। এর সাথে, ২০২২ সালে ইসলামের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে কুকথা বলা বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মার পক্ষ নেওয়ায় কানহাইয়া লাল নামক এক হিন্দু দর্জিকে হত্যা করে বিজেপির কর্মী হিসাবে চিহ্নিত দুই মুসলিম দুষ্কৃতী। এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি আসরে নামে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই নিয়ে মন্তব্য করেন। ফলে, বিজেপির রাজস্থানে জয়ের পিছনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দ্বিতীয়তঃ বিজেপি যেখানে রাজে কে একঘরে করেও, এক ঝাঁক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে নামায়, সেখানে গেহলোত ও টংক এর বিধায়ক নির্বাচিত হওয়া সচিন পাইলটের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ফলে কংগ্রেস শিবির এমনিতেই অনেক দুর্বল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার আকঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতি করা পাইলট কে কংগ্রেস রাজস্থানে নানা ভাবে ব্যবহার করলেও গেহলোতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে কোনো ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে অক্ষম হয়। ২০২০ সালে পাইলট বিজেপির দিকে পা বাড়াতেই কংগ্রেস বিরাট সমস্যায় পড়ে, কিন্তু সে যাত্রায় হাইকমান্ড আর গেহলোত একযোগে সরকার কে বাঁচিয়ে নেন। কিন্তু কোনো ভাবেই গেহলোত ২০২৩ সালেও পাইলট কে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ হন। ফলে, দলের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও পাইলট কে খাটো করায় তাঁর গুজ্জর সম্প্রদায়ের মধ্যে কংগ্রেসের প্রতি বিদ্বেষ তীব্র হয়। যার কারণে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা রুখতে কংগ্রেস অপারগ হয়।
মোদীর টেক্কা
মোদী জানতেন যে তিনটি রাজ্যেই বিজেপি সাংগঠনিক ভাবে চাপে আছে, যদিও হিন্দুত্ববাদী প্রচার আর তাঁর ক্যারিশমা অটুট রয়েছে। তাই তিনি ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করার জন্যে নিজের মুখটি সামনে আনেন। তিনটি রাজ্যেই তিনিই দলের সব কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে জনসমক্ষে আসেন।
এর ফলে দুটি লাভ বিজেপির হয়। প্রথমত, ভোটাররা স্থানীয় প্রার্থীদের উপর অসন্তোষ ভুলে মোদীর মোহে ভেসে বিজেপিকে ভোট দেন। দ্বিতীয়ত, সব আসনে যেহেতু মোদী নিজেকেই দলের মুখ করেন, ফলে দলীয় কর্মীদের উপর দ্বায়িত্ব আর চাপ বেড়ে যায় নির্বাচনে জেতার, যাতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে “মোদী ঝড়” আবার তোলা যায়। ফলে বিভিন্ন শিবিরের নেতা-কর্মীরা নিজেদের বিভেদ ভুলে মাঠে নামেন ও কংগ্রেসের গা-ছাড়া মনোভাবের সুযোগ নিয়ে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় অর্জন করেন।
রাম মন্দির নির্মাণ, মহিলা সংরক্ষণের নামক সোনার পাথরবাটি, ও তথাকথিত শক্তিশালী ভারত তৈরির মোহ সৃষ্টি করে, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে ও উগ্র জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করে একদিকে মোদী যেমন তাঁর বিরুদ্ধে তোলা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ, বিশেষ করে বৃহৎ পুঁজিপতি গৌতম আদানির সংস্থার সাথে তাঁর ওতপ্রোত সম্পর্কের অভিযোগ, কে নস্যাৎ করতে পেরেছেন, তেমনি খুব সহজে ধর্মীয় মেরুকরণ কে সুসংহত করতেও সক্ষম হয়েছেন।
ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় সুনিশ্চিত করে মোদী বুঝে গেছেন যে ২০২৪ সালেও এই ইস্যুগুলো ব্যবহার করলে যদিও দক্ষিণ ভারতে ভোটের হার বাড়বে না, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী ও নির্ণায়ক গো-বলয়ে বিজেপি নিজের প্রতিপত্তি ধরে রাখতে সক্ষম হবে। আর যেহেতু নতুন করে সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস করলে উত্তর ও পূর্ব ভারতের গো-বলয়ের, হিন্দিভাষীদের প্রতিপত্তি বাড়বে, তাই বিজেপিরও আর এই বলয়ের বাইরের সমর্থনের দরকার বিশেষ একটা হবে না।
কংগ্রেসের ভবিষ্যত
যদিও কংগ্রেস দলটি তেলেঙ্গানায় বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় দেখিয়েছে যে কংগ্রেস কোনো ভাবেই হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কোনো রকম ভাবেই দাগ কাটতে পারছে না। এর কারণ যতটা গান্ধী পরিবার বা কংগ্রেস নেতৃত্বের রাজনৈতিক দৈনতা, তার চেয়েও বড় হল এই দলটির দীর্ঘ ছয় দশক দেশে শাসকের ভূমিকায় থাকা।
ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় সম্ভব হয়েছে কারণ না তো কংগ্রেস সাংগঠনিক ভাবে বিজেপি কে রুখে দেওয়ার মতন ক্ষমতা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিল আর না পেরেছে দলটি কোনো বিকল্প, উন্নত রাজনৈতিক দিশা নির্দেশ দিতে। বরং যেমন মোদী দেখিয়েছে, একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর থেকে নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার কারণে কংগ্রেস বিজেপির দোষ যত তুলে ধরেছে তার তুলনায় অনেক কম তুলে ধরেছে যে কংগ্রেস নিজে জিতলে সাধারণ জনগণের কী বৈষয়িক উন্নতি হবে, বা কী ভাবে তাঁদের জীবনের মান বাড়বে।
২০২৪ এর প্রশ্ন
রাজনৈতিক পন্ডিতেরা বোঝার চেষ্টা করছেন যে কী ভাবে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় আগামী লোকসভা নির্বাচন কে প্রভাবিত করবে। ঘটনা হল, ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলও কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেনি। কারণ বিধানসভা আর লোকসভা নির্বাচনের ইস্যু আর পরিপ্রেক্ষিত আলাদা তাই ফলাফল নির্ভর করবে একেবারে বিভিন্ন বিষয়ের উপর।
প্রথমতঃ মোদী সরকার ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই অযোধ্যায় রাম মন্দির নিয়ে হৈচৈ শুরু করবে যার ফলে দেশজুড়ে একটি মেরুকরণের ঝড় বইবে। হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের হাতে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের জায়গায় গড়ে ওঠা রাম মন্দির কে ঘিরে এমনিতেই গো-বলয় জুড়ে উচ্চ মাত্রার ধর্মীয় মেরুকরণ করা হয়েছে। ফলে খুব সহজেই বিজেপির পক্ষে এই ধর্মীয় অনুভূতিকে ভোটে পরিণত করা সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়তঃ কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক বিরোধীরা যে ভারতীয় জাতীয় উন্নয়নমূলক সর্বব্যাপী জোট (ইন্ডিয়া) গঠন করেছে, সেই জোটের আজও আসন রফা হয়নি। ফলে কী ভাবে, কে কোথায় ও কত আসনে ভোটে লড়বে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। আর এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে ব্যস্ত থাকায় যেহেতু কংগ্রেস আসন রফা করেনি, তাই দলটির উপর সবচেয়ে বেশি খাপ্পা হয়েছে অন্য দলগুলো।
তৃতীয়তঃ কংগ্রেস ও বিরোধী শক্তি গুলো একজোট হয়ে কি সত্যিই কোনো নতুন ও চমকদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণ কে নিজের দিকে টানতে পারবে না এই জোটকে বিজেপি সহজেই দুর্নীতিগ্রস্তদের টিকে থাকার শেষ সম্বল হিসাবে চিহ্নিত করে জনমত কে এর বিরুদ্ধে ঠেলে দেবে সেটা নির্ধারণ করবে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল কে। গো-বলয়ে কোনো বিপক্ষ শক্তি বিজেপির সাথে পেরে উঠবে না সেটা স্পষ্ট, কিন্তু বিহার, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লী, প্রভৃতিতে তারা যদি কোনো ভাবে ঐক্য বজায় রেখে লড়তে পারে তাহলে বিজেপির আসন সংখ্যা কমতে পারে।
শেষের কথা
জনগণের জন্যে কী কী ধরণের প্রতিশ্রুতি আগামী লোকসভা নির্বাচনে দুই পক্ষ দেবে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ কী ভাবে জনগণের মতামত কে প্রভাবিত করবে, সেটাও নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপির নির্বাচনী বিজয় দেখিয়ে দিল যে গেরুয়া শিবির খুব সহজেই কিন্তু সমীকরণ বদলে দিতে পারে ও হেরে যাওয়া খেলাতেও জিততে পারে। প্রশ্ন হল, নানা মতের ও নানা উচ্চাকাঙ্ক্ষায় চালিত দেশের নানা বিরোধী দল কি সত্যিই এক হয়ে ও একাগ্র চিত্তে বিজেপির মতন একটি রেজিমেন্টেড দলকে হারাতে সক্ষম হবে? তাও আবার প্রায় ২৮০ থেকে ৩০০টি আসনে? আগামীতে বিরোধীদের কর্মকাণ্ডেই নিহিত রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর।