২০২৪ সালের আগমন হলো। প্রতি বছর মানুষ উৎকণ্ঠার সাথে আর একরাশ আশা নিয়ে নতুন বছর কে বরণ করেন, হৈ হুল্লোড় আর গান বাজনা করে নতুন বছর উদযাপন করার মধ্যে সুপ্ত থাকে আগামী কে আরো ভালো করে উপভোগ করার বাসনা। আর থাকে বেঁচে থাকার সুতীব্র ইচ্ছা, যার জোরেই হয়তো বর্ষবরণের রাতে, প্রবল ঠান্ডায় ফুটপাতে থাকা আজকের যীশু ঠকঠক করে কেঁপেও আকাশে আলোর রোশনাই দেখে স্বপ্ন দেখে সেই আকাশেই ওড়ার।
যখন ২০২৩ শেষ হল, আর প্রতিবারের মতন আমাদের শহরগুলো প্রবল উদ্দীপনার সাথে ২০২৪ কে বরণ করলো, তখন প্রশ্ন উঠলো ব্যাকুল মনে যে এই নববর্ষে কী ভাবে বিশ্বে আর আমাদের নিজ ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা কোনো পরিবর্তন দেখতে পাবো?
২০২৪ সাল মানেই ভারতের মসনদে কে বসবে তা ঠিক করার লোকসভা নির্বাচনের বছর। ঠিক দশ বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা নরেন্দ্র মোদী। অভিযোগ তাঁর উত্থানের সাথেই জেগে উঠেছে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ। আরও অভিযোগ যে তাঁর আমলেই লুন্ঠিত হলো গণতন্ত্র আর নাগরিকের অধিকার। কিন্তু তাতেই বা কী? সেই ২০১৪ সাল থেকেই মোদীর নেতৃত্বে কিছু নির্বাচন ছেড়ে বেশির ভাগ নির্বাচনেই বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই তাদের শাসন।
এই সব তখন হচ্ছে যখন পশ্চিমা বিশ্বের দুয়ারে মাথা ঠেকিয়ে ভারতের সম্পদ কে বন্ধক রাখার সময় মোদী বারবার ভারত কে বিশ্বের গণতন্ত্রের জননী বলছেন। বলেছেন ১৪০ কোটি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা। তবে সাথে সাথে তিনি সব জায়গায়, বারবার করে, পাকা ফ্যাসিবাদীর মতন, জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তাঁদের নিজেদের মৌলিক অধিকার ভুলে কর্তব্য করতে হবে, কারণ এটাই, মানে বর্তমান সময়টা, হচ্ছে স্বাধীনতার “অমৃত কাল”।
তাই, সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভিত্তিতে, আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচনও জিততে তৎপর বিজেপি। শুধু মাত্র নির্বাচনেই বিরোধীদের টেক্কা দেওয়া নয়, বরং সংসদের ভিতরেও তাদের কণ্ঠরোধ করার ভয়ানক পন্থা বেছে নিয়েছে মোদী সরকার। তাই ২০২৩ সালেই দেখা গেল বৃহৎ পুঁজিপতি গৌতম আদানির সাথে মোদীর সম্পর্ক নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার ফলে সাংসদ পদ গেল তৃণমূল কংগ্রেস দলের মহুয়া মৈত্র-র। মুসলিম পরিচয়ের জন্যে সংসদের মধ্যে কুরুচিপূর্ণ ভাবে ইসলাম বিদ্বেষী মন্তব্য করা হলো বহুজন সমাজ পার্টির সাংসদ কুঁয়ার দানিশ আলীর বিরুদ্ধে। আর এতেও ক্ষুধা নিবারণ না হওয়ায় সংসদের দুই কক্ষ থেকে শীত কালীন অধিবেশন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো প্রায় দেড়শো সাংসদ কে।
এই অমৃতকালেই বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর ―নিন্দুকেরা বলেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বংসস্তূপ―নির্মাণ করা হচ্ছে রাম মন্দিরের। সেই রাম মন্দির যা একদা ফ্রিঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত বিজেপিকে ভারতীয় রাজনীতির চালিকা শক্তি বানিয়েছিল। সেই রাম মন্দিরই এবার মোদীর লোকসভা নির্বাচনের তরূপের তাস বলে এখনো পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে। গভীর আর্থিক মন্দার সময়ে হিন্দু ভোট যখন মোদী মন্দির দেখিয়ে একাট্টা করছেন তখন কোনো বিরোধী দল ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আর গলা ফাটাতে পারছে না কারণ হিন্দু ভোটই বড় বালাই। এখানেই মোদীর স্বার্থকতা। তিনি নিজের রাজনীতির ছাঁচে গোটা ভারতীয় রাজনীতিকে মুড়ে দিতে পেরেছেন।
তাই ২০২৪ সালে ভারতে আরো বেশি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হওয়ার, হিন্দু ধর্মের উৎসবের দিনে অস্ত্র নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর তান্ডব করার, দেশের অহিন্দি রাজ্যগুলোর অধিকার খর্ব হওয়ার ঘটনা ঘটবে। এর মধ্যেই ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যদি জনগণনা হয়ে যায় আর জনসংখ্যার ভিত্তিতে যদি লোকসভার আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় তাহলে তথাকথিত জাতীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে অহিন্দি ভাষী সম্প্রদায়গুলো, কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে অপারগ হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলো অন্যান্য সক্ষম রাজ্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি আসন পাবে সংসদে এবং এর ফলে বিজেপিকে আর অহিন্দি ভাষীদের অনুভূতি বা চাহিদা নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না।
২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মোদীর বিরুদ্ধে একাট্টা হওয়া ইন্ডিয়া জোট সদস্য দলগুলো নীতিগত ভাবে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বা নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে কোনো জোরদার লড়াই করার জায়গায় নেই। তার উপরে, এই দলগুলোর নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, রাজ্য রাজনীতির বাস্তবিক পরিস্থিতি, প্রভৃতির কারণে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী ভোট সব রাজ্যে এক জায়গায় আনা মুশকিল ব্যাপার। বিহার, উত্তর প্রদেশ, তামিল নাড়ু, মহারাষ্ট্র আর ঝাড়খণ্ডের বাইরে এই ইন্ডিয়া জোট কোথাও কার্যকর হওয়ার পরিস্থিতিতে নেই। এর মধ্যে উত্তর প্রদেশে বিজেপিকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল আর মহারাষ্ট্রে ইন্ডিয়া জোটের মূল শরিক শিব সেনা আর জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) ভেঙে গেছে। ফলে সেখানেও ইন্ডিয়া জোটের ভালো ফল করার কোনো আশা নেই।
ফলে ২০২৪ সালে কোনো ভাবেই ভারতবাসীর কাছে কোনো আশার বাণী শোনাচ্ছে না। কোনো নতুন দিশা দেখাচ্ছে না। এর দায় শাসকের না। কারণ শাসক তার শাসন ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিরোধীরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ, তারা বিকল্প নীতির কথা বলতে ব্যর্থ; একপ্রকার তারা যুদ্ধ শুরুর আগেই আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। এই কারণেই হয়তো নির্বাচনের পরে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর আর্থিক সঙ্কটে আরো বেশি নিম্মজিত হতে পারে ভারতের জনগণ, তবে আরো কতদিন ধর্মের নেশায় বুঁদ হয়ে বাস্তব সমস্যার থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুখ ফিরিয়ে থাকবেন সেটাও হলফ করে বলা যাচ্ছে না।