সিএএ ২০১৯ নিয়ে আবার বেফাঁস মন্তব্য করে সংবাদে এলেন বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। কিন্তু সিএএ ২০১৯ চালু হওয়া নিয়ে তাঁর মন্তব্য কি মুখ ফস্কে হওয়া নাকি বিজেপির কোনো গূঢ় অভিসন্ধির ফল?

নাগরিকত্ব বিতর্ক উস্কে আবার সংবাদ মাধ্যমের শীর্ষে আসলেন কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। মতুয়া মহাসঙ্ঘের এই সভাপতি বিগত চার বছর ধরেই উদ্বাস্তু নমঃশুদ্রদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আনা বিতর্কিত নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯), অনুসারে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার দাবি করে আসছেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের “ওই আসছে” বলে আকাশের দিকে আঙ্গুল তাক করেন আর তারপরেই সেই স্বপ্নের ফানুস চুপসে যায়। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহেও বনগাঁর সাংসদ অন্যথা করেননি। তিনি বললেন সাতদিনে সিএএ ২০১৯ চালু হয়ে যাবে, তবে সে আশাও গুড়ে বালিতে পরিণত হলো।

এক সপ্তাহ আগের বলা সিএএ ২০১৯ চালু করার কথা নিয়ে তাই ভিন্নস্বরে নিজের প্রতিক্রিয়া জানালেন বিজেপি সাংসদ ঠাকুর। তিনি বললেন তিনি আলবৎ বলতে চাননি যে সিএএ ২০১৯ চালু হবে, বরং তিনি নাকি বলতে চেয়েছিলেন যে সেই আইনের নিয়মাবলী তৈরি হয়ে যাবে যা গত চার বছর ধরে নানা টালবাহানা করে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের মন্ত্রক ঝুলিয়ে রেখেছে। তার বদলে আইন চালু করে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা তিনি নাকি “মুখ ফস্কে” বলে ফেলেছিলেন। যদিও মতুয়া উদ্বাস্তু ভূমিপুত্রদের অনেকেই ঠাকুরের প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ, তবুও ঠাকুরের সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতিটি কোনো ভাবেই মুখ ফস্কে বলা কোনো কথা না। এর পিছনে রয়েছে এক গূঢ় অভিসন্ধি।

এই ব্লগে দীর্ঘ চার বছর ধরে দেখানো হয়েছে কেন সিএএ ২০১৯ একটি ভাওঁতা দেওয়ার আইন আর কেনই বা এই আইনের সুযোগ নিয়ে দেশ ভাগের শিকার হয়ে ভারতে আসা কোটি কোটি নমঃশুদ্র উদ্বাস্তু নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন না। তোলা হয়েছে এই প্রশ্নও যে কেন বারবার সিএএ ২০১৯ কে মুসলিম বিরোধী বলে চিহ্নিত করে বিরোধীরা এড়িয়ে গেছেন সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যার জবাব চাইলে বিজেপির অবস্থা যেমন খারাপ হতো তেমনি তার উদ্বাস্তু ভোট ব্যাঙ্ক যেত ভেঙে—এই নাগরিকত্ব আইনে কেন উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্বের কথা নেই।

তবুও, ঘটনাসূত্রে এই প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে উপায় নেই যে সিএএ ২০১৯ কে যদি তার পূর্বসূরী নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ (সিএবি)-র প্রেক্ষিতে দেখা হয়—দুইটির মধ্যে পার্থক্য হলো যে সিএএ ২০১৯ কোনো ভাবেই উত্তর পূর্ব ভারতের আদিবাসী অঞ্চলে প্রয়োগ করা যাবে না—ও তার সাথে সিএবি ২০১৬ নিয়ে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকের রিপোর্ট ও কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের সেখানে দেওয়া হলফনামা কে মিলিয়ে দেখা হয় তাহলেই বোঝা যাবে এই আইনে কোনো ভাবেই কোটি কোটি নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের নিস্তার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কারণ তাঁরা বৈধ শরণার্থী নন বরং আইনের চোখে বেআইনি অধিবাসী, যাঁদের সনাক্তকরণ ও বিতাড়নের জন্যে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩, পাশ করেছিল বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ীর সরকার।

কিন্তু ঠাকুর তো মুখ ফস্কে এই মন্তব্য করেননি। যদি ভেবে চিন্তেই বলে থাকেন, তাহলে এর পিছনে তাঁর বা বিজেপির অভিসন্ধি কী? বাজেট অধিবেশন শুরুর থেকেই কিন্তু কেন্দ্রীয় গৃহ মন্ত্রক বলা শুরু করে যে সিএএ ২০১৯ এর নিয়মাবলী এই অধিবেশনে পেশ করা হবে এবং তার পরেই ‘নাগরিকত্ব’ দেওয়ার কর্মকাণ্ড শুরু হবে। এই নিয়ে যদিও বিরোধীরা রব তোলে কিন্তু ঘটনা হলো কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই আইনের, যাতে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের আগে ভারতে ধর্মীয় নিপীড়ণের কারণে প্রতিবেশী আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে প্রবেশ করে থাকেন ও স্থানীয় ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) গুলোয় নিজেদের ধর্মীয় নিপীড়ণের কারণে ভারতে শরণ চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভিসা (লংটার্ম ভিসা) নিয়ে থাকেন তাহলে তাঁরা বেআইনি অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত হবেন না, আওতায় নাগরিকত্ব দিতে চায়ও, তাহলে অসংখ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্বের জন্যে গণ্য হবেন না, বরং এই আইনের শরণ নিলে তাঁদের বেনাগরিক হিসাবে, বেআইনি অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করার কাজ সহজ হবে। এই কারণেই দীর্ঘ চার বছর ধরে আইনটির কোনো নিয়মাবলী প্রকাশ করা হয়নি, নানা বাহানায় শাহ দীর্ঘদিন এই নিয়ে টালবাহানা করেন ও এর ফলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঠাকুর দল ছাড়ার কথা নিজ ঘনিষ্ঠ মহলে প্রকাশ করায়, তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের টোপ দিয়ে আটকে রাখা হয়।

যে কোনো আইন পরিষদীয় ক্ষমতাবলে তৈরি হলেও সেই আইন কী ভাবে প্রয়োগ হবে, তাতে কাদের কী কী করণীয় থাকবে ও আইনটি কাদের জন্যে প্রয়োগ হবে, ইত্যাদি ঠিক করে তৈরি হয় তার নিয়মাবলী, যা আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন তৈরি করে। তবে নির্দিষ্ট আইনটির পরিসরের বাইরে নিয়মাবলী যেতে পারে না আর আইনের নিয়মাবলী কে সংসদ বা বিধানসভা অনুমোদন দেয়। সিএএ ২০০৩ লোকসভায় পাস হওয়ার আগেই তার নিয়মাবলী এসে গেছিল। সব আইনের ক্ষেত্রেই তাই হয়, সিএএ ২০১৯ বাদে। এর কারণ এই আইনের নিয়মাবলী আগে প্রকাশ হলে বিজেপি মতুয়া ও অন্যান্য নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের যে টোপ দিয়ে নিজের বড়শিতে গেঁথে রেখেছে, সেটা আর করা সম্ভব হতো না।

মতুয়া ধর্মালম্বীদের একটা অংশ এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকায় তাঁরা কোনো ভাবেই ঠাকুরের বয়ানে বিশ্বাস করতে পারছেন না দীর্ঘদিন ধরে আর তাই নির্বাচনের আগে অন্তত নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে নিজের উদ্বাস্তু ভোটব্যাঙ্ক বিজেপি ধরে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করছে।যদিও বা সিএএ ২০১৯ এর নিয়মাবলী প্রকাশ করা হয় তাহলে দুটি সম্ভাবনার জন্ম হবে। প্রথমত, নিয়মাবলী দেখেই উদ্বাস্তুরা বুঝতে পারবেন যে তাঁদের নাগরিকত্ব হবে না আর দ্বিতীয়ত, সেই নিয়মাবলী বিজেপির রাজনৈতিক টোপ হিসাবে তৈরি হবে এমন ভাবে যাতে তার সাথে আইনের ফারাক থাকবে যা নিয়ে বিরোধীরা যদি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে তাহলে সেটাকে তাদের হিন্দু উদ্বাস্তু বিরোধিতা বলে দেখিয়ে বিজেপি আবার তার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে পারবে।

এরই মধ্যে এই সিএএ ২০১৯ এর ভাঁওতা কে তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সম্প্রতি, সোমবার, ৫ই ফেব্রুয়ারি, কলকাতা প্রেস ক্লাবে কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ (ইউসিআরসি), সংবিধান বাঁচাও মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ ন্যায় মঞ্চ ও অন্যান্য উদবাস্তু সংগঠন, কংগ্রেস ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ২০১৪ সাল কে ভিত্তি বছর ধরে সমস্ত উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি করে। এই সাংবাদিক সম্মেলনে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য মোদীর নাগরিকত্ব দেওয়ার খুড়োর কলকে আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের “সবাই নাগরিক” তত্ত্ব কে সমালোচনা করেন। সিপিআই (এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব নিয়ে মোদীর রাজনীতির বিরোধিতা করার সাথে সাথে বন্দোপাধ্যায় যে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে পাশ হওয়া সিএএ ২০০৩ এর সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক ছিলেন ও পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত “অনুপ্রবেশের সমস্যা” নিয়ে সোচ্চার ছিলেন বিজেপির সাথে সে কথা মনে করিয়ে দেন।

মোদী সরকার যদি নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যে সচেষ্ট হতো তাহলে দীর্ঘ চার বছর ধরে সিএএ ২০১৯ কে ঠান্ডা ঘরে রেখে, তা নিয়ে রাজনীতি করতো না। বিজেপি ভালো ভাবেই জানে যে সিএএ ২০১৯ এর নিয়মাবলী আগে প্রকাশ পেলে এতদিনে উদ্বাস্তুরা সবাই আইনের ফাঁদে পড়ে বর্তমান পরিস্থিতির থেকে আরও খারাপ অবস্থায় চলে যেতেন আর এই ভোটব্যাঙ্ক ভেঙে যেত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও, সিএএ ২০১৯ এর কারণে অনেক সীমান্তবর্তী ও উদ্বাস্তু-অধ্যুষিত অঞ্চলে ভোটে জেতে বিজেপি। তাই বছরের পর বছর এই আইন নিয়ে কোনো পদক্ষেপ যেমন তারা করেনি তেমনি শাহের মন্ত্রক নানা ভাবে জনগণনা, ও তার সাথে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) তৈরির কাজ—যা সিএএ ২০০৩ অনুসারে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) তৈরির প্রথম ধাপ—পিছিয়ে দিয়েছে ২০২৬ পর্যন্ত। আর এই এনপিআর আর এনআরসি তৈরি হলে ভারতের সংবিধানের ৬(ক) ধারা অনুসারে সকলকেই হয় ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ের আগে ভারতে থাকার প্রমাণ দিতে হবে বা নাগরিকত্ব আইন অনুসারে জন্মগত ভাবে নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে।

ফলে, এই সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে উদ্বাস্তুদের কাছে খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার প্রয়াস করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। ঠাকুর আর তাঁর দিল্লীর কর্তারা সেই কথা ভালো করেই জানেন। তাই নানা ভাবে, কখনো মতুয়া কার্ড দিয়ে বা কখনো কোনো অন্য বাহানায় তাঁদের ভুলিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলমান। প্রশ্ন হলো এই শাঁক দিয়ে কতদিন মাছ ঢাকা যাবে?

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla