সিএএ ২০১৯ নিয়মাবলী: কেন বিজেপির গেরোয় ফাঁসবেন বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুরা?

রাজনীতি
সিএএ ২০১৯ এর নিয়মাবলী প্রকাশ করে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ছক্কা হাঁকলো বিজেপি কিন্তু কেন এই আইনে নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুরা? কেন হবে তাঁদের সর্বনাশ ২০২৬ সালে?

শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাটকীয় কায়দায়, সোমবার, ১১ই মার্চ, বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় ঘোষণা করলেন যে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯) চালু হচ্ছে এই দিন থেকেই এবং এই আইনের নিয়মাবলী প্রকাশ করা হচ্ছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ নিয়মাবলীর লিঙ্ক নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে প্রকাশ করেন। যে কোনো আইন পাশ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সেই আইনের নিয়মাবলী প্রকাশ পেলেও, সিএএ ২০১৯ এর নিয়মাবলী কে বারবার প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও মোদী সরকার বা শাহ কোনো পদক্ষেপ নেননি। এখন এই নতুন নিয়মাবলীর ফলে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অসংখ্য হিন্দু, বিশেষ করে নমঃশুদ্র ও মতুয়ারা, আশা করছেন যে তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তাঁরা আশা করছেন যে তাঁদের দীর্ঘদিনের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার আশা এবার পূর্ণ হবে। কিন্তু এই নিয়মাবলী খতিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে যে আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব হাতে গোনা কয়েকজন বাংলাদেশী উদ্বাস্তু ছাড়া কেউই পাবেন না। কেন?

নিয়মাবলীর গেরোয় ফেঁসে নমঃশুদ্র আর মতুয়া উদ্বাস্তুরা 

সিএএ ২০১৯ পাশ হওয়ার পরেই আইনের শুরুতেই বলা ছিল যে এই আইন শুধু মাত্র তাঁদের জন্যে যাঁরা ২০১৫ আর ২০১৬ সালে করা পাসপোর্ট আইন ও বিদেশী আইনের নিয়মাবলীতে করা সংশোধনীতে ছাড় পেয়েছেন। নতুন করে ছাড় পাবেন কেউ সেই কথা বলা নেই। অর্থাৎ অমুসলিম ছয়টি সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের আগে ধর্মীয় নিপীড়ণের শিকার হয়ে ভারতে এসেছেন ও সেই কারণ দেখিয়ে স্থানীয় আঞ্চলিক বিদেশী নথিবদ্ধকরণ কেন্দ্রে (এফআরআরও) নাম নথিভুক্ত করেছিলেন, শুধু মাত্র তাঁরাই ভারতের নাগরিকত্ব আইনে “বেআইনী অভিবাসী” হিসাবে চিহ্নিত হবেন না ও সিএএ ২০১৯ এর আওতায় ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারবেন। 

কিন্তু কোটি কোটি নমঃশূদ্র ও মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা কি এই ভাবে ভারতে এসে এফআরআরও-তে নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন? তাঁরা কি লংটার্ম বা দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিয়ে ভারতে বাস করছেন? যেহেতু না, তাই তাঁদের জন্যে সিএএ ২০১৯ এর আওতায় অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছুই রাখেননি মোদী-শাহ। তবে তবুও যদি তাঁরা নাগরিকত্বের আবেদন করতে যান, অনলাইন পোর্টালে, সেখানে তাঁরা নথির গেরোয় ফেঁসে আবেদনই করতে পারবেন না। কিন্তু কেন?

সংশোধিত নাগরিকত্ব নিয়মাবলী, ২০২৪, অনুসারে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে গেলে দুই ধরণের প্রামাণ্য নথি দেখাতে হবে যা তফসিল ১-এ ও ১-বি তে উল্লেখ করা আছে, নিয়মাবলীর ৩৫ নম্বর পাতার থেকে। এখন এই ১-এ তে রয়েছে নয় ধরণের নথি যার মধ্যে যে কোনো একটি নাগরিকত্ব আবেদনের ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।

এর মধ্যে রয়েছে উক্ত তিনটি দেশের কোনো একটির পাসপোর্ট, সরকারি প্রমাণপত্র, লাইসেন্স, জমির দলিল, প্রভৃতি, যা পূর্ব বাংলার থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে আসা কোটি-কোটি বাঙালি নমঃশুদ্র ও মতুয়া উদ্বাস্তুদের নেই। আর এই নথি না দিলে আবেদন করাই যাবে না।

ফলে, এই আইনের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে বাঙালি উদ্বাস্তু যে কোনো রকমের সুযোগ পাবে না—এফআরআরও-র কথা যেহেতু অনেকেই জানেন না—সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি 

প্রধানতঃ সিএএ ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী মোদী ও গৃহমন্ত্রী শাহের নিজ রাজ্য গুজরাট সহ রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, প্রভৃতি রাজ্যে বাস করা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে আইনী পথে—কারণ সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমানার মতন ফাঁকফোঁকর নেই ও কড়া প্রহরা থাকে—ভারতে এসে নিজেদের নাম এফআরআরও-তে নথিভুক্ত করা অমুসলিম সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের জন্যে আনা হয়েছিল কারণ তাঁরা বৈধ ভাবে ভারতে বাস করার জন্যে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পেয়েছেন। ফলে সিএএ ২০১৯ এর পূর্বসূরি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬, নিয়ে সংসদের যৌথ কমিটির সামনে দেওয়া গৃহমন্ত্রকের হলফনামা অনুসারে যে ৩১,৩১৩জন উপকৃত হবেন তাঁদের সিংহভাগই এই আইনী উদ্বাস্তুরা। 

এবার পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতে বাংলাদেশ থেকে আসা নমঃশূদ্র ও মতুয়ারা যেহেতু এফআরআরও-তে নিজেদের ধর্মীয় নিপীড়ণের কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে ভারতে থাকার অনুমতি নেননি, তাই তাঁরা এই আইনের আওতায় না আসলেও, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)—যা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মূল সংগঠন ও মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পিতৃপ্রতীম সংগঠন—কাজ করে তাঁদের একটা অংশ কে নিজের প্রভাবে আনতে পেরেছে তাই খুড়োর কলের মতন এদের সামনে নাগরিকত্বের টোপ বিজেপি টাঙিয়ে রেখেছে।

তাই আইনটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পাশ হলেও দীর্ঘদিন এর নিয়মাবলী প্রকাশ করা হয়নি কারণ এর ফলে এই নমঃশূদ্র ও মতুয়ারা আবেদন করে নাগরিকত্ব না পেলে তাঁদের বিজেপির উপর আস্থা শেষ হয়ে যেত এবং তাঁদের ভোটে বিজেপির জেতার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচন তো বটেই, ২০২৬ এর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনেও এদের ভোট বিজেপির চাই। ফলে, চার বছর বিনা কারণে আটকে রেখে এবার এই নির্বাচনের আগে এই আইন প্রকাশ করা হলো। 

কিন্তু যেহেতু এই আইনে কোটি-কোটি নমঃশুদ্র ও মতুয়া কোনো ভাবেই নাগরিকত্ব পাবেন না, তাই তাঁদের নাগরিকত্বের আবেদনে আটকে রেখে ২০২৬ সাল অবধি তাঁদের ভোট কে ব্যবহার করার রাস্তা বিজেপি খুলে রেখেছে। এইবার ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে ২০২১ সালের থেকে আটকে থাকা জনগণনার হিসাব প্রকাশ হবে, যার মাধ্যমে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর), যা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩) অনুসারে জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এনআরসি) তৈরির পূর্বের ধাপ। এই এনপিআর তৈরি হয়েই গেছে আধারের ভিত্তিতে, যে কারণে অসংখ্য মানুষের আধার এই বছর বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু জনগণনার সময়ে এটিকেই অনলাইনে মিলিয়ে দেখে এনআরসি তৈরি করা হবে, যাতে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ অনুসারে কোটি কোটি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব চলে যাবে। 

ততদিনে বিজেপির আর এদের দরকার হবে না। ফলে এই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব সেই সময় চলে গেলেও বিজেপির কোনো ধরণের ক্ষতি হবে না। আর এই কারণেই এমন ভাবে এই আইনের নিয়মাবলী প্রকাশ করা হলো যাতে কোনো মতুয়া ও নমঃশূদ্র উদ্বাস্তু এই নিয়ে সন্দিহান না হয়, বরং তাঁদের ভোট বিজেপির খাতায় জমা হয়। এর পরে তাঁরা ২০২৬ পর্যন্ত যে এই নথির গেরোয় ফেঁসে থাকবেন সে কথাও বোঝা যাচ্ছে কারণ তাঁদের দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জয়ের বিজেপির লক্ষ্য পূরণ করার চেষ্টা করবে। 

গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০১৯-২০ সালের থেকে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলন মতুয়া ও নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যে গড়ে ওঠায়, মতুয়া ও নমঃশূদ্রদের মধ্যে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধ্বস নেমেছে। এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস মতুয়াদের মধ্যে ভোটব্যাঙ্ক আবার গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ফলে, বিগত দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সভায় মতুয়া সম্প্রদায়ের ঢল আগের মতন নামেনি। শান্তনু ঠাকুর দীর্ঘদিন ধরে মতুয়া সম্প্রদায়কে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিতে থাকলেও, তাঁর প্রতি মতুয়াদের ভরসাতেও চিড় ধরেছে। ফলে বিজেপি তড়িঘড়ি একেবারে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে এই আইনের নিয়মাবলী প্রকাশ করেছে যাতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো লাভ বাঙালি উদ্বাস্তুদের হবে না। 

বিরোধীদের গোলমেলে রাজনীতি 

প্রথম থেকেই বিজেপির সিএএ-২০১৯ এর ভাঁওতাকে কার্যকরী করেছে বিরোধী দলগুলো। বামপন্থী থেকে দক্ষিণপন্থী সবাই একই দোষে দোষী। প্রথম থেকেই বিজেপির লক্ষ্য ছিল যে মতুয়া ও নমঃশুদ্র উদ্বাস্তুদের ভোটের মেরুকরণ। কিন্তু এই আইনে যে মতুয়া ও নমঃশুদ্রদের কোনো লাভ হবে না সে কথা না বলে বারবার এই আইনে “মুসলিমদের নাগরিকত্ব” চলে যাবে এই প্রচার করে মুসলিমদের আতঙ্কিত করে রাস্তায় নামিয়ে এই বিরোধীরাই কিন্তু বিজেপির পক্ষে হিন্দু ভোট কে একত্রিত করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফলে ২০২০ সালে দিল্লীর মুসলিম-বিরোধী হিংসাকে প্ররোচিত করতে পারলো বিজেপি ও আরএসএস।

এই দিকে, রাজ্য জুড়ে মতুয়া ভোট কে উপেক্ষা করেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলছেন যে তিনি পশ্চিমবঙ্গে সিএএ ২০১৯ লাগু হতে দেবেন না। সেই রকমই বিরোধিতা দেখাচ্ছেন তাঁর রাজনীতির ১৮০-ডিগ্রি বিপরীতে দাঁড়ানো কেরলের মুখ্যমন্ত্রী, বামপন্থী পিনারাই বিজয়ন। কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় তাতে রাজ্যের হাত থাকে না। ফলে এই সব কথা বলে নিজেদের “হিন্দু-বিরোধী” দেখিয়ে এই দলগুলোই বিজেপি কে সহায়তা করছে। ফলে শেষ পর্যন্ত বিজেপির পক্ষে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ আটকানো সম্ভব হবে না। 

বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকত্বের জটিলতায় যে সব মতুয়া ও নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ ফেঁসে আছেন তাঁদের কে এনআরসি-র ফলে বেনাগরিক হওয়ার থেকে বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা হলো নিঃশর্ত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করা, যার জন্যে নাগরিকত্ব আইনের সমস্ত সংশোধনী বাতিল করতে হবে, বিশেষ করে সিএএ ২০০৩, ও সমস্ত জনগণকে একটি তারিখের ভিত্তিতে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করা। কিন্তু এই নিয়ে কোনো বিরোধী পক্ষই আওয়াজ না তুলে, শুধুই “সবাই নাগরিক” বলে সমস্যা কে লঘু করে ও মানবতা-বিরোধী নাগরিকত্ব আইন কে গোপন করেছে, যা এই সমস্যা কে আরও দীর্ঘস্থায়ী করছে। 

এখন অপেক্ষা যে এই টোপ গিলে মতুয়া আর নমঃশুদ্ররা কি তাঁদের ২০১৯ সালে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন? নাকি বিজেপির ফাঁদে আবার তাঁরা পড়ে যাবেন?

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


আপনার মতামত জানান