সম্প্রতি মোদী তাঁর ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী জনসভায় বলেন যে তাঁর কোনো সম্পদ নেই, বাড়ি নেই, এমনকি একটি সাইকেলও নেই। কিন্তু আদতেই কি তাই? মোদী কি সত্যিই ফকির? কী বলে তথ্য?
শনিবার, ৪ঠা মে, ঝাড়খণ্ডের গুমলায় একটি নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন যে তাঁর কাছে কোনো বিষয় সম্পত্তি নেই, বসত ভিটা নেই, এমনকি একটি সাইকেলও নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) কে আক্রমণ করে বলেন যে এই দলের নেতারা শুধু নিজেদের সন্তানদের জন্যে সম্পদ তৈরি করতে চায়।
এই সভায় মোদী আরও বলেন যে কংগ্রেস দশকের পর দশক ধরে আদিবাসীদের সর্বনাশ করেছে আর তিনি দিন রাত্রি শুধুই আদিবাসী জনগণের সেবা করছেন। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান তাঁর ইসলাম বিদ্ধেষী প্রচারের সাক্ষ্য এবার বহন করলো ঝাড়খণ্ডও। মোদী আবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন যে তাঁরা দলিত ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ মুসলিমদের দিয়ে দিতে চায়। তিনি আবার বললেন যে জীবন থাকতে তিনি কংগ্রেস কে দলিত ও আদিবাসীর অধিকার কেড়ে মুসলিমদের দিতে দেবেন না।
গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়খণ্ডের ১৪টির মধ্যে ১২টি আসনেই বিজেপি জেতে প্রায় ৫৬% ভোট পেয়ে। বিরোধী জেএমএম জোট পায় মাত্র দুটি আসন। কিন্তু তারপরেও, অক্টোবর ২০১৯ এ বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যায় বিজেপি। ক্ষমতায় আসে জেএমএম। সেই সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন আজ জেলে। তাঁর দলকে ভাঙতে উদ্ধত হয়েছেন মোদী ও কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন সোরেন। তাঁর আরও অভিযোগ ছিল যে আদিবাসী নেতা বলেই তাঁকে দুর্নীতির মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মোদী জেলে বন্দী করেছেন। কিন্তু মোদী এই নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
মোদী যদিও নিজেকে ফকির বলেছেন, জানিয়েছেন তাঁর কোনো সম্পদ নেই, কিন্তু ২০২৩ সালের ৩১শে মার্চে দায়ের করা সম্পত্তির খতিয়ানে তিনি দেখিয়েছেন যে তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ২.৫৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে তাঁর ব্যাঙ্কেই সঞ্চয় করা আছে ২.৪৭ কোটি টাকা। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে লড়ার সময় যে হলফনামা মোদী দিয়েছিলেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর ১.৪১ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে—ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ১.২৭ লক্ষ টাকা সহ। তখন তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে তাঁর কাছে গুজরাটের গান্ধীনগরে সেক্টর নং ১ – এ একটি ১.১০ কোটি টাকা মূল্যের, ৩,৫৩১ বর্গ ফুটের বাড়িও আছে যা তিনি পৈতৃক সূত্রে লাভ করেননি বরং ২০০২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই কিনেছিলেন। যদিও এই বাড়ির কথা ২০২৩ এর হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেননি।
সম্প্রতি অক্সফ্যাম তার বৈষম্যের রিপোর্টে দেখিয়েছে যে ভারতের ধনীতম ১% মানুষের হাতে দেশের ৪০% সম্পদ রয়েছে। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সৃষ্টি করা সম্পদের ৪০% যেমন ধনীতম ১% এর সিন্দুকে ঢুকেছে তেমনি উপর থেকে গড়িয়ে নিচের ৫০% দরিদ্রতম মানুষের হাতে এসেছে দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩%।
এরই মধ্যে পিউ রিসার্চের একটি অতিমারীর উপর করা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০২০ সালেই ভারতের মধ্য আয়ের (দৈনিক ১০ থেকে ২০ মার্কিন ডলার যাঁরা আয় করেন) শ্রেণীর থেকে ৩.২০ কোটি সদস্য কমে গেছে, অর্থাৎ এই মানুষগুলো দরিদ্রে পরিণত হয়েছে। একই সময়ে দেশের দরিদ্রদের (যাঁদের দৈনিক যায় ২ ডলার বা তারও কম) সংখ্যায় যোগ হয় নতুন ৭.৫ কোটি মানুষ। অর্থাৎ যে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছিল তীব্র গতিতে।
ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে মোদীর বক্তব্যের অনেকেই বিরোধিতা করলেও, তাঁর গরিব পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনীতি করার ঘটনা কে বিরোধীরা তেমন ভাবে আক্রমণ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু তথ্য দিয়ে দেখতে গেলে বোঝা যাবে যে মোদীর দাবি সঠিক নয়, ও তিনি ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সহ বিভিন্ন রাজ্যের জনজাতির মানুষ কে ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
প্রথমত, একজন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী বাৎসরিক ১৯ লক্ষ টাকার কাছাকাছি বেতন পান। এ ছাড়াও তিনি সরকারি খরচায় এলাহী জীবন যাপন করতে পারেন। তাঁর জন্যে সরকার বিশেষ ধরণের বিএমডব্লিউ বানিয়েছে। সরকার তাঁর যাতায়তের জন্যে এক সুবিশাল বিমান কিনেছে ৮,০০০ কোটি টাকা খরচ করে। দামি চশমা, কলম, জামা কাপড় পরা তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর) ও ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ (এনইডব্লিউ) এর তথ্য অনুসারে রাজ্যসভায় ২২৫ জন সাংসদের মধ্যে ১৪% বা ৩১জন সাংসদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার উপর। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি সাংসদ—নয় জন—বিজেপির। রাজ্যসভায় বিজেপির মোট ৯০টি আসনের ১০% ১০০ কোটির উপর সম্পদের মালিক। তার পরেই আছে অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের পাঁচ, জাতীয় কংগ্রেসের চার, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (ভারত রাষ্ট্র সমিতি) দলের তিন, আম আদমি পার্টির দুই, ও বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের দুই সাংসদ। লোকসভায় বিজেপির সব চেয়ে বেশি, নয় জন, এমন সাংসদ আছেন যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি।
তৃতীয়ত, মোদী উল্লেখ না করলেও দেশের মানুষের যা মনে আছে তা হলো যে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে যখন নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশ্যে আসে, তখন দেখা যায় যে বিজেপি ৫,৫৯৪.২০ কোটি টাকা পায় যা সমস্ত রাজনৈতিক দলের পাওয়া ১২,১৫৫ কোটি টাকার ৪৬%। অর্থাৎ, ভারতের রাজনীতির মঞ্চে বিজেপিই আইনত সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল।
চতুর্থত, ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড প্রতিষ্ঠার থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় সিংহভাগ সময়ই রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি থেকেছে। কখনো মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বাবুলাল মারান্ডি, কখনো অর্জুন মুন্ডা, তো কখনো রঘুবর দাস। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে যদি ২০১১ সালের সামাজিক-অর্থনৈতিক জাতি শুমারির তথ্যে দেখা গেছে যে ঝাড়খণ্ডের গ্রামীণ অঞ্চলে বাস করা যে আদিবাসীদের জন্যে এখন মোদী চোখের জল ফেলছেন, তাদের মধ্যে ৮১%, অর্থাৎ ১১.৮৪ লক্ষ পরিবার কর্তার মাসিক যায় ৫,০০০ টাকার কম ছিল। অর্থাৎ বিজেপির এক টানা প্রায় দশ বছর শাসনের পরেও ঝাড়খণ্ডের মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি সরকারের কর্পোরেট-বান্ধব নীতির বিরুদ্ধে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন জঙ্গল ও জমি কেড়ে তা কর্পোরেটদের উপঢৌকন দেওয়ার বিরুদ্ধে বারবার গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৭-১৮ সালের পাথলগাডি আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তফসিলি জনজাতির মানুষেরা নিজেদের জন্যে সংবিধান অনুসারে স্বায়ত্ত শাসনের দাবি তোলেন। আবার এই আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনা কে পুঁজি করেই ঝাড়খণ্ডে এককালে গড়ে ওঠে উগ্র-বামপন্থী আন্দোলন ও হিংসা যাতে অসংখ্য মানুষের প্রাণ যায়, বিশেষ করে নিরীহ গ্রামবাসীদের। এই নিয়েও মোদী বা তাঁর সরকার কোনো সদর্থক ভূমিকা নেয়নি, এবং ঝাড়খণ্ডের সরকার কে সংবিধানের বিধি মানতে বাধ্য করেনি।
মোদী সরকারের উপর নানা কারণেই দেশের মানুষের রাগ হয়ে থাকতে পারে। দশ বছর একটানা চলার পরেও যখন সরকারের অনেক প্রতিশ্রুতি বকেয়া থাকে তখন জনগণের মধ্যেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তীব্র হয়। কিন্তু নিজের দুর্বলতা কে অস্বীকার করে, শুধুই মিথ্যার বেসাতি নিয়ে যদি সরকার ফোঁকর গুলো ভরাট করার চেষ্টা করে তাহলে তো সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়েই একদিন। বর্তমান নির্বাচনে তীব্র ভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে নিজের পালে হাওয়া টানার প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার একটা অংশ হলো ফকির সাজা। আর এই বহুরূপীর খেলা দেখে জনগণ কী প্রতিক্রিয়া দেন, সেটাই এখন দেখার।