নবরাত্রির আমিষ-নিরামিষ ও মুঘলাই ফরমান বাঙালি হিন্দুর কালঘুম ছোটাবে কি?

সম্পাদকীয়

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি একটি নির্বাচনী জনসভায় বিরোধীদের অনেকের উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের নবরাত্রি উৎসবের সময়ে ও শ্রাবণ মাসে মাছ ও মাংস খাওয়ার ঘটনাকে কটাক্ষ করেন ও তাঁদের মুঘল মানসিকতার ধারক বাহক বলে সমালোচনা করেন। এই ভাবেই লোকসভা নির্বাচনের সময়ে তিনি ধর্মীয় মেরুকরণ করার চেষ্টা করছেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছে। এর সাথে সাথেই উত্তর ভারতীয় হিন্দু উৎসব নবরাত্রি উপলক্ষে নিরামিষ খাওয়ার রীতি অন্য জাতিদের উপরেও চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। 

এই ভাষণেই প্রধানমন্ত্রী বলেন যে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রাবণ ও নবরাত্রিতে নিরামিষ খান।

কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) নেতা তেজস্বী যাদব কে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থকদের রোষের মুখে পড়তে হয়। তিনি নবরাত্রি শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেই হেলিকপ্টারে করে প্রচারের ফাঁকে মাছ খাওয়ার একটি ভিডিও নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন। যদিও ঘটনাটি নবরাত্রি শুরু হওয়ার আগের তবুও বিজেপি সমর্থকেরা অভিযোগ করেন যে যাদব নাকি ইচ্ছা করেই হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করতে মাছ খাওয়ার ভিডিও পোস্ট করেছেন। যাদব ঘটনাটিকে হেলায় উড়িয়ে দিলেও, বিজেপির লোকেদের এই নীতি পুলিশ সাজার ফলে আগামী দিনে কি বাঙালি সহ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের অসংখ্য আমিষ আহারকারী হিন্দুদেরও সমস্যায় পড়তে হবে? 

কিছুদিন আগেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, যিনি নিজে একজন আমিষাহারী উত্তর ভারতীয় ঠাকুর সম্প্রদায়ের, ক্ষত্রিয় জাতির, প্রতিনিধি, তিনি যাদবের ঘটনাকে সমালোচনা করে বলেন যে মাছ-মাংস, হাতি-ঘোড়া যাই খাওয়া হোক না কেন, সেটা অন্যদের দেখানোর দরকার কী? সিংহের এই প্রশ্নও অনেকগুলো অন্য প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।  

অনেকের মতে পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যে, যেখানে বাঙালি শাক্ত হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে উত্তর ভারতীয় বৈষ্ণব হিন্দু রীতি কখনোই সমাজের উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। কিন্তু এই চিন্তার গোঁড়ায় সমস্যা রয়েছে। এককালে যেমন অনেকেই ভাবতেন পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যে কোনো দিনই বিজেপির বা তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে না। এই চিন্তার অসাড়তা প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হলো বিজেপি। শূন্যে চলে গেছে বামপন্থীদের আসন সংখ্যা। 

যে রাজ্যে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে দাঙ্গা হয়নি তৎকালীন রাজ্য সরকারের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কারণে, যে রাজ্যে ২০০২ সালের গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার পরে হিংসার থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসেন সেই ঘটনায় আক্রান্ত সংখ্যালঘু মুখ হিসাবে পরিচিত হওয়া কুতুবুদ্দিন আনসারি, সেই রাজ্যেই বর্তমানে ফি বছর সরকার ও প্রশাসনের নাকের ডগায় (নিন্দুকেরা বলেন শাসকদলের নিজ স্বার্থে) রাম নবমীর মতন একটি অবাঙালি উৎসব কে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতের মতন সংখ্যালঘু অঞ্চলে আক্রমণ সংগঠিত করা হয়, সেখানে যে শীঘ্রই কোনোদিন নবরাত্রি উপলক্ষ্যে আমিষ বর্জন করার আন্দোলন শুরু করবে না আরএসএস-র ছত্রছায়ায় থাকা নানা সংগঠন সে কথা কে হলফ করে বলতে পারে? 

দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় আন্দোলনের কেন্দ্র তামিলনাড়ু বা বাম আন্দোলনের ঘাঁটি কেরলে আরএসএস-র পক্ষে যে ভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক কে মজবুত করা শক্ত, সে ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গভঙ্গের পর থেকে জমে থাকা ইসলাম বিদ্বেষের আঁচে হাওয়া দিয়ে তাকে তীব্র করা হচ্ছে, এই সকল উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের রীতি চাপিয়ে দেওয়া তুলনামূলক ভাবে সহজ। 

এর একটা বড় প্রমাণ হলো রাজ্যের নানা কোনায় গত দশ বছরে হুহু করে বৃদ্ধি পাওয়া হনুমান মন্দিরের পরিসংখ্যান। এই মন্দিরগুলো কারা স্থাপন করলো? কী ভাবে নানা অঞ্চলে রাম নবমী কে কেন্দ্র করে হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হলো? কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত প্রগতিশীল মননের বাঙালি হিন্দু এই সব মেনে নিয়ে নিজের অন্তরের ইসলাম বিদ্বেষ কে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করলো? এই প্রশ্নগুলোর জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে থাকছে এই রাজ্যের মানুষের খাদ্যাভাস কে অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তন করার আরএসএস-র পরিকল্পনার সফলতার চাবিকাঠি।  

আর পশ্চিমবঙ্গের আরও একটি বিষয় এই ক্ষেত্রে আরএসএস কে সহায়তা করবে। সেটা হলো গত দেড় দশক ধরে তীব্র গতিতে বেড়ে চলা হিন্দি-ভাষী উত্তর ভারতীয়দের জনসংখ্যা। আরএসএস ও বিজেপি এই বিপদ, যার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের জনবিন্যাস পরিবর্তন হচ্ছে, বাংলা ও স্থানীয় অন্যান্য ভাষাভাষীর ভূমি পুত্র ও কন্যারা সংখ্যালঘু হচ্ছেন দিন দিন, তার থেকে নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে সাধারণ বাঙালি হিন্দুর।  

বারবার অকাট্য প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করা হচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে বাঙালি মুসলিমরা অনুপ্রবেশ করে নাকি রাজ্যের জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে। কিন্তু যেটা চোখের সামনে দেখা গেছে যে ২০০১ সালের ৫৭.৪৭ লক্ষ থেকে বেড়ে যে হিন্দি ভাষীদের জনসংখ্যা ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৬৩.৫৬ লক্ষ হয়েছিল, সেটা গত ১৩ বছরে আরও কতগুণ বেড়েছে যে এই রাজ্যেরই নানা প্রান্তে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিরোধী বিজেপিকে অবাঙালি, হিন্দি-ভাষী প্রার্থীদের উপর নির্ভর করতে হয়? কী ভাবে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে যখন এই রাজ্যের থেকেই কাজের খোঁজে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ও অন্যান্য বঙ্গীয় জনজাতির মানুষ কে কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে? 

এর সাথে সাথেই এটাও লক্ষণীয় যে গত কয়েক বছর যাবৎ যে সব অঞ্চলে রাম নবমী কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই হিন্দি-উর্দু ভাষী উত্তর ভারতীয়দের অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। গত বছর রাম নবমীর অনেক দিন পরে হঠাৎ যখন দিলীপ ঘোষ রিষড়া অঞ্চলে রাম নবমীর মিছিল বের করেন ও তাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বস্তিগুলোতে আক্রমণ করা হয়, তখনো হিংসার ঘটনা রিষড়ার গঙ্গার তীর সংলগ্ন হিন্দি ভাষী অঞ্চলেই সীমিত ছিল। হাওড়া-দিল্লী মেন লাইনের বাম দিকে অবস্থিত বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম অঞ্চলে কিন্তু এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। তেমনি শিবপুর থেকে আসানসোল, প্রতিবারই হিংসার ঘটনায় সামনে আসছে অবাঙালি-হিন্দিভাষী অঞ্চলগুলোই।  

দীর্ঘ বাম শাসন বা তার আগের তিন দশকের কংগ্রেস শাসনেও কোনো মুখ্যমন্ত্রী কে যে রাজ্যে কোনোদিন হিন্দি ভাষায় ভাষণ দিতে হয়নি——এমনকি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মতন দিল্লির কোলের ছেলে বলে খ্যাত নেতাকেও না——সেখানে কী ভাবে জনবিন্যাসের পরিবর্তন হয়ে থাকলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে তাঁর হাস্যকর উচ্চারণ দিয়ে হিন্দি বলতে হয়, তাও আবার “বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন” নামক জনগর্জন ব্রিগেডে?  

যখন রাজ্যের জনবিন্যাস পরিবর্তন হচ্ছে, যখন আসানসোল, রাণীগঞ্জ, দুর্গাপুর থেকে হাওড়া ও ব্যারাকপুর পর্যন্ত হিন্দি ভাষীরা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে, যখন পূর্ব রেল, সেল, ইসিএল, প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সংস্থায় ভূমি পুত্র বা কন্যার নয়, চাকরি হচ্ছে বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আগত হিন্দিভাষীদের, তখন যে রাজ্যের অর্থনীতির চালিকা শক্তি তারাই হয়ে উঠছে সে ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে?  

তাহলে মোদী যে ভাবে বিরোধীদের আজ হিন্দু-বিরোধী বলে আক্রমণ করছেন নবরাত্রিতে বা শ্রাবণ মাসে আমিষ খাওয়ার জন্যে সেটা পশ্চিমবঙ্গে কিছুদিন পরে শুভেন্দু অধিকারীরা করবেন না তার কি কোনো ন্যূনতম বস্তুগত গ্যারান্টি থাকছে? 

১৯৪৭ সালে যখন শ্যামাপদ মুখার্জী বড়লাট কে বঙ্গ ভঙ্গ করার জন্যে চিঠি দিচ্ছিলেন, তখন যেমন বাঙালি হিন্দু নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিল, তেমনি বর্তমানে যখন তার অধিকারের জমি আর রোজগারের সুযোগের সাথে সাথেই তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও রীতির উপরও হিন্দুত্ববাদী খড়্গের কোপ পড়ছে, তখনো সে নাক ডাকছে। যখন ঘুম ভাঙবে তখন সে কি তার তোষক-বালিশও খুঁজে পাবে? এই প্রশ্নটাই ১৪৩১ বঙ্গাব্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।  

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


আপনার মতামত জানান