বঙ্কিমচন্দ্রকে হিন্দুত্বের মুখপাত্র বানানোর প্রচেষ্টা কার অস্বস্তি বাড়াবে?
বন্দে মাতরমের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে লোকসভায় দশ ঘণ্টার বিশেষ বিতর্ক হলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিম দা’ সম্বোধন করলেন—বাংলার সাংস্কৃতিক শিষ্টাচারে যা অনভিপ্রেত। সংস্কৃতি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত তো তাঁর নাম ভুল করে বললেন ‘বঙ্কিম দাস চট্টোপাধ্যায়’। এই ভুলগুলো শুধু অজ্ঞতার নিদর্শন নয়—এ হলো শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তার পিতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্পকে ব্যবহার করে আরএসএস ইতিহাসকে হাতিয়ার বানাতে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে মোদী সরকারের ছত্রছায়ায়।
পশ্চিমবঙ্গের ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি ও আরএসএস হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘হিন্দু প্রতিরোধের’ আইকন হিসেবে হাজির করছে। কিন্তু এর ফলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বা আরএসএস এর যত না লাভ তার চেয়ে বেশি হলো সমস্যা।
বঙ্কিমের সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজদর্শনের মূল স্রোত বিজেপি ও আরএসএস-এর প্রকল্পের সঙ্গে মানানসই নয়। বরং দুইয়ের মধ্যে রয়েছে এক তীব্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। যে বঙ্কিম লিখেছিলেন ‘ভূমিতে সকলের সমান অধিকার’, যিনি বিড়ালের মুখ দিয়ে পুঁজিবাদের সমালোচনা করেছিলেন, যিনি জাতিভেদকে ‘প্রাকৃতিক বিধানের বিরুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন—তাঁকে হিন্দু মেরুকরণের হাতিয়ার বানানো বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি গভীর অবিচারই শুধু নয়, আরএসএস যে বৌদ্ধিক দীনতার প্রতীক, সেটাই সজোরে ব্যক্ত করে।
সাম্যের দার্শনিক: যিনি জাতিভেদকে ‘জঘন্য’ বলেছিলেন
উনিশ শতকের সাতের দশকে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাম্য’ শীর্ষক পাঁচটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই রচনাগুলো পড়লে স্পষ্ট হয় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কতটা প্রগতিশীল ছিল। হিন্দু ধর্মে জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: “মানুষে মানুষে যত অন্যায্য পার্থক্য মানুষ সৃষ্টি করিয়াছে, ভারতবর্ষের জাতিভেদ তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা তীব্র ও সর্বাপেক্ষা জঘন্য।” আরও স্পষ্ট করে বলেন: “ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের মধ্যে পার্থক্য কৃত্রিম পার্থক্য। ব্রাহ্মণ হত্যা মহাপাপ, শূদ্র হত্যা লঘু অপরাধ—এ সকল নিয়ম প্রকৃতির বিধানের বিরুদ্ধে।”
এই যে জাতিভেদকে ‘প্রাকৃতিক বিধানের বিরুদ্ধ’ বলা—এ কি আরএসএসের বর্ণাশ্রম দর্শনের সাথে খাপ খায়?
ভূমি মালিকানা বিষয়ে বঙ্কিমের বক্তব্য আরও তীক্ষ্ণ। তিনি লিখেছিলেন: “সম্পত্তি ব্যক্তিগত নহে, সর্বসাধারণের। যে পৃথিবী সকলের জীবন ধারণ করে, তাহা কোনও একজন ব্যক্তির জন্য সৃষ্টি হয় নাই। অতএব ভূমিতে সকলের সমান অধিকার।” এই বাক্যে জঁ-জাক রুশো ও পিয়ের-জোসেফ প্রুদোঁর প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
নারী অধিকার বিষয়েও বঙ্কিম তাঁর সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার থাকা উচিত এবং “শিক্ষাই নারীকে জীবিকা অর্জনের সামর্থ্য দিবে।”
কমলাকান্তের বিড়াল: শোষণবিরোধী শ্রেণীচেতনা
বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার কেন্দ্রে ছিল সমাজ সংস্কার, শ্রেণীচেতনা, শোষণবিরোধী অবস্থান এবং উপনিবেশ সমালোচনা। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ সংকলনের ‘বিড়াল’ রচনাটি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে বিড়ালের মুখ দিয়ে বঙ্কিম পুঁজিবাদী অর্থনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিড়ালটি বলে: “ধনীদের জন্যেই যে দরিদ্র চোর হয়, তাহা কি দেখিতে পাও না? কেন একজন পাঁচশত জনের খাদ্য সঞ্চয় করিয়া রাখিবে, সেই পাঁচশত জনকে বঞ্চিত করিয়া?”
কমলাকান্ত যখন প্রতিবাদ করে বলে “থাম, থাম রে বিড়াল! তুই তো একেবারে সোশ্যালিস্টদের মতো কথা কহিতেছিস!”—তখন বঙ্কিম স্পষ্টতই সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে স্বীকৃতি দেন। ভারত সরকারের Indian Culture পোর্টালে প্রকাশিত দলিল অনুযায়ী, বঙ্কিমচন্দ্রের রাজনৈতিক দর্শনে “কমতীয় দৃষ্টবাদ, বেন্থামের উপযোগবাদ, জন স্টুয়ার্ট মিলের সামাজিক ও লিঙ্গ দর্শন এবং ফরাসি সমাজতন্ত্রের ধারা”—সবকিছুরই প্রভাব ছিল।
বাংলার কৃষকের প্রতীক কেন তাঁর কাছে হাশিম শেখ ও রামা কৈবর্ত? কারণ ধর্ম নয়, শোষণ-নির্ভর শ্রেণী কাঠামো তাঁকে বেশি ভাবাত। অন্তত তাঁর কাজ সেই কথাই বলে। কাজেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তাঁকে দিয়ে চালানো মানে বঙ্কিমকে ভুল করে পড়া, অথবা সচেতনভাবে বিকৃত করা।
আর বিজেপি যে শেষটি করছে সেটার প্রমাণ দিয়েছিলেন বিজেপির নেতা তথাগত রায় তাঁর সামাজিক মাধ্যমে হাশিম শেখ ও রামা কৈবর্ত আলাদা রাস্তা ধরেছেন বলে।
আনন্দমঠের ইসলামিক আগ্রাসন—রূপক না বাস্তব?
বিজেপি আনন্দমঠের সামান্য কিছু অংশকে ছিঁড়ে এনে তা আজ মুসলিমবিদ্বেষের ব্যাখ্যা হিসেবে রটাচ্ছে। কিন্তু গবেষণা বলছে, বঙ্কিম ইসলামিক আক্রমণের বর্ণনা ব্যবহার করেছিলেন মূলত উপনিবেশবিরোধী ক্ষোভকে আড়াল করতে।
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নাকুল কুন্দ্রা তাঁর একাডেমিক গবেষণায় দেখিয়েছেন: “বঙ্কিম এই উপন্যাস লিখেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আক্রমণে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার গোপন উদ্দেশ্যে, এবং মুসলমানদের সমালোচনা ছিল কেবল আকস্মিক।” তাঁর যুক্তি হলো যে “মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা ছিল ব্রিটিশদের বিভ্রান্ত করার এক কৌশল”।
ফলে সন্ন্যাসী আন্দোলনের পটভূমিতে ধর্মীয় আগ্রাসনের কথকতা আসলে ছিল একটি সাংকেতিক পর্দা। বাস্তবে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক দখল, সামাজিক নিপীড়ন ও প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতা।
তিনি তখন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী; সরাসরি ব্রিটিশ-বিরোধী বক্তব্য দেওয়া ছিল অসম্ভব। ব্রিটিশ সরকারের আমলা হলেও বঙ্কিম ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধী। ব্রিটিশ শাসনকে তিনি কখনোই ব্যঙ্গ করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
রামকৃষ্ণ পরমহংস একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর নাম ‘বঙ্কিম’ (বাঁকা) কেন—বঙ্কিম রসিকতা করে বলেছিলেন “ইংরেজের জুতোর লাথিতে বেঁকে গেছি”।
আরও গুরুত্বপূর্ণ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ—যা আনন্দমঠের ঐতিহাসিক পটভূমি—সেটি ছিল হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ফকিরদের যৌথ ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহ। The Week পত্রিকার গবেষণা অনুযায়ী এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল। বঙ্কিম উপন্যাসে মুসলিম ফকিরদের ভূমিকা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছেন—এটি ইচ্ছাকৃত কৌশলগত নির্বাচন।
অতএব বিজেপি আর আরএসএস-এর দাবি যে আনন্দমঠ মুসলমানদের ‘শত্রু’ হিসেবে হাজির করে—তা শুধু এই ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্মের অতিসরলীকরণই নয়, বরং বিকৃতকরণ।
ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের চন্দ্রিমা চক্রবর্তী তাঁর “Reading Anandamath, Understanding Hindutva” প্রবন্ধে আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির বঙ্কিমকে বিকৃত করার প্রয়াস নিয়ে লিখেছেন: “সঙ্ঘের লক্ষ্য হলো বঙ্কিমের রচনার দ্ব্যর্থতা ও দ্বন্দ্ব চাপা দিয়ে ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়গুলোকে ‘জাতীয়’ সম্প্রদায়ের সাধারণ বোধ হিসেবে উপস্থাপন করা”।
বন্দে মাতরমের বহুত্ববাদী ইতিহাস বিজেপির পথের কাঁটা
মোদী তাঁর ভাষণে বারবার যদিও উল্লেখ করেছেন যে বন্দে মাতরম স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে, তিনি কিন্তু অভিযোগ করেছেন যে কংগ্রেস—এবং যে সময়কালের কথা তিনি বলছেন তখন সুভাষ চন্দ্র বোস পর্যন্ত কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন—মুসলিম তোষণের স্বার্থে বন্দে মাতরম কে কেটে ছেঁটে দেয়। তিনি অভিযোগ করেন যে এই মুসলিম তোষণের জন্যে যেই বন্দে মাতরম ভাগ হলো তেমনি বাংলা ভাগ হলো, পাঞ্জাব ভাগ হলো। কিন্তু বন্দে মাতরম কি মুসলিম-বিরোধী গান?
বন্দে মাতরম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র দুই ধারাকেই উজ্জীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ভগৎ সিংহ ও তাঁর সমাজতান্ত্রিক সহকর্মীরা মৌলানা হাসরাত মোহানির দেওয়া ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার আগে পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের মূল মন্ত্র ছিল বন্দে মাতরম। আর এই আনন্দমঠ পাঠ করে বা বন্দে মাতরম ধ্বনি তুলেও কিন্তু তৎকালীন বঙ্গের সশস্ত্র সংগ্রামীরা কখনোই মুসলিমদের বস্তিতে আগুন দিতে যাননি। মুসলিমদের রাস্তায় ফেলে, মারধর করে জয় শ্রী রাম বলানোর প্রচেষ্টাও বঙ্গীয় সশস্ত্র সংগ্রামীরা করেনি কোনোদিন।
ঐতিহাসিক রেকর্ডে নেই যে ঔপনিবেশিক শাসন আমলে বন্দে মাতরম কোনওদিন মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা উসকে দিয়েছে। গানটি বিপ্লবীদের কাছে ছিল উপনিবেশবিরোধী মন্ত্র—সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের আহ্বান নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্থান-পর্বে বন্দে মাতরম ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সার্বভৌম প্রতীক—হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের। ব্রিটিশ সরকার গানটি নিষিদ্ধ করেছিল কারণ এটি উপনিবেশবিরোধী জনতাকে সংগঠিত করছিল, তাঁদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করছিল।
ক্ষুদিরাম বসু মাত্র আঠারো বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেষ উচ্চারণ করেছিলেন “বন্দে মাতরম”। মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে “বন্দে মাতরম” ও “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ধ্বনির মধ্যে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেছিলেন। বিনয়-বাদল-দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের সময় এই শ্লোগান দিয়েছিলেন।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯০৬ সালে বরিশালে দশ হাজারেরও বেশি হিন্দু ও মুসলমান একসাথে বন্দে মাতরম পতাকা নিয়ে মিছিল করেন। আবদুল রসুল নামের এক মুসলিম ব্যারিস্টার ১৯০৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে বন্দে মাতরম গেয়েছিলেন। গবেষণায় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে বাংলার বিপ্লবীরা বন্দে মাতরম হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ব্যবহার করেছেন।
বিজেপি আজ এই ঔপনিবেশিক-বিরোধী চেতনার উন্মেষ করা গানকে শুধুমাত্র হিন্দুত্বের আবেগে আটকে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখনই ইতিহাসের আলো পড়বে, দেখা যাবে গানটি কখনই ধর্মীয় বিভাজনের অস্ত্র ছিল না—এটি ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতীক, যা হিন্দুত্বের সংকীর্ণ প্রকল্পের সাথে খাপ খায় না। বহুত্ববাদী ইতিহাসের এই বাস্তবতা বিজেপির জন্য একটি কাঠগড়ায় পরিণত হয়েছে। তাদের নির্বাচনী প্রচারে বন্দে মাতরম ব্যবহারের যে ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে, তা ইতিহাসের পরীক্ষাতেই ভেঙে পড়ে।
মুসলিম চরিত্র চিত্রণ: দুর্গেশনন্দিনীর আয়েশা
বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলিম-বিদ্বেষী বলা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের একপেশে পাঠ। তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে আয়েশা চরিত্রটি এক পাঠান মুসলিম রাজকন্যা, যিনি জটিল, সহানুভূতিশীল ও নৈতিকভাবে উচ্চ অবস্থানে চিত্রিত। আয়েশা তাঁর পিতার হাত থেকে হিন্দু নায়িকা তিলোত্তমাকে রক্ষা করেন, নিজের প্রেমকে ত্যাগ করে হিন্দু প্রেমিক যুগলকে মিলিত হতে সাহায্য করেন।
‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে বঙ্কিম লিখেছেন: “যাহার পক্ষে ধর্মের গুণ ছিল—হিন্দু হউক বা মুসলমান—সেই শ্রেষ্ঠ”। নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া—এ কি সাম্প্রদায়িক লেখকের কাজ?
বাস্তব জীবনেও বঙ্কিম হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। নীল বিদ্রোহের সময় যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি সর্বদা চাষিদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। পাবনা কৃষক আন্দোলনকেও তিনি সমর্থন করেন—এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম কৃষক একসাথে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। অর্থাৎ, বঙ্কিমের ঐতিহাসিক অবস্থান বহুধর্মীয় সমাজের বাস্তবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল; তার রাজনৈতিক ভাষা কখনই মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে নয়।
বঙ্কিমকে হিন্দুত্বের মুখ বানানোর তিন রাজনৈতিক বিপদ
বঙ্কিমচন্দ্রকে বিজেপি যত বেশি নিজের প্রতীক করতে চাইবে, তত বেশি তাদের রাজনৈতিক সঙ্কট বাড়বে। কারণ বঙ্কিমের সাহিত্য-চিন্তাধারার সঙ্গে বর্তমান দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আদর্শগত পার্থক্য এতটাই প্রকট যে উল্টে সেই প্রকল্পই বিজেপির বিরুদ্ধে যুক্তি জোগাবে।
এই সংঘাত তিনটি জায়গায় সবচেয়ে তীব্র।
প্রথম, বাঙালি ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক হলেও, তৎকালীন পরিস্থিতিতে বঙ্কিমের শ্রেণীচেতনা, শোষণবিরোধিতা ও সাম্যচিন্তা বিজেপির অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। যে বঙ্কিম লিখেছেন “সম্পত্তি সর্বসাধারণের” এবং “ধনীদের জন্যেই দরিদ্র চোর হয়”—সেই বঙ্কিমকে কর্পোরেট-বান্ধব, নব্য-উদারনৈতিক বিজেপির প্রতীক বানানো নিজেই একটি স্ববিরোধিতা।
দ্বিতীয়, বন্দে মাতরম বহুকাল ধরে এক নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয়ে আটকে ছিল না। আজ তাকে সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা যত বাড়ে, ততই বিজেপির উদ্দেশ্য নগ্ন হয়ে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে বন্দে মাতরম ছিল বহুধর্মীয় বিপ্লবী আন্দোলনের শ্লোগান। এটি কখনোই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদীরা ব্যবহার করেনি।
তৃতীয়, বঙ্কিমের জাতিভেদ-বিরোধী, নারীমুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদী দর্শন আরএসএসের সামাজিক দর্শনের সাথে, যা মনু সংহিতা নির্ভর, সরাসরি সংঘর্ষে যায়। ফলে সাহিত্যিকের প্রকৃত মুখোশ খুলে দেখালেই বোঝা যায়—তিনি হিন্দুত্বের মঞ্চে আসলে ব্যবহারযোগ্য নন। বরং তিনি হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী একটি আইকন।
বিপজ্জনক সরলীকরণ ও বাংলার প্রতিরোধ
বিজেপি যে খেলা খেলছে তা শুধু ইতিহাস বিকৃতি নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি আক্রমণ। বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয় সর্বদাই ছিল ব্যাপক, বর্জনকামী নয়। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও কাজী নজরুল ইসলাম—বাংলা তার মনীষীদের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিবৃত্তির জন্য শ্রদ্ধা করে, ধর্মীয় মতাদর্শের জন্য নয়।
বিজেপির হাতে গোনা কিছু বাঙালি নেতারাও এই কৌশলের ত্রুটি বুঝেছেন। সাংসদ অভিজিৎ গাঙ্গুলী অনেক আগেই বলেছেন: “যে অ-বাংলাভাষী নেতারা বাংলার আবেগ ও গর্ব বুঝতে পারেন না, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করতে পারবেন না।” সাম্প্রতিক কালে বিজেপির বাংলা-বিরোধী কাজকর্ম —অমিত মালব্যের “বাংলা বলে কোনো ভাষা নেই” মন্তব্য, জেপি নাড্ডার রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান নিয়ে ভুল তথ্য, ২০১৯ সালে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা—বাঙালি ভোটারদের বিরক্ত করেছে। এর লাভ তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। বন্দ্যোপাধ্যায় সাংস্কৃতিক বিতর্ককে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তরিত করে বিজেপিকে “বাংলা-বিরোধী” তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন।
ইতিহাসের ওপর দাঁড়ানো যায়, তাকে বিকৃত করে নয়
যদি বিজেপি ভাবে যে বঙ্কিমচন্দ্রকে হিন্দুত্ববাদী আইকনে রূপান্তরিত করলে নির্বাচনী লাভ হবে, তা সাময়িক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি নয়। কারণ বঙ্কিম হলেন একজন বহুমাত্রিক সাহিত্যিক, উপনিবেশ সমালোচক, সমাজসংস্কারক। তাঁর রচনাকে একমাত্রিক সাম্প্রদায়িক কাঠামোয় বাঁধার যেকোনো প্রয়াস—হিন্দুত্বের প্রকল্প সহ—শেষ পর্যন্ত উল্টো ফলই বয়ে আনে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমন এক লেখক যিনি লিখেছিলেন “ভূমিতে সকলের সমান অধিকার”, যিনি বিড়ালের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন “ধনীদের জন্যেই দরিদ্র চোর হয়”, এবং যিনি বিশ্বাস করতেন “সর্বজনীন প্রেম” ছাড়া হিন্দুত্ব হতে পারে না, তাঁকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার বানানো শুধু ইতিহাসের অপমান নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিও অপমান।
বঙ্কিমের প্রকৃত পাঠ বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। তাঁর সাহিত্যই বলে—শোষণ, বৈষম্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সংগ্রামী; ধর্মীয় বিভাজনের পক্ষে বঙ্কিম কখনই নন। বাংলার মানুষ জানে তাদের সাংস্কৃতিক নায়করা কারা এবং তারা কিসের জন্য লড়েছিলেন। বঙ্কিমকে যখন হিন্দু মেরুকরণের প্রতীক বানানোর চেষ্টা হয়, তখন আসলে তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারই ধ্বংস করা হয়—যা ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তিবাদ ও সর্বজনীন মানবতাবাদে।
অতএব, বঙ্কিমকে যেভাবে বিজেপি ব্যবহার করতে চায়, সেই প্রয়াস শেষ পর্যন্ত তাদেরই রাজনৈতিক অসুবিধা বাড়ায়—কারণ ইতিহাস, সাহিত্য এবং বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং—তারা কেউই বিজেপির বয়ানকে সমর্থন করে না। এই বিকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে শুধু একজন লেখককে রক্ষা করা নয়, বাংলার বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আত্মাকে রক্ষা করা।

