মুসলিম মানেই জঙ্গি: শিশুদের মধ্যে কেন বাড়ছে ধর্মান্ধতা?

সাম্প্রদায়িকতা

জম্মু ও কাশ্মীরের বৈষ্ণদেবী মেডিক্যাল কলেজে বিয়াল্লিশ জন মুসলিম ছাত্র ভর্তি হওয়ায় বিরোধিতা করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সহ বেশ কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। উধমপুর কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টে বলেছেন, “শ্রী মাতা বৈষ্ণদেবীর ভক্তদের অনুদান থেকে নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে মন্দিরের পবিত্রতা প্রতিফলিত করে সম্পূর্ণরূপে কাজ করতে হবে। এর জন্য শ্রাইন বোর্ড আইন এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংশোধন আনা এখন অপরিহার্য।” এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা। যেখানে একজন এনজিও কর্মী কর্মসূত্রে একটি স্কুলে গিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলেন – ‘মুসলিম মানেই জঙ্গি’।  এখানেই শেষ নয়, ওই সমাজকর্মীকে আরও শুনতে হয়েছিল-  “আপনার বাড়ি কলকাতায়? ওখানে তো চারিদিকে মুসলিম ভর্তি।” বলে রাখা প্রয়োজন স্কুলটি বিজেপি শাসিত ত্রিপুরায়। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো বক্তা ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স ৮-১০ বছর। অর্থাৎ একেবারে ছোট্ট থেকেই এইসমস্ত ছাত্র -ছাত্রীদের মনে রোপিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ।

 প্রশ্ন হল এমন চিন্তা—ভাবনার বীজ কোথায় লুকিয়ে? যে বয়সে বাচ্চারা সাইকেল চড়তে শিখবে, আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে কানামাছি, কুমির-ডাঙা কিংবা ক্রিকেট, ফুটবল খেলে সময় কাটবে ঠিক তেমনই বয়সে আজকালকার বাচ্চাদের একটি বড় অংশের মনে এমন ধর্মান্ধতা, এমন হিংসার জন্ম হচ্ছে কীভাবে? 

ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যে আগেও এ জিনিস ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্রের মতো বহু কালজয়ী সাহিত্যিকের লেখাতেও বিভিন্ন সময় মুসলিমদের নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। বঙ্কিম লিখছেন – “ভাই এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” আবার ভবানন্দের মুখে শোনা যায় – “এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?” অন্যদিকে শরৎচন্দ্র তো তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে বলেই দিচ্ছেন – “আজ বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ”।  এর অর্থ মুসলিমদের বাঙালি বলে মেনে নিতে শরৎচন্দ্রের মধ্যেও দ্বিধা ছিল।

আর একটু গভীরে ঢুকলে অবশ্য বোঝা যায় মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসও বাংলায় বিরল নয়। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর এক বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন, “বাংলার জনসাধারণ জৈন নহেন, বৌদ্ধ নহেন, খৃষ্টান নহেন, মুসলমান নহেন, হিন্দু নহেন – ইহারা বাঙালি।” এর থেকে স্পষ্ট কিছুক্ষেত্রে দুই ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব – দ্বেষ থাকলেও পাশাপাশি সহাবস্থান এবং সহনশীলতা ছিল সম্পূর্ণ মাত্রায়। ফলে কখনোই এই দ্বন্দ্ব বেআব্রু হয়ে পড়েনি। এপ্রসঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেনের একটি লেখার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখছেন – “মুসলমান আক্রমণে তীর্থমন্দির ও নানাবিধ ধর্মক্ষেত্র বারংবার বিপন্ন হইল সত্য, কিন্তু ধর্মের প্রধান স্থান হৃদয়মন্দির ক্রমে জাগ্রত হইয়া উঠিতে লাগিল।”

বর্তমান সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সব থেকে বড় প্রশ্ন হল এই সহনশীল ভারতের ছবি কেন ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে? এর পিছনে রাজনৈতিক কারণগুলি ঠিক কী? উত্তরটা দেওয়া খুব একটা কঠিন নয়, কিছু বছর আগে ঝাড়খণ্ডের এক নির্বাচনী জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন — সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে তাদের পোশাক দেখে চিনে নেওয়া যায়। মোদী কোন সম্প্রদায়ের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই প্রধানমন্ত্রীকেই যখন তার দল গোটা দেশের কাছে ‘মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তখন দেশের একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ যে তাঁর মাধ্যমে প্রভাবিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আসলে দেশের অভ্যন্তরের প্রকৃত সমস্যাগুলি থেকে সাধারণ জনগণকে যদি দূরে সরিয়ে রাখা যায় তাহলেই শাসকের কার্যসিদ্ধি। আর এই কাজ যদি করা যায় একদম শৈশব থেকেই তাহলে তো কথায় নেই। দেশের আট থেকে আশি যখন খিদের মুখে পেটে গামছা বেঁধে পাকিস্তানে বোম মারতে ব্যস্ত তখন এ আর নতুন কী? সুতরাং একের পর এক নারকীয় ধর্ষণ, বেকারত্ব, সরকারি মদতে আদানি-আম্বানিদের অন্তহীন ছ্যাবলামি থেকে দিল্লির দূষণ সবকিছু থেকে নজর ঘোরাতে অস্ত্র একটাই—একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে জঙ্গি তকমা দিয়ে সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি কর, সুচিন্তিতভাবে দেশের জনগণকে ভাবতে বাধ্য কর বিশেষ ওই সম্প্রদায়ের মানুষ তোমাদের শত্রু। এটুকু করতে পারলেই নিশ্চিন্ত…। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলছেন, “আগে বহু দ্বন্দ্বের মাঝেও একধরনের সামাজিক বন্ধন ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি সেই বন্ধন ছিঁড়ে দিয়েছে। একুশ শতকের বাঙালির ইতিহাস আসলে আলাদা হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। যার শিকার হচ্ছে শিশুরাও।”

উনি আরও বলেন, “একদম প্রি-স্কুল লেভেল থেকে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তুমি ওই বিশেষ সম্প্রদায়ের বন্ধুটির সঙ্গে মিশবে না, খেলবে না। ওকে নোটস দেবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই বাচ্চাটি বায়াসড হয়ে পড়ছে। যার মারাত্মক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সে যখন বড় হচ্ছে।” 

ভেবে দেখলে বোঝা যায় কথাটি ভুল নয়। আসলে গোটা গেমপ্ল্যানটি সাজানো হয়েছে যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই। বদলে দেওয়া হচ্ছে সিলেবাস। বছর দুয়েক আগে এনসিআরটির সিলেবাস থেকে বাদ গিয়েছিল মোগল যুগের ইতিহাস, নারী আন্দোলনের কথা, ডারউইনের তত্ত্ব। গেরুয়া শিবিরের নির্দিষ্ট এজেন্ডাকে রূপ দেওয়ার জন্যই সিলেবাসে এই পরিবর্তন বলে সেই সময় অভিযোগ উঠেছিল। যদিও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে মহাশ্বেতা দেবী অনেকের লেখায় বাদ পড়েছে পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে রামদেব কিংবা যোগী অদিত্যনাথের লেখা।

অর্থাৎ, শিশুরা প্রথম থেকেই প্রোপাগান্ডামূলক ইতিহাস শিখছে, সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই তারা ভুলে যাচ্ছে প্রশ্ন তুলতে।  অর্থাৎ, শাসক যা চায় ঘটছে ঠিক সেটাই। সেই সঙ্গে একথাও অস্বীকারের উপায় নেই আজকাল অভিভাবকদের একটা বড় অংশের মধ্যে মুসলিমরা যে এদেশের শত্রু এমন ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ভুয়ো খবর। যার মাশুল দিতে হচ্ছে বাচ্চাদের।

 রাজনীতির পাশাপাশি বর্তমান সময়ের সামাজিক অবস্থাও অবশ্য এর জন্য দায়ী। এই প্রসঙ্গে মনোবিদ অপর্ণা চক্রবর্তী বলছেন, “আজকাল বাবা – মায়েদের আরও বেশি করে সচেতন হওয়া উচিত। প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে এমনিতেই আজকালকার বাচ্চারা বন্ধু হতে ভুলে যাচ্ছে। প্রথমের জায়গায় দ্বিতীয় হলে তাদের মনে জাঁকিয়ে বসছে হতাশা। এবং সেই হতাশা থেকেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চারা অতিরিক্ত আগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছে।” 

“সুতরাং অভিভাবকদের আরও যত্নবান হতে হবে। বাচ্চাদের বোঝাতে হবে পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এসব বন্ধুত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না,” চক্রবর্তী আরও জানান।  

মনোবিদ দেবাঞ্জন ভট্টাচার্যের মতে, “এর দায় সম্পূর্ণভাবেই বাচ্চার বাবা – মায়ের। তারা নিজেরাই অনেকসময় এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা বলে থাকেন। বাচ্চারা কুইক লার্নার, ফলে তারাও এগুলো শিখে ফেলে। পরে ভুল শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বেশিরভাগ সময়ে তা সম্ভব হয় না। বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি নাক কুচকোনো ভাবটা থেকেই যায়।”

আজকের বাঙালি তথা গোটা ভারতবাসী কিন্তু এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। একটি সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে, তাদের দৈনন্দিন যাপনের উপর বাধাদান, ধর্মের অজুহাতে খাদ্যাভ্যাসের উপর বিধিনিষেধ আরোপ এবং সর্বোপরি সমগ্র সম্প্রদায়কে জঙ্গি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া – কোথাও গিয়ে সামগ্রিকভাবে সেই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দেশের মাটি, মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার প্রয়াস। যাতে  অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছি আমরাও, জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ি বা পাশের বাড়ির শিশু। সুতরাং সাধু…সাবধান।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

CAPTCHA