পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি: অর্থনৈতিক সংকট ও ধর্মীয় মেরুকরণ

রাজনীতি

নির্বাচনের পদধ্বনি এখনো শোনা যাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। তবে মাঠ প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। কারণ এবার রাজনীতির মূল সুর হয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মীয় বিদ্বেষই হয়ে উঠছে নির্বাচনী কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।

রাজ্যে বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া (এসআইআর) শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে আতঙ্কের দিন — শুনানির পালা। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বলে আসছে যে বাঙালি হিন্দুদের কোনো ভয় নেই, কিন্তু রাজ্যের অধিকাংশ উদ্বাস্তু ভয়ে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এসআইআর নিয়ে সাম্প্রদায়িক হট্টগোল শুরু করলেও, উদ্বাস্তু হিন্দুদের সংশয় দূর করতে পারেনি। 

এসআইআর নিয়ে প্রচার চলছে যে এটি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করবে। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বারবার করে বলছেন দেড় কোটি মানুষের নাম নাকি এসআইআর থেকে বাদ যাবে। তারা নাকি সব রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। বিশ্বে মোট ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা জাতির মানুষ বাস করলেও—এবং তাঁদের প্রায় নয় লক্ষ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে থাকলেও—বিজেপির মতে ভারতে কোটি কোটি রোহিঙ্গা ঘুরছে। 

এই রাজনীতির পিছনে, বা বিরোধীদের মতে বর্তমান এসআইআর করার পিছনেও, বিজেপির পরিকল্পনা হলো সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাস্প ছড়িয়ে, যে করেই হোক জনগণের দৃষ্টি আসল সমস্যার থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া। 

প্রতি দুই দশকে নিয়মিত এসআইআর  প্রক্রিয়া হলেও এবার তা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অস্ত্র। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই এটি ব্যবহার করছে নিজ স্বার্থে। তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। সংবাদমাধ্যমের একাংশ ছড়াচ্ছে বিদ্বেষমূলক বার্তা। একটি সরকারি প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানোর উদাহরণ স্থাপন করছে বিজেপি।

বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে যে ২০২১ সালের মতো সহজ লড়াই হবে না এবার। পরপর হারের ফলে বুথ লেভেলে দলীয় সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শুরু হয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণের নতুন প্রচেষ্টা। 

কলকাতার ময়দানে গীতা পাঠ উপলক্ষে গো বলয় থেকে ভিড় জড়ো করা হচ্ছে। সেই ভিড়ের হাতে মুসলিম প্যাটিস বিক্রেতারা মার খাচ্ছেন। 

একই সময়ে, মুর্শিদাবাদে বিতাড়িত বিধায়ক হুমায়ুন কবির শুরু করেছেন বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করছেন একের পর এক মন্দির। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্দেশ দিয়েছে যে নির্বাচনী প্রচারে অবশ্যই ধর্মীয় স্থানে যেতে হবে।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ২০২৬ সালের নির্বাচন লড়তে চায়।

দুর্নীতির অস্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর ধর্মীয় কার্ড

২০২১ সালের হারের পর বিজেপি চেষ্টা করেছিল দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তৃণমূল কংগ্রেসকে কোণঠাসা করতে। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ব্যবহার করা হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীদের বাড়িতে অভিযান চলে। শিক্ষা দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, গরু পাচার ইত্যাদি মামলায় অনেকে জেলে যান। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। সিবিআই ও ইডির অভিযান কমতে থাকে। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন অনুব্রত মণ্ডল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকে।

দুর্নীতির অস্ত্রে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাজিত করা সম্ভব নয় — এই সত্য স্বীকার করেছে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। তাই স্বচ্ছ প্রশাসনের কথা বললেও তাদের আসল নজর পড়েছে ধর্মীয় বিভাজন ও ইসলামবিদ্বেষের উপর। বিজেপির এই কৌশলে সহায়তা করছে দেশজুড়া বাঙালিবিরোধী অভিযান। এটিকে ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস টেনে নিচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ধর্মনিরপেক্ষ অংশকে।

বামপন্থী দলগুলো এই বিভাজনের বিরোধিতা করছে। কর্মসংস্থান ও মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুতে জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে তাদের। ২০২৪ সালের মতো এবারও উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ পর্যন্ত বাংলা বাঁচাও যাত্রা হচ্ছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)]-র নেতৃত্বে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন ২০২৬ সালেও বামদের ভাগ্য খুলবে না।

প্রশ্ন থেকে যায় – কেন পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ছে? যেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চিরকাল প্রান্তিক ছিল, সেখানে ২০১৭ সাল থেকে ক্রমাগত ধর্মীয় মেরুকরণ, বিদ্বেষ ও হিংসা বাড়ছে কেন? বামেরা, বিশেষ করে সিপিআই (এম), দুই পক্ষকে দায়ী করলেও পিছনের অর্থনৈতিক কারণগুলো খতিয়ে দেখছে না। অথচ ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির অর্থনৈতিক কারণ না বুঝলে এর উত্থান ও দ্রুত প্রসার বোঝা সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অর্থনৈতিক ভিত্তি

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের পিছনে রয়েছে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। স্থাপনের আট দশক পরেও বাঙালির নিজস্ব পুঁজি তৈরি হয়নি। বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। অবাঙালি মাড়োয়ারি ও গুজরাটি সম্প্রদায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত থেকেছে রাজ্যের পুঁজি। ব্যবসা জগৎ রয়ে গেছে এই সম্প্রদায়গুলোর কব্জায়।

রাজ্যের সবচেয়ে সফল দশটি স্টার্ট-আপের বোর্ড পরীক্ষা করলে বোঝা যায় পরিস্থিতি। মাত্র দুটিতে কিছু বাঙালি থাকলেও বাকিগুলো সম্পূর্ণ অবাঙালি প্রতিষ্ঠান।

বঙ্গীয় জাতিগুলির কর্মরত অংশকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় – কৃষিজীবী, পরিযায়ী শ্রমিক, রাজ্যে কর্মরত স্থায়ী বা অস্থায়ী শ্রমিক এবং সরকারি বা বেসরকারি চাকুরীজীবী।

২০১১ সালের পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্ট সংকট চাষকে অলাভজনক করে তুলেছে। উত্তরবঙ্গে সেচ সমস্যা ও দক্ষিণবঙ্গে বন্যা চিরকালের সমস্যা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি ও আবহাওয়া নির্ভর চাষের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। বিধুর পারিয়া, পুলক মিশ্র ও ভগীরথ বেহেরার ২০২২ সালের গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলের চাষেও পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব।

এর ফলে দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিভিন্ন জেলার কৃষকরা ধান বা খাদ্যশস্য চাষের পরিবর্তে কম জল ব্যবহার হয় এমন ফসল ও ক্যাশ ক্রপ চাষে জোর দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের গড় আয় দেশের মধ্যে অনেক কম। কৃষির বাইরে তাদের উপার্জনের চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি আইনের (এমএনরেগা) অধীনে খরচ হ্রাস করছে। বছরের পর বছর রাজ্যে কেন্দ্রের বকেয়া টাকা আসছে না। ফলে অধিকাংশ কৃষিজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিজেপি সরকার এখন এমএনরেগা আইনটিই তুলে দিচ্ছে সংশোধনের নামে। বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন গ্রামে রোজগারের সুযোগ আরও কমবে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপক হারে রাজ্য ছাড়ার ফলে কৃষি কাজ ও সাধারণ গিগ শ্রমের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ করছে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ থেকে আসা পরিযায়ীরা। রাজ্যে চলছে জনবিন্যাসের পরিবর্তন।

রাজ্যে কর্মরত স্থায়ী বা অস্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যে নিবিড় শ্রমের কাজগুলো বহিরাগত হিন্দিভাষী শ্রমিকদের দখলে। চটকল বা কলকারখানায় বাংলাভাষী শ্রমিকের সংখ্যা নগণ্য। বেসরকারি ও সরকারি চাকরিতেও এই জনবিন্যাসের পরিবর্তন স্পষ্ট।

পশ্চিমবঙ্গে মাড়োয়ারি ও গুজরাটি পুঁজির মালিকানাধীন সংস্থাগুলো কলকাতায় কেন্দ্রীভূত। এসব সংস্থায় প্রদত্ত বেতন দিল্লি, মহারাষ্ট্র বা কর্ণাটকের তুলনায় অনেক কম। তাই শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের অন্য রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে কাজের খোঁজে। বিগত শতাব্দীর আটের দশক থেকে এই ধারা চললেও গত দশ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলায় কাজ থাকলেও বাঙালির কাজ জোটেনি। জুটলেও যথাযথ বেতন মেলেনি। বেশির ভাগ মানুষকে রাজ্য ত্যাগ করতে হয়েছে। এদের চলে যাওয়ার ফলে রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা আরও হ্রাস পাচ্ছে। অনেকে পাকাপাকিভাবে অন্যান্য রাজ্যে থাকতে শুরু করেছেন।

২০২৭ সালে জনগণনা হলে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা ২০১১ সালের তুলনায় কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়া সংস্থাগুলোর হিসাব আরও উদ্বেগজনক বাস্তবতা তুলে ধরে। কোম্পানির নিবন্ধিত কার্যালয় স্থানান্তরণের ধারা বিগত চৌদ্দ বছরে উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। রাজ্যসভায় ২২ জুলাই বিজেপি সাংসদ ও রাজ্য সম্পাদক শমীক ভট্টাচার্যের করা প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার জানায় তথ্য। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ৬,৬৮৮টি কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে নিবন্ধিত কার্যালয় সরিয়ে নিয়েছে। গড়ে প্রতিদিন একটিরও বেশি কোম্পানি চলে গেছে।

স্থানান্তরণের ধারায় সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষ থেকে হঠাৎ তীব্র বৃদ্ধি। ২০১৪-১৫ সালে যেখানে ৩৮২টি কোম্পানি রাজ্য ছেড়েছিল, পরের বছরই সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬৯তে। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে সর্বোচ্চ ১,০২৭টি কোম্পানি স্থানান্তরিত হয়। সাম্প্রতিক বছরে ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে যথাক্রমে ৩৭১ ও ৩৬৬টি কোম্পানি স্থানান্তরিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয়।

West Bengal Company Exodus 2011-2025
পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পের প্রস্থান (২০১১-২০২৫)
গত ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়া মোট কোম্পানি ৬,৬৮৮ টি
📅 বাৎসরিক পরিসংখ্যান
২০১১-১৪ (গড়) ২২৯
২০১৫-১৬ (বৃদ্ধি শুরু) ৮৬৯
২০১৭-১৮ (সর্বোচ্চ) ১,০২৭
২০১৮-১৯ ৫৪২
২০২২-২৩ (সর্বনিম্ন) ২৭০
২০২৪-২৫ (বর্তমান) ৩৬৬
গড়ে প্রতি বছর ৪৭৮টি কোম্পানি রাজ্য ছেড়েছে। ২০১৭-১৮ সালে সর্বাধিক ১,০২৭টি কোম্পানি স্থানান্তরিত হয়।
📍 প্রধান গন্তব্যস্থল
মহারাষ্ট্র ১,৩০৮
দিল্লি ১,২৯৭
উত্তর প্রদেশ ৮৭৯
ছত্তিশগড় ৫১১
গুজরাট ৪২৩
রাজস্থান ৩৩৩
বেশিরভাগ কোম্পানি দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছে, যা মোট প্রস্থানের প্রায় ৩৯%।
* তথ্যসূত্র: মিনিস্ট্রি অফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স (রাজ্যসভা প্রশ্ন নং ২২১, জুলাই ২০২৫)

গন্তব্যের দিক থেকে দেখলে তিনটি রাজ্য প্রধান সুবিধাভোগী হয়েছে। মহারাষ্ট্রে সর্বাধিক ১,৩০৮টি কোম্পানি চলে গেছে। এটি মোট স্থানান্তরিত কোম্পানির প্রায় ২০%। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দিল্লি। সেখানে গেছে ১,২৯৭টি কোম্পানি। তৃতীয় স্থানে উত্তর প্রদেশ – সম্ভবত নয়ডা – যেখানে চলে গেছে ৮৭৯টি কোম্পানি। এই তিন রাজ্য একসাথে পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্থানান্তরিত মোট কোম্পানির অর্ধেকেরও বেশি গ্রহণ করেছে। ছত্তিশগড় পেয়েছে ৫১১, গুজরাট ৪২৩ এবং রাজস্থান ৩৩৩টি কোম্পানি।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গন্তব্য। স্থানান্তরিত ৬,৬৮৮টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১১০টি ছিল তালিকাভুক্ত। কিন্তু এদের গুরুত্ব সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। এই ১১০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ৪৫টি মহারাষ্ট্রে, ২০টি দিল্লিতে এবং ১৪টি গুজরাটে গিয়েছে। উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বৃহৎ পুঁজিযুক্ত সংস্থাগুলো প্রধানত এই তিন রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত শিল্প-বাণিজ্য পরিবেশ বেছে নিয়েছে।

শ্রমের খরচ মহারাষ্ট্র বা দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি। কিন্তু স্থানান্তরের পিছনে শুধু শ্রমের মজুরির ফারাক বড় নয়। সমস্যা দেখা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পণ্য পরিবহনে পুলিশের অত্যধিক ঘুষ দাবি, ব্যবসা থেকে তোলা আদায় ও নানা চাপ সৃষ্টিতে।

এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো পশ্চিমবঙ্গের পরিকাঠামো। এর সার্বিক উন্নয়নে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার উদাসীন থেকেছে। রাজ্যে নতুন শিল্প আনার ঘোষণা প্রতি বছর হলেও রাজ্যের অর্থনীতির জন্য জরুরি গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হয়নি।

বাণিজ্য সংক্রান্ত এই সমস্যা, রাজ্যে বাঙালির পুঁজির অভাব, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতির অভাব ও চূড়ান্ত নৈরাজ্য ও দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ছিল ৫.৫%। দেশের গড় বেকারত্বের হার একই সময় ছিল ৬.৪%। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা এর একটি কারণ হিসেবে মনে করেন ব্যাপক হারে মানুষের কাজের খোঁজে রাজ্য ত্যাগ করা ও অন্য রাজ্য থেকে কম মজুরির কাজ করতে পাকাপাকিভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা মানুষের স্রোত। এই ভারসাম্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান না থাকলেও বেকারত্বের হার কম থাকে।

তবে এর অর্থ এই নয় যে ভারতের সার্বিক ভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো আছে। 

ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের পিছনে কি হতাশার অর্থনীতি কাজ করছে?

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতি আসলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংকটের সময় প্রবল হয়। ঠিক যেই সময় বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, আয়ের সুযোগ সংকুচিত হয়, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও দুর্নীতি বেলাগাম হয়, ঠিক সেই সময় ধর্মীয় বিদ্বেষ খুব তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানো হয়। 

ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র একটি অত্যন্ত হতাশাজনক অধ্যায়ের দিকে ইঙ্গিত করছে। 

গত পাঁচ বছরে ভারতে বেসরকারি কোম্পানি বন্ধ হওয়ার যে তথ্য সরকার প্রকাশ করেছে, তা দেশের শিল্প-বাণিজ্যিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। লোকসভায় রামশঙ্কর বিধার্থী রাজভরের প্রশ্নের উত্তরে ১লা ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে কর্পোরেট বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হর্ষ মালহোত্রা জানান যে ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে মোট ২,০৪,২৬৮টি বেসরকারি কোম্পানি বিলুপ্ত হয়েছে একীকরণ, রূপান্তর, বিলোপ এবং স্ট্রাইক-অফের মাধ্যমে।

Private Company Closures India 2020-2025
ভারতে বেসরকারি কোম্পানি বন্ধের পরিসংখ্যান
গত ৫ বছরে (২০২০-২৫) মোট বিলুপ্ত কোম্পানি ২,০৪,২৬৮ টি
📉 বাৎসরিক প্রবণতা (Yearly Trend)
২০২০-২১ (কোভিড কাল) ১৫,২১৬
সরকারি সহায়তার কারণে সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন।
২০২১-২২ (তীব্র বৃদ্ধি) ৬৪,০৫৪
২০২২-২৩ (সর্বোচ্চ) ৮৩,৪৫২
২০২৩-২৪ ২১,১৮১
২০২৪-২৫ ২০,৩৬৫
📊 মূল পর্যবেক্ষণ
বিলম্বিত প্রভাব (Delayed Impact):
মহামারীর ঠিক পরেই কোম্পানি বন্ধের হার কম ছিল সরকারি ঋণ স্থগিতাদেশের কারণে। সহায়তা তুলে নেওয়ার পরেই (২০২১-২৩) বন্ধের হার ৪ গুণ বেড়ে যায়।
কীভাবে বন্ধ হলো?
অধিকাংশ কোম্পানি একীকরণ (Amalgamation), রূপান্তর (Conversion) এবং স্ট্রাইক-অফ (Strike-off)-এর মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়েছে।
উদ্বেগজনক তথ্য:
এই বিপুল সংখ্যক কোম্পানি বন্ধ হওয়ার ফলে কর্মহীন হওয়া কর্মচারীদের জন্য সরকারের কোনো নির্দিষ্ট পুনর্বাসন পরিকল্পনা (Rehabilitation Scheme) নেই।
* পিছিয়ে পড়া এলাকায় নতুন শিল্পের জন্য কোনো বিশেষ কর ছাড়ের প্রস্তাবও নেই।
* তথ্যসূত্র: লোকসভা প্রশ্ন নং ২২৭ (১ ডিসেম্বর ২০২৫)

এই পরিসংখ্যানের মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় এবং বিস্ময়কর দিক হল কোভিড মহামারীর সময়কালে কোম্পানি বন্ধের ধারা। প্রথাগত ধারণা অনুযায়ী, ২০২০ এবং ২০২১ সালে যখন ভারত তীব্র কোভিড সংকটের মুখোমুখি ছিল, তখন সর্বাধিক সংখ্যক কোম্পানি বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মাত্র ১৫,২১৬টি কোম্পানি বন্ধ হয়েছে, যা এই পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর পরিবর্তে, মহামারীর প্রত্যক্ষ প্রভাব কমে যাওয়ার পরবর্তী বছরগুলিতে কোম্পানি বন্ধের সংখ্যা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবর্ষে বন্ধ হওয়া কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪,০৫৪তে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় চারগুণেরও বেশি। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সর্বোচ্চ ৮৩,৪৫২টি কোম্পানি বিলুপ্ত হয়, যা সমগ্র পাঁচ বছরের মধ্যে একক বছরে সর্বাধিক। এরপর ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ২১,১৮১ এবং ২০,৩৬৫তে নেমে আসে, তবে এই সংখ্যা এখনও মহামারী-পূর্ববর্তী স্তরের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকে।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হল এই বিপুল সংখ্যক কোম্পানি বন্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা। সংসদীয় প্রশ্নের উত্তরে সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে কর্মচারীদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো বিশেষ প্রকল্প বা পরিকল্পনা নেই। দুই লক্ষেরও বেশি কোম্পানি বন্ধ হওয়ার অর্থ হাজার হাজার কর্মচারী তাদের জীবিকা হারিয়েছেন, কিন্তু তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

উপরন্তু, পশ্চাৎপদ এবং গ্রামীণ অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের জন্য কর ছাড় বা প্রণোদনা প্রদানের বিষয়ে সরকারের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় যে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসের চেয়ে কর কাঠামো সরলীকরণকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এই পরিসংখ্যান এবং নীতিগত প্রতিক্রিয়া একসাথে দেশের শিল্প-বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থান পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে, বিশেষত মহামারী-পরবর্তী পুনরুদ্ধার পর্যায়ে।

এই কর্মসংস্থানের সমস্যা চিরকাল বিজেপিকে পয়সার বিনিময়ে বাহুবল এনে দিয়েছে। বর্তমানে সেই প্রয়োগ চলছে পশ্চিমবঙ্গে, নানা কায়দায়। 

হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান ও হিংসার ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত অবাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক অঞ্চলগুলো – পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল থেকে শুরু করে হুগলির রিষড়া বা হাওড়ার শিবপুর। মূলত হিন্দিভাষী হিন্দু ও বিহারি মুসলিমদের মধ্যেই এই সংঘর্ষগুলো হয়ে এসেছে।

রাজ্য থেকে চলমান কাজের খোঁজে বাঙালি শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তের প্রস্থান এবং সেই শূন্য স্থান পূরণে গো-বলয় থেকে ক্রমাগত অভিবাসন রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। গো-বলয়ের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। এখানকার বাঙালি দলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতিগুলোর ভিতর গভীরে প্রশাখা বিস্তার করেছে।

অভিবাসন ও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক মেরুকরণ

পশ্চিমবঙ্গে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ থেকে অভিবাসন চলে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে। বিগত পনেরো বছরে এই অভিবাসনের হার প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বাঙালা পক্ষের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো অভিযোগ করে।

প্রথম দিকে এই অভিবাসনের ফলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নানা হিন্দিভাষী বেল্টে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক এখনো মজবুত। কিন্তু ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে বৃদ্ধি পাওয়া অভিবাসনের ফলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বিজেপি।

ক্রমাগত বামদের, বিশেষ করে সিপিআই (এম) এর কট্টর ভোটারদের বয়স বৃদ্ধি, মৃত্যু এবং তাদের বংশধরদের তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতার ফলে গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকে যাওয়া বা রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়া এর কারণ। বামদের ভোট ব্যাঙ্ক চলে যাওয়ায় একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে বহিরাগত ভোটারদের উপর ভর করে বিজেপিও শক্তি বৃদ্ধি করেছে।

এই কারণে বর্তমানে রাজ্যের রাজনীতিতে এই দুই শক্তি নানা জেলায় ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে চলা হিন্দিভাষী অভিবাসীদের তোয়াজ করে চলেছে। আগামী দিনে এর ফলে আরও বেশি ধর্মীয় মেরুকরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চলমান এই হিন্দি অনুপ্রবেশ শুধু রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী দলগুলোকে শক্তিশালী করেনি। সাংস্কৃতিকভাবেও তীব্র করেছে উত্তর ভারতীয় আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের ফলে লাভবান হবে বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসও বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে এই অভিবাসীদের তোষণ নীতি বজায় রেখে ভোট ব্যাঙ্ক বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাবে।

কিন্তু এর ফলে সিপিআই, সিপিআই (এম) প্রভৃতি বাম দলগুলো ব্যাপকভাবে ধাক্কা খেতে পারে। যারা পশ্চিমবঙ্গে কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠিত করেছিল, তারাই আজ সংকটে পড়েছে।

হুগলির চটকল অঞ্চলে বা হাওড়ার রুগ্ন শিল্পাঞ্চলে এর উদাহরণ দেখা গেছে। সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ তীব্র হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে বলে বামপন্থী শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন।

এসব অঞ্চলের অনেক চটকলে শ্রমিকরা ইউনিয়নের লড়াইয়ে লাল ঝান্ডার পাশে থাকলেও নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপিকে ভোট দেয়। সিপিআই (এম) বা অন্য বাম দলগুলোকে ভোট দেয় না। সিপিআই (এম) নেতৃত্ব এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক চেতনার অভাবের কথা বললেও আসলে এর পিছনে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব কাজ করে।

গো বলয় থেকে আগত শ্রমিকরা নিবিড় শ্রমের কাজে বাঙালি শ্রমিকের যুক্ত হতে না চাওয়ার ফলে সৃষ্ট শ্রমের চাহিদা ও যোগানের ব্যবধান চিরকাল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বাম আমলে সরকারি ক্ষমতায় থাকার কারণে লাল ঝান্ডার ইউনিয়নের সাথে থাকায় লাভ ছিল এই হিন্দিভাষী শ্রমিকদের। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে সেই সুযোগ নেই। চটকল ও অন্যান্য কিছু শিল্পের শ্রমিকদের অধিকাংশ দেখেছে যে বাম ছাড়া অন্য শক্তিগুলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করলেও মজুরি বৃদ্ধি বা ন্যায্য দাবির আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। তাই কারখানায় নিজের অধিকারের স্বার্থে এই বহিরাগত শ্রমিকদের একটা অংশ, বিশেষ করে চটকল ও কয়লা খনি অঞ্চলে, এখনো বামদের সাথে রয়েছে। কিন্তু কারখানার বাইরে নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বৃত্তে এই অংশটির বেশির ভাগ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপির সাথে যাচ্ছে।

বামদের সামনে কোন পথ খোলা?

বামদের ঘুরে দাঁড়ানো কি সম্ভব? এই প্রশ্ন তীব্র হয় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে। স্বাধীনতার পরে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংসদে সাংসদ পাঠাতে ব্যর্থ হয় বামেরা। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পরে বামদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হয়।

এহেন পরিস্থিতিতে বামদের সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার। প্রথমত, রাজ্যের রাজনীতির বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করে অবাঙালি ভোটারদের, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ ও গিগ শ্রমিকদের নিজেদের দিকে টানতে হবে। এই শ্রমিকদের বড় অংশ বিহার, ঝাড়খণ্ড বা পূর্ব উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছে। তাই এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বামদের থেকে বেশি নিজ রাজ্যের বিজেপির প্রভাব থাকবে স্বাভাবিকভাবেই। বামদের, বিশেষ করে সিপিআই বা সিপিআই (এম) এর পক্ষে এদের দলে টানা অত্যন্ত কঠিন।

দ্বিতীয়ত, এই অভিবাসনের ফলে পশ্চিমবঙ্গ যে একটি সেটলার কলোনিতে পরিণত হচ্ছে ও কৃত্রিমভাবে রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি কম রাখা হচ্ছে, এই ইস্যু নিয়ে ও কিছু জনপ্রিয় দাবি নিয়ে লড়াই করতে হবে।

যেহেতু প্রথম পথটি বামদের কাছে অত্যন্ত কঠিন, তাদের সামনে দ্বিতীয় পথটিই খোলা থাকবে। সেই পথে নতুনভাবে চলতে পারলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংকীর্ণতার থেকে মুক্ত করে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ফেলতে সুবিধা হবে।

বর্তমানে বাংলা বাঁচাও যাত্রায় সিপিআই (এম) কোনো নিদর্শন রাখেনি যে দলটি তার কৌশল ও পদ্ধতি পরিবর্তন করতে আগ্রহী। রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেকে পুনরায় প্রাসঙ্গিক করে তোলার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে যদি বামেরা এই কাজ না করতে পারে তাহলে ২০২৬ তাদের জন্য ২০১৯, ২০২১ বা ২০২৪ এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

CAPTCHA