গত কয়েক সপ্তাহে, দেশের বিভিন্ন বড় শহরে কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে লকডাউনে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জঙ্গী বিক্ষোভেই টনক নড়েছে রাষ্ট্রের, চটজলদি ভারতীয় রেল ঘোষণা করে ছয়টি “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন চলবে যাতে লকডাউনে আটকে পরা পরিযায়ী শ্রমিক, ছাত্রছাত্রীরা তাদের রাজ্যে ফিরতে পারেন এবং গত ১লা মে ভোর ৪:৫০ নাগাদ, হায়দ্রাবাদ থেকে ১,২০০ জনকে নিয়ে ঝাড়খন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় প্রথম “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন!
জনস্বার্থে নয় বরং গণবিক্ষোভের চাপেই যে কেন্দ্রীয় সরকার “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন চলাচল শুরু করতে বাধ্য হয়েছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটানো শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেন ভাড়া সহ উপরি ৫০ টাকা “করোনা সারচার্জ” হিসেবে দিতে বলা হয়, কয়েকটি ক্ষেত্রে যাত্রার ভাড়া এমনকি ১,৫০০ টাকাও পৌঁছেছে। রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বিকে যাদব ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কে জানান যে ট্রেনভাড়া বিনামূল্যে করে দিলে, “প্রত্যেকে যাওয়ার সুযোগ পাবে এবং এইভাবে কারা যাচ্ছে সেটা ট্র্যাক রাখা সম্ভব হবে না “।
এরপরই সংসদীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে শুরু হয়ে যায় বিরোধীদের দোষারোপ, উদারনৈতিক কংগ্রেস থেকে গণতান্ত্রিক বামদের মানবিক সাজার পালা । সেই সুত্রেই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে নেমে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি)-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর জয়েন্ট সেক্রেটারি লভ আগারওয়াল, সোমবার, ৪ঠা মে, বিবৃতি দেন যে, “পরিযায়ী শ্রমিকদের টিকিটের জন্য কোনো খরচ করতে হবে না, কেন্দ্রীয় সরকার দেবে ৮৫% এবং রাজ্য সরকার ১৫% খরচ বহন করবে”।
বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য ফেক খবর থেকে শুরু করে দুমদাম কোনো বিবৃতি দিয়ে দেওয়া, নতুন না কিছুই। তাই উনি দাবি করলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা রেল দপ্তর, কেউই পরিযায়ী শ্রমিকদের টিকিটের ভাড়া কে কেন্দ্র করে সরকারিভাবে কোনো নোটিস এখনও অবধি জারি করেনি। রেল মন্ত্রকের তরফ থেকে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে টিকিট সংক্রান্ত বিষয়ে শেষ নোটিশ দেওয়া হয়েছিল শনিবার, ২রা মে, সার্কুলার নাম্বার DTP/2020/05/17 যেখানে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে অরিজিনেটিং স্টেট (যে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা আটকে রয়েছেন) এর রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন এ যাওয়া শ্রমিকদের একটা তালিকা দেবে (প্রতিটি ট্রেনে সর্বাধিক ১,২০০ জন) এবং সেই সংখ্যা অনুযায়ী কেন্দ্র টিকিট রাজ্যের হাতে দেবে এবং রাজ্য প্রশাসন রেল স্টেশনে সেই টিকিট শ্রমিকদের দিয়ে, নির্দিষ্ট টিকিটের মূল্য সংগ্রহ করে নেবে এবং কেন্দ্রকে পাঠাবে।
এরপর রেল মন্ত্রকের তরফ থেকে টিকিট মূল্য সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো নোটিস আসেনি, এমনকি ৩রা মে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি নোটিস দিলেও, সেটিতেও “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন এর টিকিটের মূল্য সংক্রান্ত কোনো কথা লেখা নেই। বুধবার, ৬ই মে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে যে ৭০,০০০ পরিযায়ী শ্রমিক সেই দিন অবধি তাঁদের রাজ্যে ফিরেছেন, কিন্তু সেখানেও টিকিটের মূল্য বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকরা জানিয়েছেন যে টিকিটের মূল্য ৬৬০, ৬৮০, ৭১০, ৭৪০, থেকে শুরু করে দূরত্বের সাথে পৌঁছে গেছে ১,৪০০ টাকার ঘরে।
তাহলে কি সরাসরি মিথ্যা বললেন আগারওয়াল? আর শুধু উনিই তো নন, “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন এর ৮৫% টিকিট মূল্যের দায়ভার নেবে রেল এরকম মন্তব্য করেছেন বিজেপি’র রাজ্যসভা’র সদস্য সুব্রামানিয়ান স্বামীও। নাহ্, মিথ্যা না, বরং বিদেশি লগ্নিতে দেশের উন্নয়নের নামে বিদেশি লগ্নিপুঁজি কে জায়গা করে দেওয়া থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর নামে সস্তা শ্রমিক তৈরীর চক্রান্তের মতনই ৮৫% এর গল্পতেও সেই একইভাবে লুকিয়ে আছে কথার ভাঁওতাবাজি, যা ধরতে গেলে রকেট সায়েন্স নয় বরং লাগবে সাধারণ গণিতের জ্ঞান।
রেলপথে একটি আপ-ডাউন ট্রিপে যে খরচটি হয় , সেটা রেল টিকিটের মূল্যের মাধ্যমে যাত্রীদের থেকে সরাসরি সম্পূর্ণভাবে আদায় করে না, বরং গড়ে প্রতি টিকিট-পিছু ৪৭% ভর্তুকি দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, এবং যাত্রী কে দিতে হয় ৫৩% ভাড়া। গড়পরতা এটা ধরা যেতে পারে যে একটা আপ-ডাউন ট্রিপের ৪৭% খরচ বহন করে কেন্দ্রীয় সরকার, মানে আপ এবং ডাউন মিলিয়ে ২০০ টাকা খরচ হলে ৯৪ টাকা খরচ করে কেন্দ্রীয় সরকার ।
কিন্তু “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন এর যাত্রী শ্রমিকরা গন্তব্য স্টেশন অবধি যথাযত মূল্যের (৫৩% খরচ বহন করে) টিকিট কেটে এলেও ট্রেনটাকে ফিরতে হবে ফাঁকা, মানে ফেরার পুরো খরচটাই বর্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর অর্থাৎ ২০০ টাকার ১৪৭ টাকাই দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে মানে আপ-ডাউন মিলিয়ে টোটাল খরচের ৭৩.৫% টাকাই দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার কে। আবার যাত্রী সংখ্যা স্বাভাবিকের থেকে কম থাকায় বাড়তি খরচও বহন করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই।
মানে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিলাম একটি দূরপাল্লার ট্রেনে ৫,০০০ জন যাত্রী থাকে, তাই একটা স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাওয়ার জন্য যে খরচটা হয় সেটা ৫,০০০ জন যাত্রী এবং সরকার মিলিতভাবে বহন করে। কিন্তু “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন গুলোতে “সামাজিক দুরত্ব” এর নির্দেশ মেনে ঠিক করা হয়েছে যে সর্বাধিক ১,২০০ জন যাত্রী যেতে পারবেন একবারে। অথচ যাত্রী কম হলেও সমদূরত্ব যাওয়ার জন্য খরচটাও কমবেশি একই থেকে যাবে তাই বাড়তি কিছুটা খরচও করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই যা গড়পরতা হিসেব করে হয় টোটাল খরচের ৮৩% এর কাছাকাছি, যেটা দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে ।
যদি এই হিসেবেই আগারওয়াল ৮৫:১৫ এর গল্প শুনিয়ে থাকে তাহলেও রাজ্য সরকার এই ১৫%, অর্থাৎ শ্রমিকদের থেকে নেওয়া টিকিটের মূল্য বহন করা অবধি, দূরত্ব অনুযায়ী ৬০০-১,৪০০ টাকা ভাড়া দিয়েই “শ্রমিক স্পেশাল” ট্রেন চেপে বাড়ি ফিরতে হবে শ্রমিকদের।