Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the wpau-yt-channel domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114

Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the blog-designer-pack domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u872615695/domains/peoplesreview.in/public_html/bangla/wp-includes/functions.php on line 6114
আমার রাজনীতি, আমার লেখালেখি | পিপলস রিভিউ বাংলা - People's Review Bangla

১.

বাড়িতে একবার মহাশ্বেতা দেবী এসেছিলেন। তখন আমার বয়স ৮ বছর। আর, সুমনের গান লেখা হয়েছিল পাড়ার দেওয়ালে দেওয়ালে। তখনই। নব্বইয়ের মাঝামাঝি। জেঠুরা মাঠ বাঁচানোর আন্দোলন করছিলেন। আক্রান্ত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের এই জোটবদ্ধ লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই এসেছিলেন মহাশ্বেতা। আরও আগে, বাড়িতে এসেছিলেন, আজিজুল হকের স্ত্রী মণিদীপা। কারণ, জেঠুরা তখন সক্রিয় ভাবে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে জেলে। জেঠু আমায় বলতেন, দুটো বই পড়তে। নুনের পুতুল সাগরে। আর, মহাকালের রথের ঘোড়া। ধনঞ্জয় বৈরাগী আর সমরেশ বসুর লেখা।

বিমলদার সাথে আজকাল প্রায়ই কথা হয়। বিমলদা, সুভাষদা-সব সত্তরের লোক। এঁদের সাথেই বেশি কথা বলেছি বারবার। বলতে চেয়েছি। কারও থেকে জেনেছি চারু মজুমদারের কথা তো কারও থেকে কমলকুমারের সান্নিধ্য। ধনঞ্জয় বৈরাগীর কথা সেদিন সঞ্জয়দা বললেন। জানতাম, সে সময়ের দমদম-যাদবপুর-নাকতলা বা বেহালার কথা। আজিজুল হকের  পরবর্তীকালের রাজনীতি নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমায় টানে তাঁর আত্মত্যাগ বড় স্বপ্নের প্রতি। টানে তাঁর বা তাঁদের সাথে হওয়া বছরের পর বছর রাষ্ট্রের অত্যাচার। জেলের দিনরাত। তাঁদের প্যাশান। লড়াই। কি জন্যে তাঁরা এই অমূল্য সুখের জীবন ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন অমন বিপদে-আমাকে ভাবায়। আজন্ম ভাবাবে। স্বপ্নতাড়িতের মতো আমি আমার মনে, আমার লেখায় ধরতে চাইব সেই সময়টা, সেই মানুষগুলোকে। আমার প্রজন্মে যা আমি পাইনি, পাব না। সেই স্বপ্ন, নবারুণের ভাষায়, পেট্রল দিয়ে আগুন নেবানোর স্বপ্ন।

সঞ্জয়দা, নবারুণদা, সুমন, হিরণদা-এদের প্রতি আমার অবসেশানের জন্য এককালে প্রেমিকাও হেসেছে। বলেছে, “তুইও সত্তরের প্রোডাক্ট মনে হয়”। আমি কথা বাড়াইনি। কারণ, রক্তে কি চলে, তা ভাষায় বোঝানো যায় না। তা ছাড়া, সদ্য যৌবনে, নিজেও ভালো বুঝিনি কি হচ্ছে বুকে। সারারাত পড়াশোনা করতাম। তারপর, সকালে কলেজ যেতাম। সিরিয়াস ছিলাম। আমায় টানত, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-নোনাডাঙ্গা। না বুঝেই আমি ভেসে যেতাম মিছিলে। লিখলে আমি আমার সময়কে এড়াতে পারতাম না। মনে করতাম, সময় বা ইতিহাসকে এড়ানো অপরাধ। 

নিজের বইয়ের ঘরে সারারাত বসে থাকার মতোই আমি শান্তি পেয়েছি সত্তরের এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে। মনে বত, সমুদ্রের তীরে বসে আছি। বন্ধুরা কেউ হেসেছে, কেউ খিস্তি করেছে, কেউ বলেছে আমি স্মৃতিতাড়িত। আমি বুঝেছি, আমি এদের বোঝাতে পারব না। কারণ, সব বোঝানো যায় না। বোঝাতে গেলে ঘেটে যেতে পারে। তা ছাড়া, আমার মতোই এসব আরও অনেকের ভেতরে হচ্ছে। তাঁদের লেখায় তাঁদের রাজনীতিতে তার ছাপ স্পষ্ট। 

উনিশ শতক, অগ্নিযুগ, সত্তর-র ভেতর আমি একটা সুতো পেয়েছি বারবার। আমায় আশ্রয় দিয়েছে এই ইতিহাসের চিলেকোঠা। শুশ্রূষা দিয়েছে। আমাকে সুমনের গান কলামন্দিরে গিয়ে যৌবনে আবিষ্কার করতে হয়নি। অনেক আগে রক্তে মিশে ছিল। আমার নিয়তি ছিল সঞ্জয়দা, নবারুণের সাথে মেশা। কারণ, আমি আমার শান্ত শীতল রাজনীতিহীন সুবিধেবাদী সময়ের থেকে ইতিহাসের আত্মত্যাগ ও স্বপ্নভঙ্গ পাচ্ছিলাম না। বড় বেশি ” আমি” “আমি” ছিল ৮০-৯০ দশক। আর তার পর তো বিশ্বায়নের ২০০০। মুছেটুছে দেওয়ার পালা যা কিছু স্মৃতি, সত্তা ও ভবিষ্যৎ। তাই বড় শিল্প বা রাজনীতির চিন্তা এ কালপর্বে এলোনা, ইতিহাসের সাপেক্ষে। 

আমরা কেউ কেউ, ভাবতে ভালোলাগে, আজও একটা ফ্রন্টেই আছি। মাস্টারমশাই বা অগ্রজদের ঘিরে যে ফ্রন্ট চলেছে। আমরা, সুমনের ভাষায়, “গর্বিত সংখ্যালঘু”, যারা ট্রোল করে বিপ্লববাসনা চরিতার্থ করতে পারলাম না। এ শহরকে ভালোবাসলাম সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের মতোই। ধুলোমলিন ইতিহাস ঘেটে বের করলাম যা-কিছু বলতে চেয়েছে অথচ পারেনি সে সব আগের সময়ের চায়ের দোকানের মেধাচর্চা, যা অগ্রন্থিত ইতিহাস, রক্তের দাগ, আগুণের বর্ণমালা। কেচ্ছা নয় দ্রোহ। বাতেলা নয় শ্রম। বিমলদাদের চারপাশ দেখে চুপ করে যাওয়া।

মিসফিট হলাম হয়তো। হয়তো আমাদের লেখায় বা প্রকাশে এপার্টমেন্টের খুকু গদ্যের বদলে ধরা দিল টেনশান, এক ধরণের মার্জিন ভাঙার রাজনীতি। ডিক্লাসড হওয়ার মন্ত্র। ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে উঠে এলো ইতিহাস-আমি গর্বিত, সে ভাষা আমার রক্তে-মেধায়-মগজে, সে ভাষা বিমলদাদের অবচেতন থেকে উঠে এসে ভেদবমির মত আমার শব্দে মিশে যায় ও যাবে বারবার। আমি সত্যিই গর্বিত।

২.

“উনিশ কুড়ি”নামের একটা পত্রিকা প্রকাশিত হত এককালে। তাতে, যুবক-যুবতীরা কীভাবে খাবে-জামা পড়বে-শোবে-বসবে-হাগবে তার তালিকা থাকত। কালচার ইন্ডাস্ট্রি তিলে তিলে এভাবে এমন একটা যৌবনকে শেপ করেছে, যে তারা আজ হাবা। বা বিজেপি। তারা বরকে ” বেবি” ডাকে। ডিলডো-প্রেমের কাব্য লেখে ফেসবুকে। তাদের জীবন বলতে, বস-বর-আমি আর ফেসবুক। ইয়াই!
গত ৩০-৪০ বছর ধরে সচেতন ভাবে একটা যুগপ্রজন্ম এভাবে ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছে। এরা কোনওদিন কমলকুমার বা আখরারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম শুনবে না। হ্যাকিং-কে মহত শিল্প ভাববে। বিজন-ঋত্বিক এদের কাছে বোগাস। এদের জানতে দেওয়া হবে না, ধনঞ্জয় বৈরাগীর “নুনের পুতুল সাগরে” বা সমরেশ বসুর “মহাকালের রথের ঘোড়া”। সত্যিই এরা গাণ্ডু প্রজন্ম। মানে, এরা আমারই বন্ধুবান্ধব। আমারই শ্রেণি। যাদের স্ট্রাগেল ছাড়াই শিওর সাককেস। যারা ফেসবুকে খাপ বসিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে গোপন ক্রিনশট দিয়ে। আন্দোলন এদের কাছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। ব্যবসা এদের কাছে সুসভ্য চিটিংবাজি। আছে বলতে, গাঁজা আর মুর্খামি আর কিছুটা মুরাকামি। আর জাস্ট কলকাতা ছেড়ে কাটব-কাটব খেলা। 

এদের দোষ না। এদের বাবা-মা মানে আমাদের কাকু কাকিমারা এভাবেই এদের তৈরি করেছে। শিখিয়েছে, এরা,মানে বাপ-মা” র এক সন্তানরা, আসলে প্রোভিডেন্ট ফান্ড। যাদের রিটার্ন দিতে হবে। জীবন দিয়ে। তাই পাশের বন্ধুকে পাশ কাটিয়ে স্কুলে ফার্স্ট হওয়া, অন্যের প্রেমিক কেড়ে নিয়ে প্রেমে ভেংচি কাটা, কলেজে ডজ-ড্রিবল করে হ্যান্ডুকে ধরে ২৪-এ বিয়ে, ২৬-এ প্রোমোশান, ৩০-এ পেনশান প্ল্যান! এদের দোষ কি! তারা তো হাজার বছরের ইতিহাসে পেদে দিয়ে আমি-আমি করবেই! সেল্ফি তুলে রোজ জানান দেবেই, আমি কিন্তু আছি বস, বাজারে!

থাইল্যান্ডের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলাম, ক্যাপিটালিজম কোথায় নিয়ে যেতে পারে মানুষকে। সন্ধ্যা ৭টার পর একজন পুরুষ হিসেবে পাটায়ার রাস্তায় একা হাঁটতে ভয় করেছিল। কারণ দু-পা অন্তর অন্তর হাত ধরে টানছিল ট্রান্সজেন্ডাররা। তাঁদের চুলের রং তিমি মাছের পেটের মত। আমার টেনশান হয়েছিল প্রথম, একজন সংখ্যালঘু পুরুষ হিসেবে। বুঝেছিলাম, বেশিদিন এখানে থাকলে, সমস্ত মানবিক অনুভূতিদলা কিনে ফেলবে এরা, আমি আর মানুষকে বিশ্বাস করতে পারব না। পালিয়েছিলাম পরদিনই।

সম্প্রতি, নবারুণকে নিয়ে দীর্ঘ কাজটা করতে গিয়ে দেখছিলাম, ভবানীপুর-ট্রাঙ্গুলার পার্ক-বিজয়গড়ের ফুটপাত গমগম করত তাঁদের বন্ধুদের আড্ডায়। গোলপার্কে সন্ধ্যা নামত নবান্নর রিহার্সালে। এর আগে সুমনকে নিয়ে কাজ করতে গিয়েও একাধিক বন্ধু বলেছেন, গড়িয়া-নাকতলার কত সন্ধ্যা চলে গেছে তাঁদের আড্ডায়, চায়ের মলিন দোকানে। এই গমগম, গনগন, জীবনের ওম, মানুষের ভিড়, মিছিল, আসলে একটা সভ্যতাকে সজীব রাখে। সচেতন রাখে যৌবন। শেয়ালদাহ স্টেশনের মত। টাকাই সব না-এই বিশ্বাসে শান দেয়। ছোট করে বেঁচে থাকায় যে গ্রাঞ্জার, যে মূল্যবোধ অন্যকে সাহায্য করায়, দেশটাকে মা হিসেবে দেখায়, নিজের ঐতিহ্যের যে বিপুল ট্রেজারহাউস তাঁকে সম্মান করতে শেখায় এই একটা সাবকালচার, একটা ফ্রন্ট, ব্যতিক্রমী মানুষের একজোট হওয়া ছাড়া সভ্যতা বাঁচতে পারে না। আজ এই পোস্ট-প্যান্ডিমিক দুনিয়া তা নতুন করে দেখিয়ে দিল। এখান থেকেই বিজন-বাদল-নবারুণ-সুবিমল পেরিয়ে আরও অনেককে নিয়ে আমরা ধারাবাহিক কাজ করে যাচ্ছি ও যাব। সেলিব্রিটিদের এড়িয়েই করব। কারণ মানুষের এই সত্যগুলি তাদের কথায় বা কথার ভাঁজে কখনোই বেরবে না। কারণ, তারা বহুদিন গত হয়েছেন।

অগ্নিযুগ-সত্তর দশক দারুণ ছিল আমরা জানি। তার পর চার দশক এই শিথিল শিশ্ন কেন? যুবকরাই বা কেন আর কাউকে আইকন হিসেবে, নিজেদের লোক হিসেবে এক্সেপ্ট করতে পারছে না? সব দোষ কি যুবকদের? সম্ভবত না। তা হলে, শেষদিন পর্যন্ত ঘটক-বিজন-হেমাঙ্গরা তরুণদের সাথে কথা বলার প্র‍্যাকটিস রাখতে পারতেন না। যথেষ্ট দোষ রয়েছে “আইকন” দেরও। একটা বয়সের পর তারা তাই রেলেভেন্স হারিয়ে শো-পিস সেজে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। সারাজীবনের লিটল ম্যাগ বিপ্লব তুলে দিচ্ছে বড় প্রকাশনের হাতে, যাতে বাকি জীবনটা রয়াল্টিতে বাঁচা যায়। অনেক তো পোতিবাদ মারালাম! আর কত..

এখান থেকে আমাদের কাজ শুরু হোক। আমরা যারা তরুণ। যারা গুলিগুলো রাস্তায় না দেখলেও দেখেছি, চার দেওয়ালে, ওয়াটাসাপে আর ফেসবুকে। গুলির ধরণ বদলেছে। যারা নন্দীগ্রাম দেখেছে, দেখেছে সিপিএম পতন, ডিজিটাল আসা। তাই যাদের মননে, দাগগুলো একই আছে। 
কাজেই ধারাবাহিক ভাবে নিও-লেফট চর্চা জারি থাকছে..থাকছেই..

৩.

ভ্লাদিমির লেনিনের দেড়শো বছরের জম্মদিন পেরিয়ে এলাম। আজও উত্তেজিত হয়ে দিন বদলের স্বপ্নের কথা বলছেন তিনি। কারখানা গেটে, জাতীয় সড়কে। মস্কো বনাম গড়িয়াহাটে-ধর্মতলায়। বলছেন, দুনিয়ার শ্রমিক-মজদুরদের। এক হও। বলছেন, একটু পা চালিয়ে, কমরেড……

বন্ধ কারখানার সামনে শ্রমিকদের দিনবদলের কথা শোনাচ্ছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। নোংরা কোট পরনে। মুখেচোখে ঘাম। কিন্তু হাত মুঠো। ক্লান্তি নেই। কথা বলতে বলতে রেগে উঠছেন। হেসে উঠছেন আবার। ছোট ছোট দুটো চোখে খেলে যাচ্ছে স্বপ্ন। বসন্তের হাওয়া।

লেনিন। লেনন। লালন। নামগুলো কি কাছাকাছি না?মানুষগুলোও-প্রত্যেকেই চেয়েছেন এই দুনিয়াটা একটু সুন্দর হোক। সবার বসবাসযোগ্য হোক। আসুক সাম্য। ভালোবাসা। তাই আবাল্য লেনিন শুনলেই, বাকি দুটো নাম লেজুড় হয়ে চলে আসত মনে। মনে হত, ওরা হয়তো আত্মার আত্মীয়। কমরেড।

সমর সেন অনুবাদ করলেন, মানুষের মত মানুষ। বরিস পলেভয়ের। হাত-পা কাটা এক সৈনিক, বরফে বুক ঘষে ঘষে, জীবনের পথে জিতে যাচ্ছেন। কোন ছোটবেলায় পড়লাম। জেঠুর বই। সিঁড়ির তলার একগাদা রাদুগা-ভস্তকের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে, ডিপ্রেশান আসছে মনে হলেই, একবার উল্টে নিতাম এ বই। বিকল্প জীবনের আশাবাদ নিশান উড়িয়ে হাজির হত সামনে। মনে হত, এই লোকটাই লেনিন। হ্যাঁ, এ-ইই। আর কেই বা হবেন এমন!

সুমন তারপর শোনালেন লেনিনের গান। শীতকালে মরা দিনকালে বসন্ত এনেছেন লেনিন। রবীন্দ্রনাথ আবার তারপরের লাইনেই চলে আসেন সে গানে। সেই মুক্ত হাওয়ার বসন্তে কথার খেই ধরতে! জানলাম, বিপ্লবের প্রয়োজনে লেনিন আইজেনস্টাইনের সিনেমা ব্যবহার করেছিলেন। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকেই জানলাম। জানতাম, তাঁর শরীরে বুলেট ছিল। লাল ঘাসে নীল ঘোড়া নাটক দেখে জানতাম। সেই বুলেট নিয়েই দিনমান অমানুষিক পরিশ্রম করতেন লোকটা। করতেন অবিরাম মিটিং। কখনও কোলে থাকত প্রিয় পোষ্য বেড়াল। মুখে হাসি। বিপ্লবীরা যেমন প্রেমিক হন, তেমনই তো লোকটা অবিকল!

গুড বাই লেনিন ছবিতে দেখেছিলাম, কীভাবে লেনিনের মূর্তি উড়ে যাচ্ছে হেলিকপ্টারে। তুলে নিয়ে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। বুর্জোয়ারা, ক্যাপিট্যালিজমের হাত ধরে, তাঁকে হঠিয়ে দিচ্ছে। তিনি ধর্মতলার মোড়ের মতোই অবিকল হাত তুলে উড়ে চলেছেন। আহা! কি মায়াবি সে ইমেজ! সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা মনে পড়ছে, শতাব্দী যে ফুরিয়ে এলো। একটু পা চালিয়ে ভাই! যেন-বা বলতে চাইছেন লেনিন-শ্রমিকদের-কলকারখানার সামনে অনশনরত শ্রমিকদের..

থিও এঞ্জেলোপুলাসের ছবিতে তারপর দেখলাম, সে মূর্তি ভেঙেচুরে, কোথা থেকে যে কোথায় ভেসে চলে যাচ্ছে নীলনদ ধরে। মনে পড়ছে, আজকের পরিব্রাজকদের। যারা নিরন্তর হেঁটে চলেছেন দুনিয়াজুড়ে বাস্তুহারা। পা চালিয়েই। ব্যস্তভাবে। কবে হাঁটা শেষ জানেন না তাঁরা। ভাঙা লেনিন মূর্তি যেন বা তাঁদের বলছেন, শতাব্দী যে ফুরিয়ে এলো, একটু পা চালিয়ে ভাই!!

একটা শহরকে চেনা যাই লাইব্রেরি দিয়ে। “বালখিল্য সুলভ বদহজম”। আপনারই তো কথা এসব! আপনারই তো কয়েনেজ। কি মারাত্মক সব কথা! ৯১ তে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর অনেক কমরেডই দুনিয়াজুড়ে আত্মহত্যা করতে গেছিলেন। বলছিলেন নবারুণ। করেছিলেনও অনেকে। বিষাদে। তখনই সুমনের “হাল ছেড়ো না বন্ধু” তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়। বলে, জীবন আছে। নবারুণের হারবার্ট আত্মহত্যা করে। কিন্তু নবারুণের রাগ বদলে যায় পরিহাসে। জন্ম হয় ফ্যতাড়ুদের। তারা বদলা নেয়। পরবর্তীতে। বদলা। যা আপনারও খুব প্রিয় শব্দ..

“কী করতে হবে?” যখন এ প্রশ্ন আজও ভাবিয়ে তোলে জীবনের পথে, মনে পড়ে আপনার কথা লেনিন। দেখি বন্ধ কারখানার সামনে আপনি দিনমান ঘামতে ঘামতে বলে চলেছেন। শ্রমিকেরা হাত মুঠো করে তুলছেন ওপরে। আপনি উত্তেজিত। মুখে কেউ একজন, ছুপা বুর্জোয়া, থুথু ছুঁড়লেন। আপনি হঠাৎ থামলেন। খুঁজলেন কে করল এটা? রুমাল বের করে মুছলেন ফ্রেঞ্চকাট। ফের নিস্তদ্ধতা ভেঙে বলতে শুরু করলেন..

জুলিয়াস ফুচিকের লেখায় আপনার হাসির কথা আছে লেনিন। কীভাবে আপনাকে কব্জা করতে চেষ্টা করছে বুর্জোয়া বুড়ো ভাণ্ডারলিপ। আপনি শুনছেন মন দিয়ে তার ষড়যন্ত্র। দেখছেন, কীভাবে সে ভাঁড় আপনাকে পিঠে ছুড়ি মারতে চেষ্টা করছে। সে বলছে, ভরসা করতে। বলছে, তবেই দুধ বইবে নর্দমা দিয়ে রাশিয়ার। আপনি শেষে শুধু হাসছেন। ঝিলিক খেলছে চোখে। দুনিয়া কাঁপানো দিনগুলো শুনছে, আপনার হাসির হাওয়ার সনসন..বসন্ত আসন্ন..রাশিয়া ভরে উঠছে সে হাসিতে..দুলে উঠছে গাছপালা মায় সাইবেরিয়া..সেন্ট পিটার্সবুর্গ..মস্কো..আপনি বলছেন আপামর দুনিয়াবসীকে..

বেজে উঠল ইন্টারন্যাশানাল। বুলেটফুলেট পরোয়া করছেন না আপনি। লেনিন। যিনি ছেলেবেলায় কথা দিয়ে দেওয়াল ভাঙতে পারতেন। বোকা বুড়ো যেমন পাহাড় ভাঙতেন, রোজ, একটু একটু করে..
শতাব্দী যে ফুরিয়ে এলো। একটু পা চালিয়ে ভাই..

৪.

পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্স লণ্ডনের কনসার্টে কবি ও একটিভিস্ট আমির আজিজের কবিতা পড়লেন।আমির আমার বয়সী হবেন। দিল্লিতে তথা দেশে আগুন লাগার পর থেকে বারেবারে দগ্ধ হয়েছেন। যে কবিতাটি রজার পড়লেন, তার নাম, “সব ইয়াদ রাখা যায়েগা।”

পার্ক সার্কাস। সল্ট লেক। গড়িয়াহাটে ফুটে রয়েছে আরক্ত পলাশ। কিছু ঝরে আছে রাস্তায়। আলি আকবর বাজাচ্ছেন, দরবারি কানাড়া। আস্ত একটা মল্লযুদ্ধ চলছে ব্রহ্মান্ডজুড়ে। যা কিছু ওঠে, তাই তো নেমে আসে পরে।

এস মুরলিধরকে বিদায় জানানোর পর নতুন বেঞ্চ অভিযুক্ত কপিল মিশ্র-সহ চার বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর প্রসঙ্গে দিল্লি পুলিশের আইনজীবী জানালেন, এখন নাকি অভিযোগ জানানোর সঠিক সময় না। বস্তুত, মুরলিধর জানিয়েছিলেন, দেশে আরেকটা ১৯৮৪ হতে দিতে পারে না আদালত।

প্রেমকান্ত বাঘেল ৬জনকে প্রাণে বাঁচাতে গিয়ে নিজে পুড়ে গিয়েছেন। প্রাণের জন্য লড়ছিলেন তিনি। লড়তে লড়তেও জানিয়েছেন, তিনি খুশি। অন্তত প্রাণ বাঁচানো গেছে ৬জনের। কেমন আছেন এখন তিনি? কেউ জানেন?
মুসলমানদের দিল্লি থেকে খাঁচায় ভরে মুরগির মত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথায় যেন। নীচে হেডলাইন, হিন্দু মন্ত্রী বলছেন, “ওদের প্রাণের দায়িত্ব আমাদের।”(??)

দরবারি কানাড়া বাজছে দ্রুত। আলি আকবর বলছেন, আমি বাজাচ্ছি না। ভগবান/আল্লা বাজাচ্ছেন। আমি শুনছি। বাবা শুনছেন। একটা মল্লযুদ্ধ হচ্ছে। শিল্প আর মেধার মল্লযুদ্ধ। খুলে খুলে যাচ্ছে আকাশ। খুলছে ব্রহ্মাণ্ড। সাদা আলো দেখা যাচ্ছে। আকাশজুড়ে। চেতনাজুড়ে। তাতে লাল ছিটে। 

রক্তের না পলাশের?

৫.

বসন্ত বিলাপের সেই বিখ্যাত মুহূর্ত। একবার বলো উত্তম কুমার। চিন্ময় রায় আর তাঁর প্রেমিকা আলো জলের ধারে বসে আছে। চিন্ময় বলছেন, ‘এই সিনেমা যাবে?’ আলো-‘এই দুপুরে? কাকিমা এলে কি বলবে..’ এরপরেই রেগে ওঠেন চিন্ময়, ‘কে..কে..ক্কে? কাক্কিমা! বাদ দাও যত্তসব ওল্ড ক্যাডাভেরাস লেডি..’ সাথে সাথেই কাকিমার প্রবেশ। আর পালাবার পথ না পেয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়া চিন্ময়ের।

বাবা-মাদের প্রজন্ম কেমন ভাবে প্রেম করত, জানতে এ মুহূর্ত যথেষ্ট। এ ছবিতেই আরেকটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে। পাড়ার ডাক্তারবাবু দেখে ফেলেছেন বান্ধবীর সাথে অনুপ কুমারকে। তাতে, সিঁড়ির নীচে লুকোনোর চেষ্টা করছেন অনুপ, পাছে সৌমিত্রকে সব বলে দেন ডাক্তারবাবু তরুণকুমার। সৌমিত্রর সাথে বসন্ত বিলাপের ঝামেলা সুবিদিত। ছবির শুরুতেই খামোখা অপর্ণা সেন রাস্তায় রীতিমত অপমান করেছেন তাঁকে। তাতেই প্রবল রেষারেষি। অথচ সৌমিত্রর আড়ালে তাঁর দলেরই অনুপ, রবি ঘোষ, চিন্ময় সকলেই তলায় তলায় প্রেম করছে অপর্ণা বাহিনীর সাথে। তাই, অনুপ লুকিয়ে পড়েছে ডাক্তারবাবুকে দেখেই সিঁড়ির নীচে। আর সেই ফাঁকে সাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছে চোর। সাথে সাথে একটা হইচই পড়ে যাওয়া পাড়ায়।

তরুণ কুমারের চরিত্রটি এখানে ইন্টেরেস্টিং। তিনি ডাক্তারবাবু। বয়স্ক। কিন্তু তাঁর কনসার্ন- কে কার সাথে পাড়ায় প্রেম করছে! অথচ, সৌমিত্র ও অপর্ণা বাহিনী সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক। তবু পাড়ার এক প্রবীণকে ও তাঁর ডাক্তারখানার বন্ধুদের তাঁরা সমীহ করে। এ জায়গাটা ইন্টেরেস্টিং। সেই সমীহ থেকে আজীবন প্রবীণদের দেখে সিগারেট ট্যাপ করেন অনুপ কুমাররা। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চালান রবি ঘোষ, চিন্ময়রা। কাকিমা চলে এলে, জলে ঝাঁপ মারেন!

পুজোর মরশুম। প্রেমের মরশুম। তর্পণের মুহূর্তও। দাদার কীর্তি ছবিটির কথা মনে পড়ছে। গোটা ছবি জুড়েই প্রবাসের বাঙালিরা। ছন্দবাণী ক্লাব। একদল সরল সিধে মানুষ। গিরিডি বা মধুপুরের ল্যান্ডাস্কেপ। আদর্শ মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র। একদল বাবা-মা’দের প্রজন্মের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, যেখানে সম্ভ্রম-সম্মান আছে। মেয়েরা বাবার সামনে সকালে রবীন্দ্রসংগীত গান। আর বাইরে থেকে তা শুনে ফেলে দাঁড়িয়ে যান তাপস পাল। দূর থেকে অনুপ কুমার বাহিনী  হাতে সেফটিপিন নিয়ে প্রেমে পড়া সরল সিধে তাপস পালকে টার্গেট করে। পরবর্তী ছবি জুড়েই কতভাবে তাপসের প্রেমের বেলুন চুপসে দেবেন অনুপ বাহিনী, তা সবার জানা।

দু দশক আগেও এমন একটা সহজ সমাজ ছিল। দুটি ছবির রেফারেন্স টেনে সেটাই ধরতে চাইলাম। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। দিচ্ছি না। এ দুটি ছবির মুহূর্তগুলি কি বলে আপনাদের? আমায় বলে, একটা আড়ালের কথা। আব্রুতার কথা। যা সমাজের গায়ে আলতো করে চাপানো ছিল। নব্বইয়ের বিশ্বায়ন যা খসিয়ে দিল এসে। কাচুলি খুলে দাঁড়িয়ে পড়লেন তারপর মা। নাভির নীচে শাড়ি নামিয়ে পা তুলে দিলেন আকাশে। সন্ততিরা বাবা-মায়ের সামনেই বলল ‘ফাক’। চুমু খেল রাস্তায়, বিপ্লবে। তাতে বাবা-মা এর গর্বের শেষ নেই। শান্তভাবে যৌনতার পর ব্লেড চালিয়ে দিল গলায় পার্টনারের। রাজারহাটের কুড়ি তলা জানতেই পারল না কিছু

হাইরাইজের আলো পেরিয়ে তারপর ছুরিটা মুছে, পার্টনারের লাশ ব্যাগপ্যাক করে, ফ্লাইট ধরল খুনি/ আততায়ী/ লিভ-ইন পার্টনার।
পুজো এসে গেল। আমি এসবের গভীরে আর ঢুকব না। আমার নানা লেখাতেই চলে আসে এই ডার্ক ডিপ্রেসড সাইকোটিক প্রজন্ম আমার। আমি বলতে চাইছি, মাত্র দুটো দশকে একটা সম্পূর্ণ ইডিওলজি বিহীন প্রজন্ম কীভাবে তৈরি হল? কারা বানাল?কেন বানাল? ভাবুন। কেন দুটো দশকে শিল্পসাহিত্যে রাজনীতি ব্যপারটাকেই খিল্লি করে দেওয়া হল? কারা করল? ভাবুন। ভাবা প্র‍্যাক্টিস করার সময়ও আর নেই।

‘বৃদ্ধরা নির্লজ্জ হলে মানুষের বড়ো অসম্মান!’ আর ‘আমরা পৃথিবীর লোক/আমাদের অভিমান হোক।’ বিষ্ণু দে আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বড় প্রিয় দুটি লাইন আমার। আমাদের মাস্টারমশাই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রায়ই বলেন লাইন দুটি। পুজো এসে গেল। শরতের আকাশ নীল। বান্ধবীরা কাজল পড়বে। দেখা করতে চাইবে তারপর। বন্ধুরাও তাই সেজে উঠছে। সেজে উঠছে শহর। যেন আস্ত একটা শহর এখন আর্ট গ্যালারি হয়ে ওঠে। মোড়ে মোড়ে মাটির দুর্গা বানান শিল্পীরা। ইন্সটল্যেশান শিল্পীরা মণ্ডপ সাজিয়ে তোলেন।

আমাদের মাস্ক পড়তে হচ্ছে। কারণ, চারপাশ অন্ধকার। কিন্তু, এখনও শিউলি আর ছাতিমের গন্ধও পাচ্ছি যে..এ তো তর্পণের সময়..ঘাটে এসে দাঁড়াই চলুন….দেখি অশ্রুনদীর সুদূর পাড়ে এখনও সৌমিত্র আর তাঁর দলবল পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন অগ্রজদের..ডাক্তারবাবু নাড়ি ধরেই বুঝে যাচ্ছেন, সময়ের রোগ..দাদার কীর্তির তাপস পাল নরম হেসে বলছেন, ‘পুজো ভালো কাটুক, সকলের..’

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla