পশ্চিমবঙ্গ কে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পাখির চোখ করে সেই ২০১৪ সাল থেকে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ক্ষমতায় আসতে। তখন বিজেপি কে অনেকে হেসে, খিল্লি করে খাটো করে দেখলেও, “এটা পশ্চিমবঙ্গ, এখানে ওরা পারবে না” গোছের কথা বললেও ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে তাঁদের অনেকের হয় দাঁতকপাটি লেগেছিল আর না হয় তাঁরা নিজেরাও দলে দলে বিজেপির ঝাণ্ডা তুলে “জয় শ্রী রাম” ধ্বনি দেওয়া শুরু করেন। এবার যখন ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে তত বেশি মানুষের মধ্যে এই ধারণাটা দৃঢ় ভাবে গেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো––যে বিজেপির বিজয় অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে কী করতে হবে? এই বাস্তব সমস্যার সমাধান নিয়ে কিন্তু বেশি মাথা ঘামানো হচ্ছে না।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৫.৭২ কোটি বৈধ ভোটের মধ্যে বিজেপি পায় ২.৩০ কোটি ভোট, বা মোট ভোটের ৪০.২৫%, এবং ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন জিতে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস পায় ২.৪৭ কোটি ভোট, অর্থাৎ ৪৩.২৮% ভোট পেয়ে জেতে ২২টি আসন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বামফ্রন্টের সাথে জোট করে দুইটি আসন জেতে মোট ৫.৬১% ভোট পেয়ে। এবার ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যানের সাথে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যান কে মিলিয়ে দেখলেই——ভোটার সংখ্যা ও বৈধ ভোট বাদ দিয়ে——স্পষ্ট হবে যে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট প্রাপ্তি ১৬.৮% ভোট থেকে এক লাফে ৪০.২৫% ভোট বিজেপির পাওয়ার পিছনে আছে বামফ্রন্টের কর্ণধার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] এর সমর্থনে হ্রাস।
একদিকে রাজ্যের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনৈতিক সঙ্কটের থেকে মুক্তি পেতে, কর্মসংস্থান পেতে, পেটে ভাত পেতে অনেক মানুষ দলে দলে বিজেপি কে ভোট দিয়েছিলেন ২০১৯ সালে, আবার চরম বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কোন পরিবর্তন না দেখা গেলেও কিন্তু বহু মানুষ বিজেপি কে পশ্চিমবঙ্গে ভোট দিয়েছিলেন কারণ তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচারের থেকে, সিন্ডিকেট রাজত্ব থেকে, তোলাবাজি থেকে যেমন মুক্তি চেয়েছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের মাথাদের দুর্নীতির যেমন বিচার চেয়েছিলেন, তেমনি অনেকে আবার শুধুই ইসলাম বিদ্বেষ থেকে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী মনোভাবের কারণ বশত বিজেপি কে ভোট দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে রাফাল জেট দুর্নীতির থেকে বাঁচাতে তুলে ধরেন বালাকোট “সার্জিকাল স্ট্রাইকের” গল্প। যার আগে আসে পুলওয়ামায় কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর উপর জঙ্গী হামলা। আর গোটা নির্বাচন এই পাকিস্তান কে “টাইট” দেওয়া কেন্দ্রিক ইস্যুতে হয়।
তবে ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে কিন্তু সমীকরণে অনেক পরিবর্তন হওয়ার ইঙ্গিত আছে। নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে কী কাঠখড় পোড়াতে হবে সেই আলোচনা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হল পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে কী কী ইস্যু নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে, সেটা ব্যাখ্যা করা।
বর্তমানে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোর কাছে গেরুয়া শিবিরের বিজয়রথ রুখে দেওয়ার সুযোগ আছে তিনটি মূল ইস্যুতে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে এই তিনটি ইস্যু কে যদি ত্রিফলা হিসাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে খেলা ঘোরানো সম্ভব হবে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে দরকার নাগরিকত্ব আন্দোলন
পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নিয়ে চরম আতঙ্ক ছিল ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত। এর মধ্যেই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯) পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে অমুসলিমদের, বিশেষ করে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের, যাঁদের সিংহভাগ মতুয়া সম্প্রদায়ের, বিজেপি বোঝাতে চেয়েছে যে এনআরসি হলে শুধু মুসলিমদের বিপদ হবে। অসংখ্য গরিব, খেটে-খাওয়া, শ্রমজীবী অমুসলিম মানুষ সেটা কিন্তু মেনে নেন কারণ তাঁরা জানেনও না যে তাঁদের সিএএ ২০১৯ কোন নাগরিকত্ব তো দূরের কথা আবেদনের সুযোগও দেবে না। তাই এনআরসি হলে অসংখ্য অমুসলিম গরিব, বিশেষ করে নমঃশূদ্র ও মতুয়া উদ্বাস্তুরা, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা, ইত্যাদী, চরম বিপদে পড়বেন কারণ তাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে সস্তা শ্রমিকে পরিণত করবে বিজেপি এবং খুবই নগন্য মানুষের কাছে ভোটাধিকার রেখে একটি ফ্যাসিস্ট ধর্মান্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলবে সেই দল।
যেহেতু নাগরিকত্ব হল একজনের মৌলিক পরিচয়, তাই সিএএ ২০১৯ এর অপরাগতার কথা বলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষ কে সামিল করা যায় আইন করে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবি আদায় করার লড়াইয়ে। তাঁদের গৃহহীন হতে হবে, সস্তা শ্রমিক হতে হবে, সংসার যে তাঁদের ভেস্তে যাবে, তাঁদের জীবনের যে এক ভয়াবহ পরিণতি হবে বিজেপি-র ষড়যন্ত্রের ফলে, সেটা আইনের সঠিক ব্যাখ্যা করে ও সবচেয়ে রেডিক্যাল দাবির—নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবি—ভিত্তিতে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করে যদি সংগ্রাম করা যায় তাহলে এর ফল কিন্তু ব্যাপক হবে এবং ধর্মীয় মেরুকরণের সমীকরণ এর ফলে ভেস্তে যাবে। সম্প্রতি দলিত-আদিবাসী-মাইনোরিটি আন্দোলন লীগ (দামাল) নামক একটি সংগঠন অভাবিত কাজ করে দেখিয়েছে এই বিষয়ে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে তাঁরা দলে দলে নমঃশূদ্র, মতুয়া উদ্বাস্তুদের, আদিবাসীদের, মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। এর ফলে চাপে পড়েছে বিজেপি মতুয়া অঞ্চলগুলোয় আর তাই কৃষকের বাড়িতে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার ভুঁড়িভোজ চললেও তাঁরা যেনতেন প্রকারে মতুয়াদের এড়িয়ে যাচ্ছেন।
বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩) এনে সবার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল। সেই আইন যখন পার্লামেন্টে পাশ হয় তখন কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস বাজপেয়ী সরকারের সাথে জোটবদ্ধ ছিল। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিএএ ২০০৩ পাশ হলেও সেই আইন প্রণয়ন হয়েছিল এক বছর পরে, ডিসেম্বর ২০০৪ সালে, যখন কেন্দ্রে কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) সরকার–আর সেই সরকারের দ্বিতীয় বৃহৎ শরিক ছিল সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। এর ফলে উদ্বাস্তু মানুষেরা, বিশেষ করে বাঙালি মতুয়া আর নমঃশূদ্র মানুষেরা রাতারাতি “বেআইনি অভিবাসী” হয়ে গেলেন। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই এই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মতুয়া আর নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যে নিজের ভিত শক্তিশালী করলেও সিএএ ২০১৯ দিয়ে এই কোটি কোটি মানুষের সাথেই চরম ধাপ্পাবাজি করেছে বিজেপি।
এই আইনের ফলে মাত্র ৩১,৩১৩ জন পঞ্জীকৃত “শরণার্থী” মর্যাদা পেলেন। কিন্তু এই আইন কে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে বিজেপি। এবার গত এক বছর ধরে এই আইনের নিয়মাবলী প্রকাশ করেননি শাহ কারণ সেটা করলে ব্যাপক অংশের মতুয়ারা বুঝে যাবেন যে তাঁদের উপর নেমে আসছে কী সর্বনাশ। তাই কখনো সুপ্রিম কোর্টের বাহানা করে তো কখনো করোনা ভাইরাসের টিকার বাহানা করে সিএএ ২০১৯ এর রুলস প্রকাশ করছে না বিজেপি। ফলে গোটা রাজ্যে গরিব মানুষের বাড়িতে তাঁদের ঘাড় ভেঙে বিজেপি নেতারা খেলেও, কৃষকের বাড়িতে নাড্ডার ভুঁড়িভোজ হলেও, মতুয়া পাড়ায় আর যেতে পারছেন না তাঁরা।
যেহেতু সিএএ ২০০৩ এর মাধ্যমে এনআরসি হবে আর যেহেতু এই আইন কে পাশ করানোর বেলায় একই অবস্থান ছিল বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই(এম) আর কংগ্রেসের, তাই বিজেপি বিরোধিতার জন্যে শেষ তিনটি দল মুখে এনআরসি বিরোধিতা করলেও ফাঁপা আইন সিএএ ২০১৯ নিয়ে একই লেবু বারবার চটকে যাচ্ছে, একবারও সিএএ ২০০৩ বাতিলের কথা তুলছে না। ঠিক সেই কারণে বিজেপি কে নাগরিকত্বের প্রশ্নে ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আটকাতে এই তথাকথিত বিজেপি-বিরোধীদের স্বার্থে ঘা লাগবে। অসংখ্য মানুষের বেনাগরিকত্বের সমস্যা এরা তাই জনগণ কে না বলে, সিএএ ২০১৯ আর এনআরসি কে শুধুমাত্র মুসলিম সমস্যা হিসাবে দেখিয়ে, শাহের “ক্রোনোলজি”-র গল্প শুনিয়ে ব্যাপক নমঃশূদ্র, আদিবাসী, মতুয়া ও উদ্বাস্তু অমুসলিমদের লড়াই থেকে দূরে করতে এরা তাই সচেষ্ট।
এই জন্যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে নতুন একটি নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক ভারতবাসীর নিঃশর্ত নাগরিকত্বের অধিকার সুনিশ্চিত করার দাবি তুলে যদি প্রগতিশীল আর গণতান্ত্রিক ফ্যাসিবিরোধী শক্তিগুলো বিজেপির বিরুদ্ধে জনগণকে—বিশেষ করে মতুয়া, আদিবাসী, নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের—সমস্যাটা সঠিক ভাবে বুঝিয়ে, লড়াইয়ের ময়দানে সমবেত করতে পারে তাহলে বিজেপির ভিত্তি ভাঙা সম্ভব হবে। যদি তা না করে মানুষের আন্দোলনটি কে বিজেপির ফর্মুলা অনুসারে হিন্দু-মুসলিম করে ভাঙা হয়, যদি বাস্তব সমস্যার বাস্তব বিশ্লেষণকে বাদ দিয়ে শুধু নাগরিকত্বের ইস্যুটি সাম্প্রদায়িক লেন্স দিয়ে দেখা হয়, তাহলে কিন্তু নেপোয় মারে দই হবে আর বিজেপির সাথে এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই (এম), কংগ্রেস, প্রভৃতি।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে দরকার রুজি রুটির দাবি
ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়ে জানুয়ারি ২০২১ এ হয়েছে ৮.৫%, যদিও নভেম্বর ২০২০-তে তা ছিল ৬.৫% আর ডিসেম্বর মাসে ৯.১% এ তার পারদ চড়ে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি (সিএমআইই) দেখাচ্ছে যে ৪,২৩৪টি কোম্পানির উপর করা সমীক্ষায় পাওয়া গেছে যে ৫০% কোম্পানি চরম ভাবে মুনাফা করলেও স্থায়ী কর্মচারীদের বেতন কেটে ফেলেছে আর অস্থায়ী কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছে। এর ফলে কাজ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এই লোকগুলোর রোজগারের বন্দোবস্ত না করে, কর্মহীন ছেলে মেয়েদের চাকরির সুযোগ শেষ করে দিয়ে মোদী আর বিজেপি আজ পশ্চিমবঙ্গ কে সোনার বাংলা বানাবার কথা বলছে।
২০২০ সালের ২৫শে মার্চ থেকে যে অমানুষিক লকডাউন শুরু করে মোদী সরকার, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য শ্রমিক, যাঁরা অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যান, চরম হয়রানির শিকার হন। অনেকে পায়ে হেঁটে রাজ্যে ফেরেন আর পথে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে, তাঁরা নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকারও হন। সেই সময়ে কিন্তু মোদী বা বিজেপি “সোনার বাংলা” গড়ার কথা বলেনি। আজ যখন রাজ্যের জন্যে ১০০ দিনের কাজ, আম্ফান ক্ষতিপূরণ, জিএসটি ক্ষতিপূরণ, প্রভৃতি খাতে হয় বরাদ্দ কমানো হয়েছে বা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, রাজ্যের অর্থনীতি কে শুকিয়ে মারতে, তখন মোদীর ভৃত্যরা রাজ্যে এসে নৃত্য করলেও, তাঁদের রাজনীতি খণ্ডন না করে, সেই বিষয় তুলে তীব্র প্রচার না করে, বিজেপি কে নাস্তানাবুদ না করে, শুধু তৃণমূল কে “চাল চোর” প্রতিপন্ন করতে বেশি উৎসাহী কংগ্রেস আর সিপিআই (এম)।
যদিও বিজেপি প্রচার করছে যে বাংলার তাঁরা “কর্মসংস্থান এর সুযোগ”—কর্মসংস্থান বা চাকরী নয় কিন্তু—সৃষ্টি করবে, তবে এই প্রতিশ্রুতি কতটা ফাঁপা সেটা যে কোন বিজেপি শাসিত রাজ্যের বিগত কয়েক বছরের কর্মসংস্থান এবং বেকারত্বের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। কর্মসংস্থানের জায়গায় শুধু কর্মহীন হয়েছেন মানুষ। সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে ডিসেম্বর ২০২০ তে যখন পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্ব ছিল ৬%, বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশের বেকারত্ব ছিল ১৪.৯%, ত্রিপুরায় ১৮.২%, আসামে ৭.৬% আর হরিয়ানার মতন রাজ্যে সেটা আবার ৩২.৫%, সর্বাধিক। ফলে বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে “কর্মসংস্থান এর সুযোগ” তৈরি করবে তাহলে নিজের শাসিত রাজ্যগুলোয় কেন করেনি?
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পাশের আসাম আর ত্রিপুরা কে দেখলেই বোঝা যায় কী রকম “সোনার বাংলা” গড়ে তুলবে বিজেপি। ইতিমধ্যে ভারতীয় রেল, জাহাজ কর্পোরেশন, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, সেল, প্রভৃতি রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন শিল্প বেচে দিচ্ছে মোদী সরকার। এর সাথে বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা। পশ্চিমবঙ্গের বুকে অবস্থিত হিন্দুস্থান কেবলস, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস, প্রভৃতি কে বন্ধ বা রুগ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। এর পরে কী ভাবে বিজেপি মানুষ কে চাকরি দেওয়ার কথা বলতেও পারে?
তাই স্কুল শিক্ষকদের, যাঁদের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জের রাজনীতি প্রভাবিত হয়, বেকার যুবক – যুবতীদের, যাঁদের মধ্যে কর্মহীন হয়ে বেঁচে থাকার জ্বালাটা প্রচন্ড, বন্ধ কল কারখানার শ্রমিকদের, যাঁদের জীবনে অর্থনৈতিক হতাশা অনেক জেঁকে বসেছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের, যাঁরা শহুরে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যপকতম অংশ আর অন্যান্য ভুক্তভোগী মানুষকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত প্রচার করে যেতে হবে কেমন করে বিজেপি নানা ভাবে সরকারি চাকরি শেষ করেছে, কী ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, জমি, খনিজ পদার্থ, ইত্যাদি বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে দেখাতে হবে বিজেপিও যে তৃণমূল
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে নিজে ভিত্তি এককালে শক্তিশালী করে তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে। যেহেতু কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) কে মানুষ আর ভরসা করতে পারেন না ও ব্যাপক সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে, বিশেষ করে নমঃশূদ্র, মতুয়া, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জাতির (ওবিসি) মানুষদের মধ্যে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের শাসকশ্রেণীর দ্বারা ইসলামবিদ্বেষ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তাই বিজেপি সহজে নিজের জায়গা করতে পেরেছিল। যদিও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের কথা শুকনো তত্ত্বের মতন না আওড়ে বরং নাগরিকত্বের ইস্যুতে কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মেরুকরণের খেলা কে ভাঙা সম্ভব, তৃণমূলের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, তোলাবাজি থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট রাজত্ব কে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না। তবে এই জায়গায় বিজেপি নিজেই একটা অস্ত্র তুলে দিয়েছে যা তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে বারবার রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে যে তৃণমূল কংগ্রেসের বড়, মেজ, সেজ থেকে একেবারে চুনোপুঁটির মতন ছোট নেতারা, সিপিআই (এম) আর কংগ্রেস পার্টির সর্বস্তরের নেতারা, দলে-দলে কী ভাবে বিজেপির ঝাণ্ডা ধরেছে। ফলে বিজেপি যে তৃণমূল কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) আর কংগ্রেসের থেকে আলাদা নয় বরং একই লোকের দল, সেই সত্যটা বারবার বলে যেতে হবে। মুকুল রায়ের মতন দুর্নীতিবাজ তৃণমূল কংগ্রেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে নন্দীগ্রাম-খ্যাত শুভেন্দু অধিকারী বা অর্জুন সিং এর মতন সমাজবিরোধীরা কী ভাবে বিজেপির ঘরে আশ্রয় পাচ্ছে ও তাদের দাপট এবং দুর্নীতি বজায় থাকছে সেটা বারবার মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার।
তৃণমূল কংগ্রেস থেকে দলে দলে বিজেপির ঘরে সর্বস্তরের নেতাদের ডিগবাজি দেখে রাজ্যের রাজনীতিতে একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে আর এর ফলে মানুষ কে আরও সহজে বোঝানো সম্ভব যে বিজেপি এলে মানুষের উপর সেই শোষণ, অত্যাচার আর লুণ্ঠনই নতুন মাত্রায় চলবে আর সাথে জুড়বে সাম্প্রদায়িক হিংসা। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে আজ এই দল বদলের ফলে বিজেপির তৃণমূল হওয়া কে অবশ্যই জোর দিয়ে প্রচার করতে হবে।
এই তিনটি ফর্মুলা কে একই সূত্রে বেঁধে যদি ক্রমাগত, এলাকা-ভিত্তিক, শ্রেণী-জাতিগত অবস্থান দেখে জনগণের মধ্যে প্রচার করা যায় তাহলে রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি কে কোনঠাসা করা সম্ভব। এর মধ্যে তিনটিই জরুরী ও একটি কে ছেড়ে অন্যটি ধরলে কিন্তু ফল পাওয়া যাবে না। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে হারাতে গেলে, এই বিষয়গুলো নিয়ে অবিলম্বে প্রচার করতে হবে।