যারা ২রা মে’র পর পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদের হাত আরো শক্ত হওয়া নিয়ে আশঙ্কা করছিলেন, এখন তাঁরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ফ্যাসিবাদ তার ভয়ংকর রূপ নিয়ে বাংলার জনগণের উপর আছড়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ যতটা না শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে, ফ্যাসিবাদ ঠিক তার চারগুণ শক্তিশালী রূপ নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে তিনি লকডাউন হতে দেবেন না; লকডাউনের ফলে শ্রমজীবী মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয়, গত বছর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চাপানো লকডাউনে ঠিক তাই হয়ে ছিল। কিন্তু এ কথা যে তখন তিনি নিজের ভোটবাক্স ভরাতে বলেছিলেন তা আজ সবার কাছে স্পষ্ট। ক্ষমতার আসার পর তিনি ৫ই মে থেকে “আংশিক লকডাউন” করেছিলেন, তারপর ১২ই মে থেকে পূর্ণ লকডাউন চাপিয়ে দিলেন।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যখন রাজ্যের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, কর্পোরেট মুনাফাখোরি তুঙ্গে উঠছে, তখন তিনি সেই বিষয় নজর না দিয়ে ধনিক শ্রেণীকে তুষ্ট করতেই ক্ষমতায় আসার ঠিক তিন দিনের মাথায় অঘোষিত লকডাউন ডেকে দিয়েছিলেন।
আর তার আগে ও পরে, প্রকোপের মধ্যেই বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের স্বশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী বুলডোজার চালিয়ে বিরোধী দলের গরিব মানুষের বাড়ি ভেঙে দিয়েছে রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়, একেবারে ফ্যাসিবাদী কায়দায়। এখনো প্রচুর বিরোধী দল কর্মী ঘরছাড়া, এখনো প্রচুর জায়গায় এই করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিতেই বিনা প্রতিরোধে তৃণমূল কংগ্রেস এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই আক্রমণ কি শুধুই “ভোট পরবর্তী হিংসা” নাকি ফ্যাসিবাদ আরো শক্তিশালী হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই?
আজ কেন্দ্রে যখন এক ভয়াবহ ব্রাহ্মণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সরকার বসে আছে, যার নেতৃত্বে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), তখন রাজ্য সরকারে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসেরও রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ পরিস্ফুটিত হচ্ছে কেন্দ্রের সাথে পাল্লা দেওয়ার তাগিদে। করোনা আবহে অক্সিজেন, হাসপাতালের বেড, জরুরী ওষুধ, ইত্যাদির চরম কালোবাজারি থেকে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে যাওয়ার ফলে বেড়ে চলা মৃত্যু মিছিল থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরাতেই সাত বছর আগের নারদ মামলা ব্যবহার করছে মোদীর বিজেপি সরকার। বিজেপি যেমন এই মামলা ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে চাইছে, তেমনি বন্দোপাধ্যায় নিজেকে বিজেপি-বিরোধী সাজানোর জন্যে, সেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারির জন্যে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছেন।
তিনি ঘুষ কাণ্ডে ধৃত তাঁর দলীয় নেতাদের বাঁচাতে লকডাউন ভেঙে দলবল নিয়ে কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান ব্যুরো (সিবিআই) অফিসে হানা দেন। অথচ যখন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জঙ্গলমহলের পূর্বের “জনসাধারণ কমিটি” নেতা, লালগড় আন্দোলনের অন্যতম মুখ, ও বর্তমানে তাঁরই দলের রাজ্য সম্পাদক ছত্রধর মাহাতোকে দশ বছর জেল খাটার পর, পুরানো মিথ্যে মামলায়, কালা আইন ইউএপিএ লাগিয়ে গ্রেফতার করেছে, সে বিষয়ে তিনি কিন্তু় মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এমনকি রাজ্যে বামফ্রন্ট আমলের বন্দী, জনগণের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত রাজবন্দিদের মুক্তি তাঁর সরকার বিগত দশ বছরে দেননি। রাজবন্দী বুদ্ধদেব মাহাতো, কিডনি রুগী জেলের ভেতর থেকেই একদিন করে সরকারি হাসপাতালে এসে ডায়ালিসিস করাচ্ছেন।
কালোবাজারির সমস্যা ঢাকতে, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফিলতি লুকাতে ও বেসরকারিকরণের অনলাইন পদ্ধতিতে মানুষের মনোনিবেশ করাতেই বন্দোপাধ্যায় রাজ্যে এইবারের লকডাউন করেছেন। এই লকডাউন করে বন্দোপাধ্যায় তাঁর পুলিশকেও শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন কালোবাজারি রোখার বদলে। রাস্তায় আজ মানুষ নেই, পুলিশ ঘুরছে আর মানুষ পুলিশি সমাজের দিশা দেখছে। পুলিশ ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়ে, সন্ত্রাস করে, শ্রমজীবী মানুষের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বাজারের সবজি বিক্রেতা থেকে রাস্তার রিকশা চালকদের তুলে কেস দিচ্ছে, মোটা টাকা ঘুষ নিচ্ছে। গত ২৩শে মে, দমদম আর বাগুইহাটি অঞ্চলের রিকশা চালকদের সাথে কথা বলে এই রকম প্রচুর ঘটনা জানতে পেরেছি পুলিশি সন্ত্রাসের।
অথচ খেটে খাওয়া মানুষের আজ কোনো বিকল্প আয় নেই, দিতে পারেনি এই পুলিশ বা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার, কিন্তু ওলা-উবের সারাদিন চলছে এই পুলিশের সামনেই। সাতগাছি বাজারের সবজি বিক্রেতারা বলছেন, “সকাল সাতটা থেকে দশটা অবধি বাজার খোলা থাকার ফলে আরো জমায়েত বাড়ছে তার ফলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আরো বাড়ছে, কিন্তু যদি বাজার সারাদিন খোলা থাকতো তাহলে এই অবস্থা হত না, মানুষ ক্ষেপে ক্ষেপে ‘পীজিকাল ডিসটেন্স’ মেনটেন করেই বাজার করতে পারতেন।”
যখন একদিকে ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসাদারদের জন্য বন্দোপাধ্যায় দৈনিক তিন ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন, তখন রিলায়েন্স রিটেল থেকে বড় বড় রিটেল চেন আর রেস্তোরা হাফ শাটারে সারাদিন খোলা হচ্ছে, অনলাইন খাদ্য সরবরাহ ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে বৃহৎ পুঁজির মার্কেট আজ পুরোপুরি গড়ে তুলতে। বিজেপি ঠিক যে যে কাজগুলি এখানে এসে দ্রুতগতিতে করতো, বন্দোপাধ্যায় ঠিক সেই কাজই ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে করছেন। মোদীরই দেখানো পথে বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে আদানি-আম্বানি গোষ্ঠীর দ্বিতীয় “মোদী” ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শিবিরের দ্বিতীয় “শ্যামাপ্রসাদ” হওয়ার শপথ গ্রহণ করেছেন।
এখনো যাঁরা জনগণের উপর ভরসা ছেড়ে, নিজেদের আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়ে, “ফ্যাসিবাদ খতম” করতে বন্দোপাধ্যায়কে বিকল্প নেত্রী ভাবছেন, ভাবছেন় পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) বন্দোপাধ্যায় রুখে দেবেন, তাঁরা কাল্পনিক দুনিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছেন আর নয় তো রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ার মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে ফ্যাসিবাদ কে সুপ্ত কৌশলে আগলে রাখার রাজনীতি করছেন, যা আগামীতে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে; এক কথায়, রাজ্যের গরিব মানুষের সাথে এরা বিশ্বাসঘাতকতা করছেন সব দিক থেকেই। ফ্যাসিবাদের হাত শক্ত করা এই মানুষ মারা লকডাউনের বিরুদ্ধে না লড়ে ফ্যাসিবাদ কে কোন ভাবেই পরাস্ত করা যাবে না।