অতঃপর ঝুলির থেকে বেড়াল বের হল। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ঘোষণা করেছেন যে ১৫ই আগষ্ট থেকে লোকাল ট্রেন চালু হবে আবার মুম্বাইয়ে, তবে একমাত্র যাঁরা করোনা ভাইরাসের দুইটি ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাঁরাই চড়তে পারবেন ট্রেনে। এই মুহূর্তে মুম্বাই শহরের মাত্র ১৫ লক্ষ মানুষের দুই ডোজের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে, যদিও মার্চ ২০২০তে মুম্বাই লোকাল ট্রেনে দৈনিক যাতায়াত করতেন প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ।
এই ১৫ লক্ষ জনের প্রত্যেকে কিন্তু লোকাল ট্রেন যাত্রী নন। তবুও যদি মুম্বাই ও তার লাগোয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে ১৫ লক্ষ লোকাল ট্রেন যাত্রী দুই ডোজের টিকা পেয়েছেন তাহলেও মুম্বাই লোকাল ট্রেনে স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র ১৮.৫% যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন, বাকিরা পারবেন না। তাঁদের যাতায়াত করতে হলে আগে টিকা নিতে হবে, আর টিকার যখন চরম হাহাকার, শুধু সরকারি উদাসীনতার কারণে ট্রেনে না চাপতে পেরে অন্য ভাবে, বেশি পয়সা খরচ করে, যাতায়াত করতে হবে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ কে।
মহারাষ্ট্রে, এর আগে, ফেব্রুয়ারি মাসে যখন মুম্বাই লোকাল ট্রেন পরিষেবা চালু ছিল, তখন করোনা ভাইরাসের কারণে তার সময়সরণীতে অদ্ভুত পরিবর্তন আনে ঠাকরের সরকার। ভোর বেলা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত, তার পরে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, আর রাত ৯টার পর থেকে একেবারে শেষ ট্রেন পর্যন্ত পরিষেবা চালানো হয়, যার ফলে নিত্য যাত্রীরা, যাঁরা সকাল ৮টা থেকে ১১টা বা বিকেল ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করতেন, তাঁদের বাধ্য হয়ে অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়।
মহারাষ্ট্র সরকার ৭ই আগষ্ট পর্যন্ত ৪৬,৬৮৭,৫৭২ মানুষের টিকাকরণ হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশ, ১১,৯৪৭,৭২৩ জনের, টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। ৭ই আগষ্ট গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে মাত্র ৩১০,৬৮৬ জন কে টিকা দেওয়া হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ২০৯,১৩০ জন প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন আর ১০১,৫৫৬ জন দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন। এই ভাবে দেখতে গেলে আগামী বছরেও মহারাষ্ট্রের সম্পূর্ণ হবে না টিকাকরণ আর তার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের টিকা বণ্টন নীতির।
অথচ, এই সময়ে, যখন মানুষের আর্থিক দুর্দশা চরমে উঠেছে, যখন মানুষ পেট্রো পণ্য সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চূড়ান্ত সঙ্কটে পড়েছেন, তখন তাঁদের জন্যে গণ পরিবহন মাধ্যমে সুরক্ষিত ভাবে যাতায়াত করার ব্যবস্থা না করে, তাঁদের আরও অসুবিধায় ফেলা হয়েছে লোকাল ট্রেন বন্ধ রেখে। করোনা ভাইরাস ছড়ানোর মূল কারণ কিন্তু লোকাল ট্রেন না, কী মুম্বাইয়ে আর কী কলকাতায়। অথচ এই লোকাল ট্রেন পরিষেবা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মানুষের লাগামের বাইরে। কেন?
ঠাকরের সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে লোকাল ট্রেন চালাবার তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সেই একই পথে চলতে পারে। ঘোষণা করতে পারে যে শুধু দুই ডোজ টিকার সার্টিফিকেট থাকলে অনলাইন পাস ডাউনলোড করে যাতায়াত করার কথা। ঠাকরের মতন। আর তাতে আরও অসুবিধা হবে স্মার্টফোন যাঁদের নেই, তাঁদের। আর এই ভাবেই, নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির ফেরিওয়ালারা গণ পরিবহন মাধ্যমের যাত্রী সংখ্যা কমিয়ে, ভাড়া বাড়িয়ে বা রেল বেসরকারিকরণ করে জনগণের ক্ষতি করতে চাইছে।
করোনা ভাইরাস মহামারী যে আদতে বৃহৎ পুঁজির কাছে একটি উৎসবের চেয়ে কম নয়, তা নিয়ে তো অনেক তথ্যই প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু যে ভাবে এই সুযোগে বৃহৎ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো কে চূড়ান্ত মুনাফা আয় করার পথ করে দিচ্ছে সরকারি ভাবে বাধ্যতামূলক না হওয়া টিকাকরণ, তাতে বোঝা যাচ্ছে কী ভাবে আধার দিয়ে, ব্যক্তিগত পরিসরে নজরদারি চালিয়ে রাষ্ট্র এই বার গরিব মানুষের চলাচল কেও নিয়ন্ত্রিত করবে। এর ফলে, মুম্বাই লোকাল ট্রেনের মতন কলকাতা ও দক্ষিণ বঙ্গের লোকাল বন্ধ করে শুধু টিকাকরণের মাধ্যমে যদি মানুষ কে যাতায়াত করতে বাধ্য করে সরকার তাহলে সহজেই লোকসানের বহর দেখিয়ে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি থেকে রেল বেসরকারিকরণ সবই করতে পারে কেন্দ্র সরকার। তাহলে নরেন্দ্র মোদী আর ঠাকরে বা মমতা বন্দোপাধ্যায়, প্রভৃতির মধ্যে কী পার্থক্য থাকলো?
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার জনগণ করোনা ভাইরাসের নাম করে মানুষের জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, বিরাট জন সমাবেশ হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। টিকাকরণ আর কোভিড চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়েও তীব্র মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে নানা দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে। জায়নবাদী ইজরায়েল আর মার্কিন দেশে বলা হয়েছিল টিকা নেওয়ার পরে করোনা বিধি মানার আর দরকার নেই। ইজরায়েলের তো প্রায় ১০০% মানুষই টিকা পেয়েছিলেন। তবুও দেখা গেল সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু হচ্ছে আর টিকা সেই ক্ষেত্রে কাজ করছে না কারণ আরএনএ ভাইরাস যে দ্রুত মিউটেট করছে সেই জায়গায় পুরানো ভাইরাসের ভিত্তিতে বানানো টিকা অকার্যকর হচ্ছে।
এমন সময় যদি এটাই প্রচার করা হয় যে দুই ডোজ টিকা নিয়ে মানুষ বিপদ মুক্ত হবেন বা তখনই লোকাল ট্রেনে চাপতে পারবেন, কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন, তাহলে কি সেটা মানুষের সাথে প্রতারণা করা হবে না? এই সঙ্কট থেকে মানুষের মুক্তি কী ভাবে আসবে? যখন বিরোধী দলগুলোও কেন্দ্রীয় সরকারের করোনা ভাইরাস নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করছে, তখন মানুষের কাছে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কী রাস্তাই বা থাকতে পারে?