প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতে পাম তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে যার অধীনে ₹১১,০৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ₹৮,৮৪৪ কোটি কেন্দ্রীয় সরকার দেবে আর ₹২,১৯৬ কোটি দেবে রাজ্য সরকারগুলো।
জাতীয় ভোজ্য তেল মিশন-পাম তেল (এনএমইও-ওপি) নামক প্রকল্পে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এবং উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোয় তৈল পামের চাষ বৃদ্ধি করা হবে যাতে ভারতে পাম তেল আমদানি কম করা যায়। এনএমইও-ওপি-র অধীনে ২০২৫-২৬ সাল পর্যন্ত ৬৫০,০০০ হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে তৈল পামের চাষ করা হবে ও ধীরে ধীরে সেই জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ লক্ষ হেক্টর করা হবে।
এই এনএমইও-ওপি প্রকল্পের মাধ্যমে, মোদী সরকার ২০২৫-২৬ এর মধ্যে ভারতের পাম তেল উৎপাদন বাড়িয়ে ১১.২০ লক্ষ টন করতে চায় ও ২০২৯-৩০ এর মধ্যে তা আরও বাড়িয়ে ২৮ লক্ষ টন করতে চায়। এর কারণ হল ভারতের আমদানি হ্রাস করার পরিকল্পনা। তাহলে প্রশ্ন হল যে এই এনএমইও-ওপি প্রকল্পের ফলে কারা লাভবান হবেন? দেশের সাধারণ মানুষ? কৃষকেরা? নাকি ধন কুবের পুঁজিপতিরা?
পেট্রোলিয়াম আর সোনার পরেই সবচেয়ে বেশি মূল্যের ভারতের আমদানি কৃত পণ্য হল ভোজ্য তেল। ২০২০-২১ অর্থ বছরে, ভারত $৫৮০ কোটি মূল্যের কাঁচা এবং রিফাইন করা পাম তেল আমদানি করে। যদি ভারতে এই তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তাহলে মোদী সরকার আমদানির ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার খরচ অনেক কম করতে পারবে। “আত্মনির্ভর ভারত” নামক ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সমর্থন করার যে প্রকল্প মোদী সরকার নিয়েছে, তার অন্তর্গত এই এনএমইও-ওপি প্রকল্পও, এবং এর ফলে কিন্তু দেশের জনগণের চেয়ে বেশি দেশের পুঁজিপতিরা বেশি লাভবান হবেন, তাও আবার হাতে গোনা কিছু এমন পুঁজিপতি যাঁদের হাতে মোদী সরকারের সুতা ধরা থাকে।
মোদী ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন বড় প্রযোজক হলেন গৌতম আদানি। মোদী সরকারের আমলে তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য শুধুই ফুলে ফেঁপে ওঠেনি, তিনি আর একজন মোদী স্পন্সর, মুকেশ আম্বানির সাথে ভারতের ও এশিয়ার সবচেয়ে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন ও দ্বিতীয় স্থানে আছেন। এহেন আদানি বাবুর জীবনে ভোজ্য তেলের একটি বড় ভূমিকা আছে।
১৯৯৯ সালে আদানি সিঙ্গাপুরের উইলমার গোষ্ঠীর সাথে একজোট হয়ে ভোজ্য তেলের ব্যবসা শুরু করেন। আদানি উইলমার নামক এই সংস্থার ১৯৯৯ সালে আদানির মুন্দ্রা বন্দরে একটি মাত্র রিফাইনারি থাকলেও আজ তাদের গোটা দেশে ১৭টি রিফাইনারি আছে ও ভারতের পাম তেলের বাজারের সিংহ ভাগ তাদের দখলে।
এহেন আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তৈল পামের চাষের জন্যে তারা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার —বিশেষত সুমাত্রা, বর্নেও ও নিউ গিনি দ্বীপপুঞ্জে— লক্ষ লক্ষ হেক্টর ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল কে (রেনফরেস্ট) রুক্ষ ভূমিতে পরিণত করেছে। ওরাংওটাং, বাঘ ও হাতিদের প্রাকৃতিক আবাসন কে ধ্বংস করা হয়েছে, ঘাসের চাপড়া ভর্তি জলাভূমি কে শেষ করে দেওয়া হয়েছে ও লক্ষ লক্ষ আদিবাসী কে তাঁদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এই গোষ্ঠীর তৈল পাম উৎপাদনের জন্যে।
তৈল পামের চাষের জন্যে ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল কে শ্রেষ্ঠ মানা হয় তার কারণ এই যে সাধারণ খাদ্য শস্য চাষের তুলনায় তৈল পাম চাষের জন্যে তিনগুণ বেশি জল চাই। তাই যদি কোনো ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলের বাইরে এই তৈল পাম চাষ করা হয় তাহলে তার ফলে ভূগর্ভস্থ জল শেষ হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আবার কোনো ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে যদি তৈল পাম চাষ করা হয়, তাহলে তার ফলে সেই জঙ্গল শেষ হয়ে রুক্ষ ভূমিতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। কোনো দ্বীপে যদি এই তৈল পাম চাষ করা হয় তাহলে সামগ্রিক ভাবে তা সেখানকার জীববৈচিত্র্য কে ধ্বংস করবে। প্রকৃতির পক্ষে চরম ক্ষতিকারক এই তৈল পাম চাষ।
বর্তমানে ভারতের ২৫% বনাঞ্চল, বিশেষ করে ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল, উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্যে অবস্থিত। আর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তার জীববৈচিত্র্যের জন্যে বিখ্যাত। যদিও বর্তমানে এই সাতটি রাজ্যে ও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে তৈল পাম চাষ হয় নানা জায়গায়, তবে অতিরিক্ত ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে এই চাষ করা মানে হল উত্তর পূর্ব ভারতের প্রকৃতি কে ধ্বংস করা এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কে একটি মরুভূমিতে পরিণত করা। তা সত্ত্বেও কেন মোদী সরকার আর বিজেপি এই কর্মকাণ্ড করছে?
এই অতিরিক্ত চাষের প্রকল্প যেমন আদানি কে সাহায্য করবে ভারতে উৎপাদন বৃদ্ধি করার, তাও কম খরচে, তেমনি টেলিভিশনে যোগ ব্যায়াম শিখিয়ে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের ভিত্তিতে নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা, পতঞ্জলি গোষ্ঠীর মালিক রামদেব বাবাও এর ফলে উপকৃত হবেন। আগষ্ট মাসের শুরুতেই কিন্তু রামদেব ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর পতঞ্জলির দ্বারা অধিকৃত, পূর্বে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, রুচি সোয়া কোম্পানি অসম, ত্রিপুরা ও উত্তরপূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যে তৈল পাম চাষের কাজ শুরু করাবে মোদীর বিতর্কিত চুক্তি চাষের আইনের ভিত্তিতে। যদিও বিতর্কিত কৃষি আইনগুলো বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সাসপেন্ড করা আছে, তবুও চুক্তি চাষে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কোনো বাঁধা নেই।
ফলে মোদীর ঘাড়ে চেপে রামদেব আর আদানি অনায়াসে কোটি কোটি টাকা মুনাফা আয় করতে পারেন ভারতের ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলগুলোকে, জীববৈচিত্র্য কে, প্রকৃতি ও জলসম্পদ কে ধ্বংস করে। আর সেই পাম তেল উৎপাদনের খেসারত দেবেন কৃষকেরা, জেলেরা, গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা। এই তৈল পাম চাষের বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো বিরোধী শক্তিই রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছে না তার ফলে বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে হিংস্র কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে উত্তরপূর্ব ভারতের আর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সাধারণ মানুষকেই, সাধারণ কৃষকদেরই। কারণ তৈল পাম চাষ রোখার সংগ্রাম শুধুই পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না, জীবন রক্ষার ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে প্রকৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইও বটে।