গত কয়েক দিনে ভয়ানক অতিবৃষ্টিতে কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো জলে ডুবে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই যে বাঙালি মুম্বাই বা চেন্নাইয়ে বন্যা হলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় #IStandWithMumbai বা #StandWithChennai, সেই বাঙালিই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুর্দশা দেখে, নিজের বাড়ি ভেসে যেতে দেখে কিন্তু দুয়ারে বন্যা, দুয়ারে পুকুর, প্রভৃতি বলে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সমস্যাটি খাটো করছে। বর্তমানে চলমান নিম্নচাপ থেকে অতিবৃষ্টি আর তার ফলে শহর ডুবে যাওয়া কিন্তু কয়েকটা এমন সমস্যার দিকে আঙ্গুল তুলছে যা আজ যদি গুরুত্ব দিয়ে না দেখা হয়, যদি ব্যাঙ্গ করে খাটো করা হয়, তাহলে কিন্তু আগামীদিনে অনেক দেরিই হয়ে যাবে তাই নয়, হয়তো আগামী বলেই কিছু থাকবে না।
প্রথমত, বর্তমানে চলমান অতিবৃষ্টি কিন্তু দেখাচ্ছে কী ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির রোষানলে মানুষকে পড়তে হবে। এই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে হাজার খানেক সেমিনার প্রতি বছর হলেও এই সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কোনো ধারনা নেই কারণ বাজারী সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁদের এই ব্যাপারে সচেতন করেনি। এর ফলে এই অতিবৃষ্টি, এই শহর ডুবে যাওয়া, ইত্যাদির সাথে মানুষ মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখছেন। কিন্তু আগামী নয় থেকে দশ বছরের মধ্যে এই ঘটনাগুলো যে কোটি কোটি মানুষের জীবনহানির কারণ হবে তা নিয়ে এখন থেকে মানুষ কে সচেতন করা গেলে তবুও শেষ পর্যন্ত কিছু পরিবর্তনের আশা করা যায়।
দ্বিতীয়ত, এই অতিবৃষ্টির চেয়েও বেশি বৃষ্টি আগে পশ্চিমবঙ্গ দেখে থাকলেও এই ভাবে জলে ডুবে যাওয়া কলকাতা শহর কেউই কিন্তু দেখেনি। আজ কলকাতার মতন শহরগুলো জলে ডুবছে কারণ সেখানে নিকাশি ব্যবস্থা আজ ধ্বসে পড়েছে। কেন নিকাশি ব্যবস্থা আজ ধ্বসে পড়েছে? এর কারণ হল একদিকে রাজনৈতিক মদদ প্রাপ্ত লাগামহীন ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া প্রোমোটারি, জায়গায় জায়গায় জলা ভূমি বুজিয়ে দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাটবাড়ি, রিসোর্ট, প্রভৃতি। খাল থেকে নিকাশি নালা আজ প্রোমোটারির ফলে সৃষ্ট আবর্জনায় ভর্তি। গোদের উপর বিষফোড়া হল প্লাস্টিক, যা প্রতিটি অঞ্চলের নালাগুলো কে, বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ নর্দমাগুলোর প্রবাহ কে রোধ করছে, ফলে বৃষ্টির জল নামার কোনো উপায়ই নেই।
তৃতীয়ত, সামগ্রিক ভাবে শহরাঞ্চলের আজ পরিকল্পনার চরম অভাব কারণ বর্তমান পরিকল্পনাগুলোয় শুধু বাসস্থান তৈরি আর পরিবহনের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো হয়। কোনোদিনই এই পরিকল্পনার পরিসরে নিকাশি ব্যবস্থা কে উন্নত করার কথা ভাবা হয়না। কলকাতার মতন শহরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা করে গিয়েছিল আজ তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৪ বছর হয়ে গেলেও কোনো সরকারই সেই নিকাশি ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন করেনি। উন্নয়ন দূরঅস্ত, আজ অবধি কলকাতা পুরসভা ব্রিটিশ যুগের নিকাশি নালার মানচিত্র উদ্ধার করতে পারেনি।
আজ পশ্চিমবঙ্গের মতন একটি উপকূলবর্তী রাজ্যের শিরে সংক্রান্তি হতে চলেছে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন না কারণ সেই বিশ্বাস তাঁর নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কোপ মারবে। তাঁর কয়লা খনির বেসরকারিকরণ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার প্রকল্প, বাঁধ দিয়ে নদীর সর্বনাশ করা, সব নদীগুলো কে একে অপরের সাথে জুড়ে দেওয়ার প্রকল্প মার খাবে। মোদীর চেয়েও বেড়ে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন তাঁর ২০৩৫ এর মধ্যে আমেরিকার কার্বন নিঃসৃত করা অর্ধেক করার প্রকল্পের ভার দিয়েছেন এমন এক সেনেটর কে, জো মানচিন কে, যিনি নিজেই কোটি কোটি ডলার কয়লায় লগ্নি করে বসে আছেন। তাই এটা স্পষ্ট সরকার বা ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ করার উপর লাগাম টানবে না, বরং গরিব মানুষ কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে, ব্যাপক হারে উদ্বাস্তু বানিয়ে আর উদ্বাস্তুদের সস্তা শ্রমিকে পরিণত করে মুনাফার পাহাড় গড়বে।
এই পরিস্থিতিতে দায়টা কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কারণ অতিবৃষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাঁদের উপরেই নেমে আসবে সব চেয়ে বেশি আক্রমণ। আর্থ-সামাজিক ভাবে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে আজ এই শ্রমজীবী মানুষ কে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা কে নিয়ে সচেতন করে গণআন্দোলনে সামিল করা দরকার যাতে তার মাধ্যমে শাসকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা যায় নীতিগত পরিবর্তন এনে প্রকৃতি কে আর মানুষ কে ধ্বংস হওয়ার থেকে আটকাতে। কিন্তু সেই কাজ নিয়ে বর্তমানে কতগুলি প্রগতিশীল ও ফ্যাসিবিরোধী শক্তি চিন্তা করছে? এহেন পরিস্থিতিতেও যদি এই শক্তিগুলো আগুয়ান না হয় তাহলে কারা সাধারণ মানুষ কে প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে সেই প্রকৃতি কে রক্ষা করার ও ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন কে রোখার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন? যদি অবিলম্বে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে সংগ্রামের পথে না এনে ফ্যাসিবিরধি প্রগতিশীল শক্তিগুলি শুধুই সরকার কে ব্যাঙ্গ করে ইন্টারনেটে, তাহলে আখেরে কি কোন লাভ হবে? আর কার লাভ হবে?