আজ দিল্লীর সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকরা সারা ভারত বনধ ডেকেছেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন কে বাতিল করার দাবিতে, কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেওয়ার দাবিতে। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষক মারা এই আইনগুলো সংসদে, বিরোধীদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে, তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করিয়েছিলেন। আর ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২০ তে রাষ্ট্রপতির সিলমোহর পড়ে এই আইনগুলোয়, তাই এই দিনটি কে কৃষকেরা তাঁদের পাল্টা প্রতিরোধের দিবস হিসাবে গ্রহণ করেছে।
দিল্লীর সীমান্তে গত বছর ২৬শে নভেম্বর পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থান থেকে সংগ্রামী কৃষকেরা আগমন করেন বিজেপি-শাসিত হরিয়ানা পুলিশের তীব্র হিংস্র আক্রমণ কে প্রতিহত করে। দিল্লীর সীমান্তে তাঁদের মোদী সরকারের অধীনস্থ দিল্লী পুলিশ আটকে দেয় আর তাঁরা সেই সীমান্তেই আজ দশ মাস ধরে টানা অবস্থান করছেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বারবার তাঁদের সাথে বেইমানি করেছে মোদী সরকার। তাঁদের কোনো দাবি নিয়েই সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, কিন্তু তাঁদের ৬০০ জন সাথীর এই সংগ্রামে মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও কৃষকেরা পশ্চাৎ গমন করেননি।
মোদী সরকার আর বিজেপি ভেবেছিল কয়েক দিনে বা কয়েক সপ্তাহে আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। জানুয়ারি মাসে, যখন দিল্লীর বুকে কৃষকদের ট্র্যাক্টর প্যারেডের উপর হামলা চালিয়েছিল দিল্লী পুলিশ, নির্মম ভাবে দমন করার চেষ্টা করেছিল কৃষকদের, তখনও বিজেপি ভেবেছিল যে খেলা শেষ। কিন্তু সেই আশাও গুড়ে বালি হল। পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাঠ কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত, যিনি এক কালে বিজেপির হয়ে মুজাফফর নগর মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, খেলা ঘুরিয়ে দেন। নতুন করে গড়ে তোলেন আন্দোলন কে আর দেখতে দেখতে, মে মাসের মধ্যে, কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে যায় দেশের ১০টি রাজ্যে। কৃষকদের সংখ্যা কমার জায়গায় বেড়ে চলেছে। তাঁরা হরিয়ানা আর উত্তর প্রদেশে বড় বড় কৃষক মহাপঞ্চায়েত করছেন যার ফলে মোদী সরকার আর বিজেপি চরম আতংকিত হয়ে উঠছে।
আজ যখন কৃষকেরা জমি ছাড়তে নারাজ, তখন মোদী সরকার আদালত কে ব্যবহার করে কৃষক আন্দোলন কে দমন করতে চাইছে। দিল্লীর সীমান্তের থেকে ঠেলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাতে চাইছে, ঠিক তখনই এই ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ পালিত হচ্ছে। এই বনধ সাড়া ফেলেছে গোটা ভারতেই। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশ, তামিল নাড়ু, কেরল, পাঞ্জাব, রাজস্থান, প্রভৃতিতে বনধের সার্বিক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস জগন মোহন রেড্ডির সরকার ঘোষণা করেছে যে সোমবার, ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে সমর্থন করা হবে। অন্ধ্র প্রদেশের রাজ্য সরকারের বাস রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হবে। অফিস ও আদালতও বন্ধ থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে অন্ধ্র প্রদেশ সরকার বিশাখাপটনম স্টিল কারখানার শ্রমিকদের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকেও সমর্থন জানিয়েছে।
দক্ষিণের সর্ববৃহৎ রাজ্য তামিল নাড়ুর শাসকদল দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাঘাম (ডিএমকে) ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে সমর্থন জানিয়েছে। ডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের নির্দেশ অনুসারে তার পুরো সংগঠন কে বনধ কে সফল করতে পথে নামাবে বলে ঘোষণা করেছে। এর সাথে সাথে তামিল নাড়ুর আন্দোলনরত কৃষকেরা, ট্রেড ইউনিয়ন গুলো ও নাগরিক সমাজের সভ্যরা ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে সফল করতে পথে নামবেন।
কেরল রাজ্যের শাসক বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ) সরকার ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। এলডিএফের বৃহৎ শরিক ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] এই বনধের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত কারণ এই দলের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষক সভা কৃষক আন্দোলনের চালিকা সংগঠন সংযুক্ত কৃষক মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ শরিক। তাই সিপিআই (এম) তার সর্বশক্তি দিয়ে এই বনধ কে সফল করার চেষ্টা করবে। ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র ও যুব সংগঠন সহ নানা গণ সংগঠনের সাহায্যে এই বনধ কে কেরলের বুকে সার্বিক ভাবে সফল করা বলে মনে করা হচ্ছে।
পাঞ্জাব ২০২০ সালের জুন-জুলাই মাস নাগাদ কৃষক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ও বর্তমানে দিল্লীর সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের অধিকাংশ হলেন পাঞ্জাবের কৃষক। তাই শাসক কংগ্রেস দল, যে দলের নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌলতেই বিজেপি এই কৃষক মারা নীতি প্রচলন করার সাহস পেয়েছে, কৃষক আন্দোলন কে সমর্থন করেছে আর ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কেও সমর্থন করেছে। পাঞ্জাবে কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্বের শেষে ক্যাপ্টেন অমৃন্দর সিংহ কে সরিয়ে প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বিজেপি থেকে কংগ্রেসে যোগদান করা নভজ্যোত সিংহ সিধুর শিবিরের চরণজিত সিংহ চান্নির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় আশা করা যাচ্ছে যে নিজেদের হাত আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে জোরদার করতে কংগ্রেস কৃষক আন্দোলন কে পূর্ণ সমর্থন দেবে।
যদিও রাজস্থানেও পাঞ্জাবের সাথে সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ২০২০ সালে, বিজেপির তীব্র প্রভাব থাকার কারণে ও সরকারের সমর্থন দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে, ওই রাজ্যে কৃষক আন্দোলন আর আগের মতন তীব্র নেই। যেহেতু রাজস্থানে ২০২৩ এর শেষের দিকে বিধানসভা নির্বাচন, তাই মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে নমঃ নমঃ করে সমর্থন করবেন। তবুও গোটা রাজস্থানে বাস, ট্রাক চলাচল বন্ধ, আর অফিস আদালতেও লোক নেই।
ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকারও সেই সমর্থনের নাটকটুকুই করছে। তবুও ব্যাপক ধর্মঘট হয়েছে ছত্তিশগড়ে। মহারাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)-শিব সেনা- কংগ্রেস পার্টির জোট সরকারও ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ নিয়ে কোনো বিশেষ উচ্চ বাচ্য করেনি। বোঝা যাচ্ছে যে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বনধ আর কৃষক আন্দোলন নিয়ে বড় বড় কথা বললেও, আদতে তাঁদের নীতি আর বিজেপির নীতির মধ্যে কোনো ফারাক নেই। মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইতে বনধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলেও অন্যান্য অংশে ভাল প্রভাব পড়েছে।
নানা ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে গরম গরম বুলি ঝাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ নিয়ে একদম চুপ। বন্দোপাধ্যায় তাঁর ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রচারের সময়েও একবারও বনধের প্রতি কোনো সমর্থনের বার্তা দেননি। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করেছে “জোর করে বনধ করা” ব্যর্থ করতে। বিজেপিকে বিধানসভা ভোটে হারাতে এক কালে কৃষক নেতা টিকায়েতের সাহায্য চান বন্দোপাধ্যায়। যাঁর নিজের রাজ্যে কৃষকেরা এমএসপি পাননা, তিনি কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরোধিতা করলে কি সেটা দ্বিচারিতা বলে মনে হয় না? এই ভাবে কৃষক আন্দোলনের সাথে বন্দোপাধ্যায় বেইমানি করে কার সুবিধা করে দিচ্ছেন?
বিজেপি শাসিত হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও বিহারেও এই কৃষকদের ডাকা ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ পালন হবে। বিহার বিধানসভার বিরোধী নেতা তেজস্বী যাদব চিঠি লিখে সব বিরোধী নেতাদের কৃষক আন্দোলন কে সমর্থন করতে আহ্বান করেছেন, ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ কে সফল করারও আবেদন জানিয়েছেন। হরিয়ানায় কিছুদিন আগেই পুলিশের সাথে কৃষকদের খণ্ডযুদ্ধ লাগে যাতে এক কৃষক প্রাণ হারান। গোটা হরিয়ানার কৃষকেরা মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টারের উপর আর শাসকদল বিজেপির উপর ক্ষুব্ধ। তাই হরিয়ানায় বনধ করার জন্যে যেমন কৃষকেরা মুখিয়ে থাকবে তেমনি তাঁদের দমন করতে পুলিশ ও প্রশাসন হিংস্র হয়ে থাকবে। উত্তর প্রদেশে আগামী নির্বাচনের আগে বড় বড় কথা বলে, আখের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার দাবি করে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ চেষ্টা করছে মোদীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাঠ কৃষকেদের ঠান্ডা করার। তবে যেহেতু কৃষকেরা নিজেদের দাবিতে অনড় তাই যোগীর কপালে দুঃখ আছে।
দেখতে গেলে সাম্প্রতিক অতীতের ধর্মঘট গুলির চেয়ে কৃষকদের ডাকা ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বনধ আরও বড় আকারে হবে। ব্যাঙ্কের ইউনিয়ন এই ধর্মঘট কে সমর্থন করেছে ফলে আর্থিক কর্মকাণ্ড এই দিন বন্ধ থাকবে। তবে যেহেতু ব্যাপক পরিমাণের শ্রমিকদের, বিশেষ করে অসংগঠিত শ্রমিকদের, নিজের দিকে এই কৃষক আন্দোলন টেনে নিতে পারেনি তাই সারা ভারত জুড়ে সার্বিক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। তবে যদি এই সারা ভারত বনধ কে ঘিরে নতুন শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর সম্ভাবনা দেখা দেয় ও সংহতি মূলক সংগ্রাম গড়ে ওঠে তাহলে তার ফলে আগামী দিনে বিজেপি ও মোদীর কর্পোরেটদের হাতে ভারত কে উপঢৌকন দেওয়ার প্রকল্প জোর ধাক্কা খেতে পারে।