বিশ্বের বৃহত্তম এই ভারতীয় ‘গণতন্ত্র’ আসলে ‘ভোটতন্ত্রে’র বৃহত্তম উৎসবের ‘কুরুক্ষেত্র’। ‘ভোটতন্ত্রে’র এই উৎসবে গলি থেকে রাজপথ, কুঁড়েঘর থেকে বহুতল – পতপত করে উড়তে থাকে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আর রামধনু রঙে রাঙা নানান পতাকা। এদিকে ওদিকে একবর্ণ, দ্বি-বর্ণ, ত্রিবর্ণ, চতুর্বর্ণ এমন কি বহুবর্ণে সজ্জিত রঙিন নাট্যমঞ্চে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র সফল মঞ্চায়ন ঘটে। কিন্তু, বিশ্বের বৃহত্তম ‘গনতন্ত্রে’র এই উৎসবে যে প্রশ্নগুলি ওঠা অনিবার্য ছিল, তা ‘ভোটবাদ্যে’র ঢক্কানিনাদ আর ‘দেশপ্রেমে’র উলঙ্গ নাচনের নীচে চাপা পড়ে যায়। শাসক দলের কাছে না হয় আশা করা যায় না, কিন্তু, বিরোধীদের কাছে? কোনও প্রধান বিরোধী দলের কাছ থেকে প্রশ্নগুলি আসেনা, বা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য বা ইস্তেহারেও জায়গা পায়না।
গত বছরের শুরুতেই সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের পাঁচদিনের বার্ষিক সভার শুরুতেই আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম এক রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছিল গত ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারতীয় ধনকুবেরদের সম্পদ দিনে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা করে বেড়েছে। আর সবচেয়ে বিত্তশালী এক শতাংশ আরও ৩৯% হারে বড়লোক হয়েছেন। অন্যদিকে, একেবারে নীচের সারিতে থাকা মানুষদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩%। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল দেশের শীর্ষ ১% ধনকুবেরের হাতেই রয়েছে মোট জাতীয় সম্পদের অর্ধেকেরও বেশি সম্পদ, ৫১.৫৩%। আর সেরা ১০% বিত্তশালীর হাতে রয়েছে মোট জাতীয় সম্পদের ৭৭.৪% সম্পদ।
কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিতভাবে চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, পয়ঃপ্রণালী ও জল সরবরাহ খাতে ব্যয় করে ২.৮ কোটি টাকা। বলাবাহুল্য, ভারতের মাত্র একজনের কাছেই ওই টাকা রয়েছে। সোজাকথায় ওই এক বছরে ভারতের আয়বৈষম্যের চিত্র কতটা ভয়াবহ হয়েছিল তা দেখিয়ে দিয়েছিল এই আন্তর্জাতিক সংস্থা। আকর্ষণীয় তথ্য হল, এই ১% ধনকুবের যদি মাত্র ০.৫% অতিরিক্ত কর দিতেন, তবে সরকার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যখাতে আরও ৫০% ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে পারতেন। সরকার একদিকে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো জনস্বার্থের মতো বিষয়ে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়েছে। অন্যদিকে ধনীদের করছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। অথচ ঋণফাঁদে ডুবে থাকা মানুষদের জন্য সরকার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
গত ১০ বছর ধরেই দেশের সবচেয়ে গরিব ১০% অর্থাৎ ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ ঋণের ফাঁদে রয়েছেন। গরিব পরিবারের এক বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের মৃত্যুহার ধনীদের তুলনায় তিনগুণ। ভারতের কয়েকজন ধনী ব্যক্তি তাঁদের সম্পদের পরিমাণ ক্রমশই বাড়াচ্ছেন। আর গরিবরা তাঁদের অন্ন সংস্থান বা সন্তানদের চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে ‘পরিযায়ী পাখী’ হয়ে মাথা খুঁড়ে মরছেন। এভাবে যদি এই ১% ধনী ও বাকি ভারতীয়দের আয়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য চলতেই থাকে, তবে দেশের সামাজিক ও গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোটাই ভেঙেচুরে যাবে। অথচ এই তথ্য বা বিষয়টি নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল বা বিরোধীদলের রাজনৈতিক ইস্তেহার বা প্রচারে ঝড় ওঠেনি। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওই একটি মাত্র ঝড়ই যথেষ্ট ছিল।
অনেকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে এনে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে কথা বলতে চান। কিন্তু, অর্থনীতির সুত্রানুসারে জি ডি পি যে – হারে বাড়ে কর্মসংস্থানও সেই হারে বাড়া উচিত। কিন্তু, কেয়ার রেটিংস’ সংস্থার হিসেব অনুযায়ী গত আর্থিক বছরে মোট কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৩.৫%। তথ্যপ্রযুক্তি, খুচরো বিপণন, নির্মাণ এবং আর্থিক বাজার – এই চারটি পরিষেবা ক্ষেত্রেই কর্মী নিয়োগ করা হয়ে থাকে সর্বাধিক। কিন্তু, গত কয়েক বছরে এগুলিতে কর্মসংস্থান অনেকটাই কমে গেছে। ফলে দেশে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তাতে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হয়নি। যেমন একই সংসারে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এক ভাইয়ের আয় অন্য চার ভাইয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলেও যদি অন্য ভাইদের কর্মসংস্থান না হয়, তাহলে সেই সংসারের গড় আয় বৃদ্ধি পেলেও অন্য ভাইদের সেই উৎপাদন বৃদ্ধিতে কোনও লাভ থাকেনা। তেমনি ভারতের এই ‘জবলেস গ্রোথ’ এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জনসাধারণের সাথে এই উৎপাদন বৃদ্ধির কোনও সম্পর্ক তৈরী হয়নি।
এবং আলোচনা অনিবার্যভাবে আরেকটি দিক উঠে আসে – শুধু ধর্মের নিরপেক্ষতা নয়, ‘দেশপ্রেম’ আর প্রবল ‘উগ্র জাতীয়তাবাদে’র চাপে আমাদের অহংকার ‘ভারতীয় বহুত্ববাদ’ আজ অস্তিত্বহীন। আমদের দেশের ঐতিহ্যের নিরপেক্ষতার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষার নিরপেক্ষতা, সংস্কৃতির নিরপেক্ষতা, রুচি ও রীতিনীতির নিরপেক্ষতা। কিন্তু নিরপেক্ষতার এই জায়গাগুলিকে ধ্বংস করার জন্য একটি শ্রেণী আজ উঠে পড়ে লেগেছে। একটা সংগঠিত চেষ্টা চলেছে লোককে বোঝানোর যে, ‘ভারতবর্ষ দেশটা একটা বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর, অন্যরা সেখানে থাকতে পারে না। থাকতে হলে শুধুমাত্র তাদের অনুমোদন আর নিয়ম মেনে থাকতে হবে’।
স্বাধীনতার পর আমরা হাজারও বাধা ও বিপত্তির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করেছিলাম। দুশো বছরের উপনিবেশিকাতা আর দেশভাগ জনিত উদ্বাস্তু সমস্যা, অপরিসীম দারিদ্র, চারিদিকে হিংসার থাবা – এক কঠিন সমস্যার আর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যে গৃহীত হয়েছিল একটা অসাধারণ সংবিধানও। দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ধরে রাখার জন্য সেই সংবিধান অনেকগুলি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল। আজ সেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলিকে সযত্নে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। অথচ কোনও দলকে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যাচ্ছেনা। বরং, ধর্ম নিরপেক্ষতা আর গণতান্ত্রিক প্রশ্নে ক্ষমতা দখলের চক্রব্যুহ্যে তারা কখনও নরম এবং প্রয়োজনে কোথাও বা গরম নীতি অবলম্বন করেছেন এবং করছেন।
তথ্য অনুসারে স্বাধীনতার পর দেশের গত সাধারণ নির্বাচন ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল যা সম্প্রতি আমেরিকার নির্বাচনের খরচকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মনে রাখা দরকার নির্বাচন পরিচালনা ছাড়া সরকার রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি পয়সাও দেয়না। তাহলে রাজনৈতিক দলের বিপুল পরিমাণ নির্বাচনী অর্থ কে যোগায় এবং কেন যোগায় প্রশ্নটি ওঠা জরুরি, কিন্তু প্রশ্নটি ওঠেনা। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, ২০১৯ এর নির্বাচনে মোট ১৯৪ কোটি টাকার নির্বাচনী দান ১৬ টি সংস্থা বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী তহবিলে দান করেছিল – যা দলগুলির নির্বাচনী খরচের প্রায় ৩২%। অথচ কোন সংস্থা কোন দলকে কত টাকা দিয়েছিল, কীভাবে দিয়েছিল এবং কীসের শর্তে দিয়েছিল তা জানাতে তাঁরা বাধ্য নন। নির্বাচন কমিশনের সে ধরনের কোনও আইন বা ক্ষমতাও নেই।
বেআইনি বা অনৈতিক পথে টাকা বা ক্ষমতা না এলে ভারতে নির্বাচনে জেতা কঠিন। নোটবন্দির পর স্মরণীয় উক্তি এখনও কানে ভাসে – ‘গরিবেরা ঘুমোবে এবার, শুধু জেগে থাকবে ধনীরা’। কিন্তু অক্সফামের রিপোর্টে আর আজকে হাঁটতে হাঁটতে পথে হাজারও শ্রমিকের মৃত্যু দেখিয়ে দিয়ে দিল কারা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, আর দুমুঠো খাবার ও ঋণ পরিশোধের জন্য কারা রাস্তায় রাস্তায় ‘চক্কর’ খেয়ে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার সাধারণ মানুষ তখনই সুখে – শান্তিতে থাকতে পারবে, যখন অর্থনীতির সুফল একেবারে নিচুতলা পর্যন্ত পৌছবে। আরও মনে রাখা দরকার প্রবল পরাক্রমী জনবিরোধী শাসককে ছুঁড়ে ফেলতে কোনও কালে কোনও শাস্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। যে মুহূর্তে দুর্বিনীত শাসকের ছায়া তাঁর অবয়বের চেয়ে প্রলম্বিত হতে শুরু করে, তখনই বুঝে নিতে হয় ‘সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই’।