সামাজিক মাধ্যমে “নো এনআরসি মুভমেন্ট” সংগঠনের কমল শূরের একটি লেখা নজরে পড়ল। লেখাটিতে তিনি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯) নিয়ে তাঁর মতামত ও কয়েকটি প্রশ্ন ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের উদ্দেশ্যে রেখেছেন।
শান্তনু মতুয়া সহ দেশভাগের বলি সমস্ত উদ্বাস্তুদের কাছে সিএএ ২০১৯ নিয়ে একটা চরম বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রেখে আসছেন। মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। আইনে যা নেই, সেই দাবি করছেন। আজকের প্রয়োজন: শান্তনু-র সুবিধাবাদী খপ্পর থেকে উদ্বাস্তুদের বের করে আনতে গেলে সিএএ ২০১৯ সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইনি ব্যাখ্যা রাখা। কমলবাবু শান্তনু-র বিরোধিতা করতে গিয়ে উদ্বাস্তুদের আবার বিভ্রান্তির মধ্যে ফেললেন এবং আইনে যা নেই তাই বলে ফেললেন। অমিত শাহের “ক্রোনোলজির” কথা লিখলেন।
তিনি তাঁর বক্তব্যে চিরাচরিত সেই পুরানো দাবি একটু ভিন্ন মোড়কে রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, “নাগরিকত্ব আইন দেশের সবার জন্য। কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী বা ভাষা গোষ্ঠী বা জাতি গোষ্ঠীর জন্য নয়।” অত্যন্ত সঠিক কথা। কিন্তু এই বক্তব্য উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধান করতে পারে না। মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবি আসলে উদ্বাস্তুদেরই নাগরিকত্বের দাবি। এইভাবে বিষয়টা দেখা সঠিক।
তিনি বলতে চাইছেন, উদ্বাস্তু বা মতুয়াদের নাগরিকত্ব আছে। তা যদি হয়, তাহলে তো উদ্বাস্তুদের কোন সমস্যাই নেই। তাহলে উদ্বাস্তু/মতুয়ারা নাগরিকত্বের দাবি করছেন কেন? তাঁরা কি এতটাই নির্বোধ যে নাগরিকত্ব থাকতে আবার নাগরিকত্বের দাবি করবেন? কিংবা কেন খামোখা নাগরিকত্বের দাবি করে বিদেশি বলে চিহ্নিত হবেন ?
কমলবাবু মতুয়া বা অন্য উদ্বাস্তুদের কাছে গিয়ে কি কখনো জানতে চেয়েছেন কী সমস্যা তাঁদের? দৈনন্দিন জীবনে প্রশাসনের নিপীড়নের শিকার তাঁদের কেন হতে হচ্ছে ? ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও কেন গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁদের? কেন জেল খাটতে হয় ? একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া কিংবা জেল খাটার ঘটনা তো এই ভূখন্ডে বসবাস করে আসা মানুষদের হতে হয় না। সকলের যদি নাগরিকত্বই থাকে তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে কেন? সরকার কেন বলছে না তাঁদের নাগরিকত্ব আছে? একই নাগরিককে দু’বার নাগরিকত্ব দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে নাকি এদেশে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও? ১৯৮৬ সালে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর অভিমুখ কাদের দিকে ? ২০০৩ সালে “অবৈধ অভিবাসী” কাদের ঘোষণা করা হয়েছিল? কাদের আবেদন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩) এ? দেশবিভাগের পর অধুনা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে পাসপোর্ট লাগে কেন? পাসপোর্ট না থাকলে আসা অবৈধ কেন?
কিছু তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। ভারতের সংবিধানের ৬-এর (বি)(১) উপধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, তৎকালীন পাকিস্তান-অন্তর্ভুক্ত থেকে ১৯ জুলাই, ১৯৪৮-এর আগে আসলে তাঁরা ভারতের নাগরিক। ৬-এর(বি)(২)উপধারায় বলা হয়েছে ১৯ জুলাই, ১৯৪৮-এর পরে কিন্তু সংবিধান প্রারম্ভের মধ্যে আসলে নাগরিকত্বের আবেদন জানিয়ে নথিভুক্ত হতে হবে। এর পরে যাঁরা পাকিস্তান থেকে আসবেন তাঁদের কথা কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কিছুই বলা নেই।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়েছে। সংবিধানে বাংলাদেশের কথা তো উল্লেখই নেই। তাহলে কী ধরে নিতে হবে? ১৯৪৮ থেকে সংবিধান প্রারম্ভের মধ্যে এলে যদি নাগরিকত্বের আবেদন করতে হয় ,তাহলে বুঝতে হবে পরবর্তীকালে আসা উদ্বাস্তুদের পাসপোর্ট ও ফরেনার্স অ্যাক্টের নিয়ম মেনে আসতে হবে এবং নাগরিকত্ব আইনের যে যে ধারায় (by registration/by naturalization) নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়, সেই প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু কিন্তু তা করেননি। তাই এই রাষ্ট্র অনেক কিছু সুযোগ দিলেও নাগরিক হিসাবে সংবিধান/নাগরিকত্ব আইনে স্বীকৃতি দেয়নি। এটা ভাবাবেগের বিষয় নয়। আইনি বাস্তবতার বিষয়। সেই জন্যই নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি উঠেছে।
উদ্বাস্তুদের যে নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্র স্বীকার করে না এবং বাঙালি উদ্বাস্তুরা যে সিএএ ২০০৩-এর লক্ষ্য ছিল তার দুটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ–– ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গুজরাট, রাজস্থানে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যাতে সিএএ ২০০৩ প্রযোজ্য না হয় সে জন্য ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ একটি নোটিস জারি করা হয়। ঐ একই সময়ে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে অথচ তা কিন্তু প্রযোজ্য হয়নি।
জানা যায় এরপরেও আটটি রাজ্যে বাস করা কেবল অবাঙালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করার গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হয়। ভাববার বিষয় নয় কি? কী বলেন উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব আছে জোর দিয়ে বলেন যাঁরা?
বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গে জহরলাল নেহরুর মনোভাব এ ক্ষেত্র সবিশেষ উল্লেখ্য। তিনি বলেছিলেন, “এদের চলে আসা উচিত হচ্ছে না,…এদের ওদেশেই থাকতে হবে।” পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে তিনি লেখেন,“যদি যুদ্ধ করতে হয় তাহলেও শেষ অবধি এই উদ্বাসন বন্ধ করার চেষ্টা করবো।”দেশভাগ করলেন মাড়োয়ারি-গুজরাটি বেনিয়া আর ব্রাহ্মণ্যত্ববাদী লবির প্রবল চাপে ও স্বার্থে। অথচ উদ্বাস্তুদের দায় নেবেন না। শ্রেণী আর বর্ণ ঘৃণা একাকার হয়ে গিয়ে কপাল পোড়াল বেশির ভাগ তথাকথিত অমুসলিম নিম্নবর্ণের মানুষদের।
সিএএ ২০১৯ সম্পর্কে শান্তনুর মতন কমলবাবুও ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কেন বারবার বোঝানো সত্ত্বেও দিচ্ছেন তা অনেকের বোধগম্য হচ্ছে না ? এই আইনটা স্রেফ ৩১,৩১৩ জনকে “অবৈধ অভিবাসী”-র তকমা মুক্ত করার আইন। এটা তাঁদের আইন যাঁরা পাসপোর্ট ও ফরেনার্স অ্যাক্টে ছাড় পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। এঁরাই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। ভবিষ্যতে ছাড় পাবেন কেউ এমন কিন্তু মোটেই নয়। এই ৩১,৩১৩ মানুষের বাইরে একটি লোকেরও সুযোগ হবে না এই আইনে। এর জন্য কিন্তু যে কেউই নাগরিকত্ব (সংশোধনী)বিল, ২০১৬ (সিএবি ২০১৬) নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) রিপোর্টটি পড়ে দেখতে পারেন। কমলবাবুর সংগঠন কিন্তু পক্ষান্তরে এই কথা স্বীকার করেছিল তাঁদের ১১ই ডিসেম্বর ২০২০ এর মিছিলের আহ্বানের লিফলেটে। তবুও কেন তিনি বিষয়টা গুলিয়ে দিচ্ছেন বোঝা দুস্কর।
ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) এর সঙ্গে সিএএ ২০১৯ এর যে কোন সম্পর্ক নেই সেই কথা কিন্তু বর্তমান লেখক ও অন্য অনেকে বারবার বলেছেন। এনআরসি -তে বাদ যাওয়া কেউই (তিনি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্শি যেই হোন না কেন) আবেদন করতে পারবেন না। আবেদন করতে পারবেন এই মিথ্যা আশ্বাস কেন দেওয়া হচ্ছে? এর দ্বারা শাহের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার স্বার্থে তৈরি মিথ্যা “ক্রোনোলজি” প্রচার করা হয়ে যাচ্ছে না কি ? কমলবাবু নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে বিজেপি দলের মত প্রচারের কাজ করবেন না
তা ছাড়া কমলবাবু আরও বলেছেন, “বিদেশি চিহ্নিত করার পর যদি হিন্দু হন আপনার জন্য এক রকম নিধান, যদি মুসলিম হন আরেক রকম নিধান।” যেখানে সিএএ ২০১৯-এ ৩১,৩১৩ জনের বাইরে কারুর আবেদন করার কোন সুযোগই নেই, সেখানে আলাদা আলাদা নিধানের কথা আসে কোথা থেকে? এইটা কি বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি কে সমর্থন করছে না যে হিন্দুরা পাবে কিন্তু মুসলিমরা পাবে না? এর ফলে কি উদ্বাস্তুরা আরও বেশি করে বিজেপির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে যাবেন না?
প্রথমে দেশে বসবাস করা প্রতিটি মানুষের তথ্য কে একত্রিত করার প্রক্রিয়া—জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর)—শেষ করে এনআরসি করে তারপরে সিএএ ২০১৯ দিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে কমলবাবু অমিত শাহের কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই জানা যাচ্ছে আধার-এর তথ্য নিয়ে কোটি কোটি লোকের এনপিআর করা হয়ে গেছে। আর ইতিমধ্যে ১২৫ কোটি মানুষের আধার হয়ে গেছে। আধারের সঙ্গে সব কিছুর লিঙ্ক করিয়ে নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে ভোটার লিস্ট যোগ করলে প্রত্যেকটি নাগরিকের উৎস সূত্র জানতে কী আর বাকি থাকে?
সিএএ ২০১৯-এ নাগরিকত্বের আবেদন করে বিদেশি চিহ্নিত হতে হবে না। নানা উপায়ে চিহ্নিত হয়ে আছেন বলেই না প্রশাসনিক নিপীড়ন চলে। আর সেই জন্যই তো উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব নিশ্চিতকরণের দাবি জানাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে। তাহলে “এনপিআর বাতিল করো” স্লোগানের আগে “আধার বাতিল করো” স্লোগান এখনই তোলার কি জরুরী নয়? তাহলে এই বিষয়ে কমলবাবুর সংগঠন আশ্চর্যরকম ভাবে কেন চুপ থাকে?
নির্দিষ্ট রঙের চিপযুক্ত এনআরসি কার্ড দেওয়ার আগেই হিটলারের পাঞ্চকার্ডের আধুনিক সংস্করণ আধার কার্ড তো তৈরি হয়েই গেছে। কিছুদিন আগেই অসমে ৩৮ লক্ষ লোকের আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক লক করে দেওয়া হয়। তার ফলে তাঁদের চরম হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। সুতরাং নজরদারির ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পাকা হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা উচিত কি না? কী মনে করেন কমলবাবু? আরও কয়েকটি কথা, কমলবাবুদের উপরে উল্লেখিত প্রচারপত্রে উদ্বাস্তুদের উপর হয়রানির কথা স্বীকার করে বলা হয়েছে––“নাগরিকত্বের নামে কোন পুলিশি হয়রানি বা সামাজিক নির্যাতন চলবে না।” প্রশ্ন হল পুলিশ হয়রানি করছে কেন? নিজের দেশের নাগরিকের উপর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশাসন হয়রানি করে নাকি? কমলবাবু, আপনার উপর পুলিশ কেন হয়রানি করে না নাগরিকত্ব নিয়ে? আপনার এমন কী আছে যা তাঁদের নেই যাঁদের হয়রানি পোহাতে হয়?
প্রায়শই অনেকেই একটা যুক্তি দিয়ে থাকেন যে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড থাকলেই নাগরিক। তাহলে এগুলো থাকা সত্ত্বেও হয়রানি চলে কেন? অসমে ১,৯০৬,৬৫৭ (উনিশ লক্ষ ছয় হাজার ছয়শো সাতান্ন) মানুষের ১৯৭১ সালের আগের কাগজপত্র ও উক্ত সব কার্ড থাকা সত্ত্বেও এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হল কেন? কেন তাঁরা বলতে পারলেন না যে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার থাকলেই একজন নাগরিক?
কমলবাবুদের প্রচারপত্রের আরও কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
“ওরা মিথ্যা প্রচার করে চলেছে যে এই আইনের ফলে মতুয়ারা, উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবে। কিন্তু ওরকম কোন সুযোগ ওই আইনে নেই। এই আইনের সুবিধা পাবে সারা দেশের মধ্যে শুধু ৩১,৩১৩ জন; যারা বিদেশ থেকে এসেই লংটার্ম ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন।” কী ব্যাপার বলুন তো কমলবাবু ? এমন উক্তি তো আপনাদের হওয়ার কথা নয়। আপনারা তো বলেন সবাই নাগরিক। এখানে তো উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব নেই–– প্রকারান্তরে সেটাই স্বীকার করে নিলেন। আবার এখানে যা বলেছিলেন পরে তার উল্টো বললেন। হিন্দু হলে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে এই বিভ্রান্তিগুলো দূর করুন। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবি স্বীকার করলে সামগ্রিক ভাবে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের অসুবিধা কোথায়? নাগরিকত্ব রক্ষার আন্দোলন ও নাগরিকত্ব অর্জনের আন্দোলনের মধ্যে সত্যি কোন চীনের প্রাচীর নেই, চীনের প্রাচীর তৈরি করা হচ্ছে। ভাঙুন না সে প্রাচীর।