বৃহস্পতিবার, ৩০শে সেপ্টেম্বর ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন ঘিরে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে রাজ্যে আর তার কারণ গত বিধানসভা নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারী কেন্দ্রীয় বাহিনী আর টাকা ব্যবহার করে দেখিয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো কেন্দ্রেই মমতা বন্দোপাধ্যায় কে হারানো যায়। এই প্রথম বন্দোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ভোটে জিতে গেলেও তিনি হেরে গেলেন আর হেরে গিয়েই তাঁকে অনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হতে হল। ভাগ্যের পরিহাস যে সেই ভবানীপুরে তাঁকে ফিরতে হল যেখানে তিনি লড়তে চাননি। এই বার কিন্তু রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও চাপে আছেন বন্দোপাধ্যায় কারণ যদি তিনি হেরে যান তাহলে কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে অসম্মানজনক ঘটনাটি ঘটবে।
তাই ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন নিয়ে দৃশ্যত চাপে আছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। নিজের প্রায় পাড়ার ভোটেও তাঁর এক বিন্দুও স্বস্তি নেই, যদিও কলকাতা কোনোদিনই তাঁকে—২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছাড়া—নিরাশ করেনি। যদি বন্দোপাধ্যায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যান তাহলেই দম্ভের কারণে তিনি অবাঙালি হিন্দু, বিশেষ করে গুজরাটি অভিবাসীতে ভর্তি ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে যাবেন। আর হেরে গেলেও যদিও তিনি আরও ছয় মাস করে মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন মাঝে কোনো বিশ্বস্ত বিধায়ক কে মুখ্যমন্ত্রী করে, সেটা তাঁর মতন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে, যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভিলাষা দ্বারা চালিত, বিরাট বড় ধাক্কা হবে।
কেন বন্দোপাধ্যায় ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত চাপে আছেন? কেন তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না যে– যে ভবানীপুর তাঁর দলের শোভন দেব চট্টোপাধ্যায় কে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) তারকা প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষের চেয়ে বেশি ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল, তাঁকেও অনেক বেশি ভোট দেবে? কেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে বিজেপির উকিল প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়াল, যিনি একজন অবাঙালি, তাঁকে হারাতে পারবেন না? কেন উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন বন্দোপাধ্যায়?
বন্দোপাধ্যায় বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর ইতিহাস, নন্দীগ্রামের সংগ্রামে তাঁর দলের ভূমিকা ও তাঁর নিজের ভূমিকার কথা মনে করে মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন। কিন্তু নির্বাচনের দিনে আর ফলাফলের দিনে বন্দোপাধ্যায় বুঝলেন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আর মেরুকরণের কী তীব্র প্রভাব ভোট বাক্সে পড়ে। বর্তমানে ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে কারণ হল ভোটের পাটিগণিত। সাধারণ পাটিগণিত যা চূড়ান্ত সর্বনাশ করতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসের আর বন্দোপাধ্যায়ের।
গত বিধানসভা নির্বাচনে, ভবানীপুর কেন্দ্রের ২০৬,৩৮৯ মোট ভোটারের ৬১.৭৯%, অর্থাৎ ১২৬,৫৯২ ভোটার ও ৯৪৪ জন পোস্টাল ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। তার মধ্যে বৈধ ভোট ছিল ১২৫,৮০৬টি। এইবার এই ভোটের মধ্যে চট্টোপাধ্যায়ের ঝুলিতে পড়ে ৭৩,৫০৫টি, অন্যদিকে ঘোষ পান ৪৪,৭৮৬টি ভোট। মোট ২৮,৭১৯টি ভোটের ব্যবধানে চট্টোপাধ্যায় নির্বাচিত হন।
এইবার ৭৮,৭৮৩ জন ভোটার গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। সেই ভোটারদের একটা বড় অংশ, অর্ধেকও যদি ভোট দেন এই বার, তাহলে কিন্তু আবার খেলা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নাগালের বাইরে চলে যাবে। খুব চালাকি করেই বিজেপি খুঁজে খুঁজে টিব্রেওয়ালের মতন একজন অবাঙালি, সাবর্ণ হিন্দু মহিলা কে প্রার্থী করেছে কারণ অবাঙালি ভোটাররা ভবানীপুর কেন্দ্রটি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাঙালি ভোটার সেখানে সংখ্যালঘু আর বাঙালি মুসলিম ভোটার সেখানে দূরবীন নিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। এই অবাঙালিদের বড় অংশই হয় সাবর্ণ গুজরাটি হিন্দু আর না হলে মারওয়ারী। আর সেই সাবর্ণ, অবাঙালি ভোটারদের আপন দল হল বিজেপি। তাঁরা নিজের দলের দিকে যদি ঝোঁকে তাহলে কি বাংলা নিজের মেয়েকে আর চাইবে?
গত এক মাসে বন্দোপাধ্যায়ের চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি নিজেকে ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসাবে তুলে ধরছেন। এক দিকে স্কুল-কলেজ খোলার দাবিতে চলমান আন্দোলনে সামিল ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রেফতার করে তো অন্য দিকে মোদী সরকারের “হিন্দি দিবসের” শুভেচ্ছা জানিয়ে বা ২৭শে সেপ্টেম্বরের ভারত বনধের বিরোধিতা করে, পুলিশ দিয়ে ধর্মঘট ভেঙে বন্দোপাধ্যায় বারবার তাঁর গুজরাটি ভোটারদের, মারওয়ারী ভোটারদের কাছে তাঁদের পছন্দের ফ্যাসিস্ট হয়ে তিনি উঠতে চান।
বহিরাগত মহিলা, টিব্রেওয়াল বাংলায় প্রচার করছেন, পোস্টার ছাপছেন। অন্যদিকে বন্দোপাধ্যায় হিন্দিতে পোস্টার বানাচ্ছেন। এর কারণ হল বন্দোপাধ্যায়ের বিশ্বাস যে বাঙালি ভোটাররা তাঁকেই ভোট দেবেন আর তাই তিনি বাঙালিদের বিজেপির বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে বলছেন না। বরং অবাঙালিদের প্রলুব্ধ করছেন তাঁকে ভোট দিতে। বন্দোপাধ্যায় বুঝতে পারছেন যত বেশি তিনি হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের প্রতি বিশ্বাস দেখাবেন, যত বেশি তিনি নিজেকে বিজেপির মতন দেখাবেন, তত বেশি তিনি অবাঙালি ভোট পেতে পারেন। যদি ৭৮,৭৮৩ জনের অর্ধেকও উপনির্বাচনে ভোট দেন আর তাঁদের বেশির ভাগই যদি মারওয়ারী আর গুজরাটি হয়, তাহলে বন্দোপাধ্যায়ের অবস্থা খারাপ হতে পারে। আবার টিব্রেওয়াল জানেন যে যদি তিনি বাঙালি ভোটারদের প্রলুব্ধ না করতে পারেন, তাহলে শুধুমাত্র অবাঙালি ভোটের মেরুকরণ করেও তিনি জিততে পারবেন না কারণ তৃণমূল কংগ্রেসের একটা সাংগঠনিক ভোট ব্যাংক আছে যার সাথে অনেক অবাঙালি ব্যবসায়ী জড়িত আর তাঁদের ভোট যাবে বন্দোপাধ্যায়ের ঝুলিতেই।
হয়তো ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন কোনো নতুন ফলাফল দেবে না। হয়তো বন্দোপাধ্যায় বিপুল ভোটে জিতে যাবেন। কিন্তু যে ভাবে হিন্দুত্বের ওকালতি তিনি করলেন নির্বাচনে জেতার জন্যে, অবাঙালি বেনিয়া পুঁজিপতিদের তোয়াজ করতে, তার ফলে স্পষ্ট বোঝা গেল যে আগামী দিনে তাঁর রাজত্বে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিঘ্নিত হতে পারে আর মুসলিম সম্প্রদায়কে, যাঁদের ভোটের একত্রীকরণ হওয়ার ফলে বন্দোপাধ্যায় জিতলেন, আরও বেশি প্রান্তিক ও ক্ষমতাহীন করে দিতে পারে তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস।