শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার ভারতের কৃষকদের আন্দোলনের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হল। প্রথমে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করার পরে, কৃষকদের অন্যান্য দাবীও সরকার লিখিত ভাবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় রাজধানী নয়া দিল্লীর সীমান্তে ৩৭৮ দিন ধরে চলমান আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন ৪০টির উপর কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চের—সংযুক্ত কিষান মোর্চার—নেতৃত্ব।শনিবার, ১১ই ডিসেম্বর ২০২১-এ, নাচে-গানে বিজয়ের উৎসব পালন করে কৃষকেরা ফিরে যাবেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ সহ নানা রাজ্যে নিজেদের গ্রামে, নতুন ফসল ফলাতে। কৃষক আন্দোলনের জয় দেখিয়ে দিল সংঘবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে কী ভাবে স্বৈরতন্ত্র কে হারানো সম্ভব।
কৃষক আন্দোলনের জয় যেমন একদিকে মোদীর দম্ভ ভেঙে দিল, তেমনি কর্পোরেট পুঁজির কাছে বার্তা দিল যে আগামী দিনে তার যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কৃষকেরা জোটবদ্ধ হয়ে লড়বেন। এ ছাড়াও, মোদী সরকার কে কোনো ভাবেই ভরসা কৃষকেরা করেননি। তাঁরা আন্দোলন শেষ করেননি, বরং স্থগিত করেছেন সরকারের প্রতিশ্রুতি লিখিত ভাবে পেয়ে। তাঁরা জানিয়েছেন যে আগামী ১৫ই জানুয়ারি ২০২২-এ তাঁদের নেতৃত্ব দিল্লীতে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন যে আগামী দিনে আন্দোলন আবার পুনরায় বড় আকারে শুরু করা হবে কি না, আর সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হবে মোদী সরকারের কর্মকান্ড ও সদিচ্ছা।
তবে কৃষক আন্দোলনের জয় হওয়ার পরে দিল্লীর সীমানা খালি হয়ে গেলেও শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) কিন্তু নিস্তার নেই। কৃষকেরা মোদী সরকারের শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড বাতিল, ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ বাতিলেরও ডাক দিয়েছেন কারণ ভারতে ফ্যাসিবাদের সরকারি ভাবে উত্থানের পর থেকেই শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনগুলো দুর্বল হয়ে গেছে ও ইউনিয়নগুলো আর স্বাধীন ভাবে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে তাঁদের দায়িত্বও কৃষকেরা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। এর ফলে মোদী বা বিজেপি আগামী দিনেও স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে না।
যদিও মোদী সরকার তিনটি কৃষি আইন কে সংসদে বাতিল করেছে চাপে পড়ে ও মার্কিন মুলুকে সেখানকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের আমন্ত্রণে বিশ্বের ১১৫টি দেশের গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে মোদী বাকি দাবী মেনে নেওয়ারও প্রতিশ্রুতিও দিলেন, কিন্তু তবুও কিন্তু বিজেপির মুখের কথায় ভরসা করা যায় না। কারণ আপাতত, সঙ্কটগ্রস্ত অর্থনীতির কারণে, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ আর উত্তরাখণ্ডের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির স্বার্থের দিকে তাকিয়ে মোদীর এই পদক্ষেপ, এই পিছু হঠা, কিন্তু একটি সাময়িক কৌশল। উত্তর প্রদেশের মতন রাজ্যে যদি বিজেপি পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে পারে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি দলটির সরকার রাজ্য ভিত্তিক কর্পোরেট বান্ধব কৃষি সংস্কার শুরু করবে, যার ফলে কৃষক আন্দোলন কে রাজ্যের ভিত্তিতে ভাগ করে তার শক্তি ক্ষয় করারও চরম সুযোগ থাকবে বিজেপির কাছে।
কৃষক আন্দোলনের জয় হলেও, যেহেতু কৃষকদের মনে বিজেপি কে নিয়ে, মোদীর সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ আছে তাই তাঁরা সজাগ থাকবেন বলে জানিয়েছেন। ফলে সব চোখ এখন চেয়ে আছে ১৫ই জানুয়ারির দিকে। মোদী সরকার কি ঠকাতে পারবে কৃষকদের? আলোচনার টোপ দিয়ে মোদী সরকার কি কৃষকদের চোখে ধুলা দিয়ে বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে? আগামী দিনগুলো এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।