​​অক্সফ্যাম ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এমন একটি সময়ে যখন জনসাধারণ একটি অভূতপূর্ব আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত এবং মুষ্টিমেয় বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের আর্থিক উন্নতি ক্রমবর্ধমান। পরিহাসের ব্যাপার হল অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৭ই জানুয়ারি ২০২২ এ, যার পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে বৃহৎ পুঁজি কে আমন্ত্রণ জানান ভারতে লগ্নি করার জন্যে। 

হত্যাকারী বৈষম্য: ভারত সম্পূরক ২০২২” -নামক রিপোর্টটি দেখিয়েছে যে ৯৮ জন অতি-ধনী ভারতীয় সম্মিলিতভাবে ৬৫,৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের মালিক, যা অর্থনৈতিক পিরামিডের নীচে থাকা ভারতের ৫৫.২ কোটি দরিদ্রতম মানুষের মালিকানাধীন সম্পদের সমান। অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি তে আরও দেখানো হয়েছে যে ভারতের ডলার বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা—যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের উপরে—২০২০ সালের ১০২ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ১৪২ হয়েছে, অন্যদিকে একই সময়ে ভারতের জাতীয় সম্পদে জনসংখ্যার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল ৫০% অংশের অংশাদারিত্ব ৬%-এ নেমে এসেছে৷ 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি তে উদ্ধৃত ফোর্বস বিলিয়নেয়ার্স রিপোর্ট অনুসারে, ১০০ জন অতি-ধনী ভারতীয়ের সম্মিলিত সম্পদ ২০২১ সালের অক্টোবরে ৭৭৫,০০ কোটি মার্কিন ডলারের রেকর্ড সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এই অতি-ধনী ভারতীয় পরিবারগুলির প্রায় ৮০%-রই ২০২১ সালে সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ২০২০-এর তুলনায়। এই অতি-ধনীদের মধ্যে প্রায় ৬১% ২০২১ সালে তাদের সম্মিলিত সম্পদে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার বেশি যোগ করেছে, যেখানে একই সময়কালে ৮৪% ভারতীয় পরিবার তাদের আয়ে বিরাট হ্রাসের কারণে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি তে দেখানো হয়েছে যে কীভাবে মোদীর সবচেয়ে পছন্দের পুঁজিপতিদের, যেমন গৌতম আদানি এবং মুকেশ আম্বানি, সম্পদ এমন এক সময়ে বহুগুণ বেড়েছে যখন কোটি কোটি ভারতীয় ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির, কারণে চরম অর্থনৈতিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তথ্যটি আবারও মোদী শাসনের জঘন্য এবং নির্লজ্জ কর্পোরেট-তোষণ নীতিকে প্রকাশ্যে এনেছে, যা আজকাল আর সরকার গোপনও রাখতে চায় না।   

ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের পৌষ মাস 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি ফোর্বসের তথ্য উদ্ধৃত করে দেখিয়েছে যে আদানি ২০২১ সালে ১০০ জন অতি-ধনী ভারতীয়দের মোট সম্পদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ একাই উপার্জন করেছেন। আদানির মোট সম্পদ ২০২০ সালের ৮৯০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৫,০৫০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে। 

রিপোর্টটি আদানির সম্পদ বৃদ্ধির পিছনে মুম্বাই বিমানবন্দরে তাঁর ৭৪% অংশিদারিত্ব পাওয়ার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ায় কারমাইকেল কয়লাখনির মালিকানা কে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করলেও এখানেই আদানির আয়ের উৎস লুকিয়ে নেই। দেশের কর ব্যবস্থা কে ফাঁকি দেওয়ার থেকে শুরু করে সরকারি মদদে জঙ্গল কেটে তাতে খনি বানানো, বিদ্যুৎ, কৃষি, প্রভৃতি ক্ষেত্রেই অবাধ প্রবেশ ও লুন্ঠনের সাহায্যে আদানি তাঁর আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান রাখতে সক্ষম। যদিও ২০২১-এর মাঝামাঝি সময়ে কয়েকটি সমষ্টির কথিত শেল কোম্পানির ট্রেডিং অ্যাকাউন্টগুলি হঠাৎ আটক হওয়ার কারণে একটি সাময়িক ধাক্কা আদানির সংস্থাগুলো খায়, তবুও তাঁর সম্পদ অর্জনের রথ যাত্রা পুরো মহামারীর সময়কাল জুড়ে অবিচ্ছিন্নভাবে অগ্রগামী থেকেছে।  

মোদীর অন্য বড় পৃষ্ঠপোষক, আম্বানি, যিনি সবচেয়ে ধনী ভারতীয় এবং ভারতের বৃহত্তম সংস্থা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এর মালিক, তাঁর সম্পদ ২০২০ সালে ৩,৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৮,৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে৷ আম্বানির অত্যাধিক সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা যেতে পারে রিলায়েন্সের নতুন খুচরা ব্যবসায় কোটি কোটি ডলারের বিদেশী লগ্নিকে। বিশ্বের তাবড় তাবড় কোম্পানি আম্বানির জিও মার্টের ব্যবসায় কোটি কোটি ডলার লগ্নি করেছে।  

পিউ রিসার্চের গবেষণা এর আগে ভারতে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের ঘটনা প্রকাশ করেছিল 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রকাশ হওয়ার অনেক আগে, পিউ রিসার্চের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মহামারী-আক্রান্ত ২০২০-এর সময়, ভারতের মধ্যবিত্ত বা মধ্য-আয়ের গোষ্ঠীর সংখ্যা—যারা প্রতিদিন ১০.০১ থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে আয় করে—৩.২ কোটি কমে গেছে। এটি ছিল মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যার মোট বৈশ্বিক পশ্চাদপসরণের ৬০%। 

একই সময়ে, পিউ রিসার্চের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ভারতের মোট দরিদ্র সংখ্যা—যারা দিনে দুই ডলার বা তার কম আয় করে—২০২০ সালে ৭.৫ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী মোট দারিদ্র্য বৃদ্ধির ৬০%। 

ভারতে এই সম্পদ ব্যবধানের কারণ কী? 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি তে দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পদের বৈষম্যের পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে মোদী সরকারের কর্পোরেট কর কমানোকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও এটি সত্য যে মোদীর শাসনকালে কর্পোরেট ট্যাক্স উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, “বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত” করার অজুহাতে, কিন্তু এটিই ভারতে এই ক্রমবর্ধমান সম্পদ বৈষম্যের একমাত্র কারণ নয়। 

আমরা আগে দেখিয়েছি কী ভাবে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা পণ্য উৎপাদনের দ্রুত হ্রাস পাওয়া লাভের হারের কারণে আর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুন লগ্নি করছে না। বরং এই হাতেগোনা কিছু বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা তাঁদের সম্পদকে বহুগুণ বৃদ্ধি করার জন্য, মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, কাল্পনিক পুঁজির পথ ব্যবহার করছে। অধিকন্তু, বড় কর্পোরেটগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির থেকে বিশাল ঋণ নিয়েছে এবং শোধ করেনি, যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। 

ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে শীর্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এপ্রিল ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২০-র মধ্যে ৪.৩৭ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ কে মন্দ ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করে নিজের খাতার থেকে মুছে দিয়েছে৷ যেহেতু গরিব মানুষদের, বিশেষ করে গরিব কৃষকদের বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের, কেউই এই ঋণ খেলাপি করেন না, তাই বলাই বাহুল্য যে বেশির ভাগ এই ধরনের বিশাল খারাপ ঋণ নিজের খাতার থেকে মুছে দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি শুধুমাত্র বড় কর্পোরেটদের সাহায্য করে৷ এখন, যেহেতু এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ কাল্পনিক পুঁজি বিকাশ এবং মুনাফায় বিনিয়োগ করা হয়, তাই এই অনাদায়ী ঋণ ভারতের বড় পুঁজিবাদী হাঙ্গরদের সম্পদ বৃদ্ধির ইঞ্জিনকেও চালিত করছে। 

মোদী সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের পাইকারি হারে বেসরকারীকরণ বড় দোসর পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছে। নগদ সমৃদ্ধ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এলআইসি), স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (সেল), সাধারণ বীমা সংস্থাগুলি, ভারতীয় রেলওয়ে থেকে শুরু করে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক,  সবকিছুই মোদী সরকারের বেসরকারীকরণের থালায় সাজানো রয়েছে কর্পোরেটদের পরিবেশন করার জন্যে। সমস্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও, মোদী টাটা গোষ্ঠীর কাছে জলের দামে এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করতে সক্ষম হন। অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের সম্পদগুলিও লিকুইডেট হওয়ার পথে রয়েছে। 

এই ভাবে বিনা প্রতিরোধে বড় পুঁজিপতিদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির থেকে সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘাম এক করে রোজগার করে সঞ্চিত করা অর্থ ঋণ হিসাবে দিয়ে, সেই ঋণ কে ইচ্ছাকৃত ভাবে অনাদায়ী ঋণে পরিণত করে, জলের দামে সেই ঋণ খেলাপি করা পুঁজিপতিদেরই সেই ব্যাঙ্ক সহ বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সব সংস্থা বিক্রি করে দিয়ে, ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার বাজারে কাল্পনিক পুঁজি গড়তে ফাটকা খেলার অনুমতি দিয়ে ও সর্বোপরি, কর্পোরেট ও সম্পদ করে ব্যাপক ছাড় দিয়ে মোদী সরকার ভারতের ১৪২জন অতি ধনীকে দেশের ৫৫ কোটি গরিব মানুষের চেয়ে বেশি সম্পদ জমা করতে দিয়েছে।  

 গরিবদের ব্যাপারে সরকার উদাসীন কেন? 

যখন দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন একটি সংশ্লিষ্ট অমার্কসবাদী সরকার কিইনসের অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসরণ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে এবং বাজারে চাহিদা তৈরি করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এই ভাবেই চক্রাকারে পুঁজিবাদ কে রক্ষা করা হয় কিছু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়ে। যে মুহূর্তে মুনাফার হার কমে যায় আর বাজারে উৎপাদনের মাধ্যমে পণ্য সরবাহ করে মুনাফা কমানোর থেকে ফাটকা বাজারে অর্থ দিয়ে বেশি অর্থ রোজগার করা সম্ভব তখন পুঁজিপতিরা উৎপাদনে লগ্নি করা কমিয়ে দেয়।  

ফলে, পুঁজিবাদের নিয়ম হিসাবে মুনাফা পুঁজিপতির আর লোকসানের ভার বইবে জনগণ, এই তত্ত্ব অনুসারে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করতে রাষ্ট্র জনতার অর্থ লগ্নি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে, যাতে বাজারে অর্থ বৃদ্ধির কারণে পণ্যের চাহিদা বাড়ে ও পুঁজিপতিরা পণ্য উৎপাদনে ইচ্ছুক হয়ে লগ্নি করে। যাই হোক, মোদী সরকার সেই পথটি মোটেও অতিক্রম করেনি। 

ভারতের দরিদ্রদের প্রতি মোদী সরকারের উদাসীনতার কারণ, এমনকি তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণ, হল জনসংখ্যার  ২০% মানুষের উপর সরকারের নজর থাকা ও তাঁদের স্বার্থেই নানা নীতির প্রণয়ন করা। কারা এই ২০%? তাঁরা হলেন সেই উচ্চবিত্ত আর শহুরে মধ্যবিত্ত যাঁদের ক্রয় ক্ষমতা আছে ও যাঁরা নানা ধরণের নতুন পণ্য ও পরিষেবা পাওয়ার জন্যে অর্থ, এমনকি ঋণ নিয়েও, খরচ করেন। যেহেতু তাঁরাই পুঁজিবাদের বর্তমান উপভোক্তা, তাই তাঁদের স্বার্থের দিকে নজর দিয়েই সমস্ত সরকারি নীতি প্রণয়ন করা হয়।  

ভারতের স্বাধীনতার পর, সরকার শুধুমাত্র শিল্প উন্নয়নের শর্ত প্রস্তুত করার জন্য কৃষির উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করেছিল। পশ্চাদপদ, আধা-সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিকে শিল্প বিকাশের প্রধান বাধা হিসাবে উপলব্ধি করে, প্রাথমিক উত্তর-উপনিবেশিক সরকারগুলি, বিশেষ করে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকার, পথের দুটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করেছিল ––মজুরি-পণ্যের বাধা এবং সীমিত চাহিদার বাধা। 

চিত্তরঞ্জন দাস তার বই, “পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার এবং ভারতের কৃষি অর্থনীতি”-তে দেখিয়েছেন যে ইন্দিরা গান্ধীর অধীনে কংগ্রেস পার্টির সরকার, বহুল প্রচারিত “সবুজ বিপ্লবের” মাধ্যমে, ক্রমাগত খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে মজুরি-পণ্যের বাধা অতিক্রম করেছিল। শহরাঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত এবং আংশিক রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প শ্রমিকদের সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল মূল্যে খাদ্য শস্য যোগান দিয়েছিল। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে,  সীমিত সময়ের জন্য, মধ্য ও বড় কৃষকদের জন্য, চাষ থেকে কিছু উদ্বৃত্ত আয় উপার্জনের সুযোগ হয়েছিল। এই অর্থ শিল্প পণ্যের গ্রামীণ বাজার সম্প্রসারণে সহায়তা করেছিল। 

যদিও এই মডেলটি—— “সবুজ বিপ্লব” বা প্রযুক্তির সাহায্যে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি——কিছু সময়ের জন্য ভারতে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য সঙ্কটের সাময়িক ভাবে সমাধান করেছিল, গ্রামীণ ভারতে দরিদ্র এবং প্রান্তিক কৃষক এবং ধনী কৃষক এবং সামন্ত জমিদারদের মধ্যে বিশাল শ্রেণী দ্বন্দ্ব এই উৎপাদন বৃদ্ধির সুফলকে পিরামিডের নীচে অবস্থিত মানুষের কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। সামন্ত জমিদার এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ধনী কৃষকদের গ্রামীণ সম্পদের ব্যাপক বৃদ্ধি তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে প্রচুর দরিদ্র কৃষক আরও দরিদ্র হয়ে যান, ও ভূমির থেকে উচ্ছেদিত হয়ে অসংগঠিত “পরিযায়ী” শ্রমিক হয়ে দেশের বড় বড় শহরে নিজের শ্রম বিক্রি করতে দৌড়ান। 

নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির আবির্ভাবের সাথে, বিশেষ করে গত শতকের নয়ের দশক থেকে, ভারতের একের পর এক রাজনৈতিক দলের সরকারগুলো কৃষি জীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উপর একের পর এক আক্রমণ নামিয়ে আনে। কর্মসঙ্কোচন, শ্রম আইনের সংস্কার, সরকারি চাকরি ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কে শেষ করে দেওয়া থেকে শুরু করে কৃষি ক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির প্রবেশের পথ অবাধ করা, জমি অধিগ্রহণ ও সার এবং নানা কৃষি উপকরণের উপর ব্যাপক ভাবে ভর্তুকি ছাঁটাই করে গরিব মানুষের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করা হয়। তাঁদের ভাতে মারার ব্যবস্থা করা হয়।  

মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার ২০১৫ সালে যে কুখ্যাত ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করতে চেয়েছিল, তার থেকে শুরু করে বাধ্যতামূলক ভারতীয় নাগরিকত্বের জাতীয় পঞ্জী (এনআরসি) প্রকল্পের মাধ্যমে, ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের দরিদ্র জনগণকে তাঁদের জেতা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা পর্যন্ত, শ্রম আইনের সংস্কার থেকে শুরু করে কৃষিতে কর্পোরেট আধিপত্য কায়েম করা পর্যন্ত, নানা ধরণের জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করে গরিব মানুষ কে দেশের মধ্যে বঞ্চিত ও নির্যাতিত অবস্থায় রাখার বন্দোবস্ত করছে। দরিদ্রদের খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য “এক দেশ এক রেশন কার্ড” প্রকল্পের অধীনে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের থেকে কোটি কোটি মানুষের নাম কাটার ব্যবস্থা করেছে। এই ভাবে গরিবের পকেট কেটে, তাঁকে জানে মেরে বৃহৎ কর্পোরেটদের উদরপূর্তি করে চলেছে মোদী সরকার।

কেন এক দেশ এক রেশন কার্ড একটি ভয়ানক প্রকল্প? এই ভিডিওতে দেখুন।

বিজেপি সরকার যখন দরিদ্রদের গভীর খাদে নিক্ষেপ করছে, তখন শহুরে অভিজাত এবং মধ্যবিত্ত, ভারতের ২০% বা প্রায় ২০ কোটি মানুষ যাঁরা ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মোদীকে ভোট দিয়েছিলেন, চরম উদাসীনতার সাথে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন দেশের ৮০% জনগণের সঙ্কটের থেকে। তাঁরা, বিশেষ করে ভারতের প্রায় ১৫ কোটি শহুরে মধ্যবিত্ত, আজ তাকিয়ে আছেন মোদী সরকারের নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক মডেলের “উপর থেকে চুঁইয়ে পড়া”——অর্থাৎ অতি-ধনীদের পাত থেকে তার পরের স্তরের, ধনীদের, পাতে গড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে আবার নিচে পড়া অবশিষ্ট——মধুর ফোটার দিকে, যা তাঁরা চেটে পুটে খেতে চান, কাউকে ভাগ না দিয়েই। গরিব মানুষেরা থেকে যান অন্ধকারেই, কেউই তাঁদের দিকে ফিরে দেখে না। 

এই সঙ্কটের থেকে মুক্তির রাস্তা কী? 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি কয়েকটি সমাধানের পরামর্শ দেয়–– যেমন সম্পদের পুনঃবন্টন করার জন্য সম্পদ করের মাধ্যমে রাজস্ব তৈরি করা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় সামাজিক বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব তৈরি করা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য বিধিবদ্ধ সামাজিক নিরাপত্তা বিধান  প্রণয়ন করা এবং নীতি পাল্টে ফেলে সম্পদ ও ধন বৈষম্য রুখে দেওয়া। একটি বেসরকারী সংস্থা হিসাবে, এই পরামর্শগুলি অক্সফ্যামের দর্শনের সাথে খাপ খায়। যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল––এই ধরনের পদক্ষেপগুলি কি দরিদ্রদের জন্য পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে? 

সম্পদ কর 

একজন ব্যক্তির স্থায়ী সম্পদের উপর একটি সম্পদ কর আরোপ করা হয়। একটি নির্দিষ্ট স্তরের উপরে সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের প্রতি বছর সরকার কর্তৃক তাদের হিসাবকৃত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর হিসাবে দিতে বাধ্য করা হয়। সেই অর্থই আবার পরবর্তীতে সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি কল্যাণকর মুখোশধারী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এটাই হল সম্পদ করের বিবরণ, যদিও কোনো সরকারই আজ অবধি এই কর বিশ্বের কোথাও সততার সাথে পুঁজিপতিদের থেকে আদায় করতে পারেনি। 

১৯৫০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত, ভারতে সম্পদ কর ব্যবস্থা বিরাজ করতো যা প্রতি বছর ৩০ লক্ষ টাকার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তির সম্পদের ১% কর হিসাবে ধার্য করে আদায় করতো। সঙ্ঘের বাজেট ২০১৫-১৬ থেকে, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এই সম্পদ কর কে অকেজো বলে বিলুপ্ত করেন। তিনি এই করের অপসারণের জন্য এই ট্যাক্সের খাতে ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে মাত্র ১,০০০ কোটি টাকা আয় করা কে দুর্বল সংগ্রহ বলে উল্লেখ করেন ও এই কর কে বিলুপ্ত করেন৷  

যাই হোক, জেটলি বছরে ১ কোটি টাকার বেশি আয়ের উপর ২% সুপার-রিচ সারচার্জ আরোপ করেছিলেন। যাঁরা বছরে ১০ লক্ষ টাকার বেশি আয় করেন তাঁদের জন্য ট্যাক্স স্ল্যাব ৩০%, ১ কোটি টাকা বা তাঁর বেশি আয়কারীদের জন্য মোট সারচার্জ ১২% হয়ে গেছে। তাঁর কেন্দ্রীয় বাজেট ২০১৯-২০ এ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সারচার্জের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছেন। নতুন হার অনুসারে–– ১ কোটি থেকে ২ কোটি টাকার মধ্যে বার্ষিক আয়ের জন্য ১৫% সারচার্জ, ২ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে আয়ের জন্য ২৫% এবং ৫ কোটির বেশি বার্ষিক আয়ের জন্য ৩৭% সারচার্জ দিতে হবে। 

এখন সরকারের ট্যাক্স রসিদ বিবরণী অনুসারে এই সারচার্জের সংগ্রহ বেশ কম হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাজেট 2021-22 অনুসারে, সরকার কর্তৃক মোট আয়কর বনাম মোট সারচার্জ সংগ্রহ নিম্নরূপ: 

রাজস্ব আয় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের আসল আয় ২০২০-২১ অর্থ বছরের সংশোধিত আনুমানিক হিসাব  ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট হিসাব 
আয়কর ৪.৫৩ লক্ষ  ৩.৮৭ লক্ষ ৪.৭৫  
অতিরিক্ত কর ৫,২৩৭ ৪২,৯৮১ ৫২,৭৪০ 
সম্পদ কর ১৯.৮১ — — 
তথ্যসূত্র: ভারতের সঙ্ঘ বাজেট ২০২১-২২ 

অতি-ধনীদের আয়ের উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে ধন বৈষম্য কমানোর ধারণাটি অনেক পুরানো হলেও চূড়ান্ত ভাবে অকেজো। ধন দৌলতের পিরামিডের শীর্ষে আসীন এই হাতে গোনা অতি ধনীরা কখনোই তাঁদের আয় জনসমক্ষে নিয়ে আসেন না। নিজেদের ব্যবসার থেকে তাঁরা নাম মাত্র পারিশ্রমিক নেন, যা তাঁদের কর কে অনেক কম করে দেয়। অর্থের জায়গায় শেয়ার লগ্নি, বন্ড, সম্পত্তিতে লগ্নি ও বিদেশী লগ্নির মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের ধন ব্যবহার করে আরও ধনী হতে থাকেন আর আয়কর দফতর তা দেখতে থাকে। 

যদিও সম্পত্তি কর আয়করের চেয়ে বেশি কার্যকরী হয়, তবুও বেনামী সম্পত্তি, বিদেশে সম্পদ খরিদ করে, এই পুঁজিপতিরা নিজেদের ধন দৌলতের হিসাবে গরমিল সৃষ্টি করে প্রকৃত ধনরাশির উপর কর দেওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পান। ফলে কোনো ভাবেই করের বাঁধনে গরিব মানুষের মতন ধনী আর অতি-ধনীদের বাঁধা যায় না। এই প্রবণতা শুধুই ভারতের পুঁজিপতিদের নয় বরং এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। মার্কিন সরকারের তথ্য উদ্ধৃত করে, আমেরিকান অলাভজনক প্রকাশনা প্রোপাব্লিকা দেখিয়েছে কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি ধনীরা কর ফাঁকি দেয়। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সমীক্ষা অনুসারে, অতি-ধনীরা তাদের আয়ের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি আয়ের উপর কর ফাঁকি দেয়, যার পরিমাণ হল বছরে প্রায় ১৭,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার।   

এই পরজীবী শ্রেণী, একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজিবাদের প্রকৃত সুবিধাভোগী, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির মতো উন্নত দেশগুলিতে সরকারী যন্ত্রগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, তখন ভারতের মতন একটি অনুন্নত দেশের ফ্যাসিবাদী সরকার কীভাবে তাদের থেকে মুক্ত থাকবে? এটি এই সম্পদ বা ধন বৈষ্যমের একটি বড় কারণ। এমনকি যদি সরকার পুঁজিপতিদের উপর সম্পদের কর চাপিয়েও দেয়, যার সম্ভাবনা খুবই কম, ক্ষমতাসীন দল, আমলাতন্ত্র এবং অন্যান্য শাখার উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে তারা এই ধরনের কর প্রদান থেকে দূরে থাকবে। 

সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নির্দেশ অনুসরণ করে, ভারতীয় শাসক শ্রেণীগুলি বছরের পর বছর ধরে সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে ব্যয় উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস করে চলেছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) সরকারের আমলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বছরে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (MNREGA) এর মতন কর্মসংস্থান-সৃষ্টির আইন প্রণয়ন করা হলেও, ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই মোদী  সরকার এই খাতে বরাদ্দ কমাতে থেকেছে নানা কায়দায়। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করে এমন একটি প্রকল্প এই MNREGA কে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে গ্রামের গরিবদের শহরে যেতে বাধ্য করার রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে।  

এ ছাড়াও সামাজিক খাতে নানা ভাবে ভারত সরকার বরাদ্দ কমিয়ে এসেছে। অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি দেখিয়েছে যে ভারত চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইত্যাদি, মধ্য আয়ের দেশের তুলনায় জনস্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জনশিক্ষায় অনেক কম অর্থ ব্যয় করছে বছরের পর বছর। স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, প্রভৃতি ক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণের মাধ্যমে এই জরুরী সামাজিক ক্ষেত্রগুলো কে পণ্যে পরিণত করেছে মোদী সরকার। এর ফলে যেমন করোনা মহামারীর কালে তীব্র ভাবে সঙ্কটগ্রস্ত হয়েছেন ভারতের জনগণ তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার নব্য সংস্কার——জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০——ব্যবহার করে গরিবদের শিক্ষার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।  

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি দেখিয়েছে যে বৈষম্যমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে, ভারতবর্ষের একজন দলিত মহিলার আয়ু উচ্চ বর্ণের মহিলার চেয়ে ১৫ বছর কম। পুরুষদের মধ্যে, দলিতদের আয়ু তিন বছর কম, উপজাতিদের আয়ু চার বছর কম এবং মুসলিমদের আয়ু উচ্চ বর্ণের হিন্দু পুরুষদের তুলনায় এক বছর কম।  

আদানি এবং আম্বানিদের সমৃদ্ধ করার জন্য মোদী শাসনের দ্বারা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও সংস্থাগুলো বেচে দেওয়া হচ্ছে বা বন্ধ করা হচ্ছে, এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোয় দলিত, উপজাতীয় মানুষ এবং অনগ্রসর শ্রেণী (ওবিসি)দের যে চাকরির সুযোগ ছিল তা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এখন ভারতে রয়ে গেছে শুধু নিরাপত্তা-হীন  বেসরকারি চাকরি, যেখানে প্রান্তিক মানুষের জন্য কোনও সংরক্ষণ নেই এবং যেখানে নিয়োগকর্তাদের কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতা সিদ্ধান্ত নেয় কোন ধর্মের বা কোন জাতির কর্মী কে নিয়োগ করা হবে এবং কত মজুরি দেওয়া হবে। 

এই পরিস্থিতিতে, সরকার সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে আরও বেশি লগ্নি করবে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করবে, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষার জন্য তহবিল গড়বে এবং এর সাথে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের পেনশন এবং সামাজিক নিরাপত্তা দেবে, এমন আশা করা নিছক বাস্তববাদ বর্জিত শিশুসুলভ চিন্তা। 

তাহলে পথ কী? 

শুধু মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রো-কর্পোরেট তোষণ নীতি ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও খারাপ করছে না। মোদী সরকারের কারণেই আজ ভারতে ধন বৈষম্য তীব্র হয়নি। বরং, সমস্যা হল বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজিবাদের অস্তিত্ব, যা ভারতকে তার মুষ্টিমেয় অতি-ধনী মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শাসন করে এবং গ্রামাঞ্চলে ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ককে ব্যবহার করে নিজের শাসন কে শক্তিশালী করে। 

পুঁজিবাদের অস্তিত্বের অর্থই হল ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়ানোর জন্য শাসক দল নির্বিশেষে সরকারগুলি দ্বারা আরও জনতার সম্পদ বড় পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। পুঁজিবাদের অস্তিত্ব মানেই সম্পদের ব্যবধানকে প্রশস্ত করা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের তীব্রতা। তদুপরি, পুঁজিবাদ সবকিছুকেই পণ্যসামগ্রী বানিয়ে চলেছে; বায়ু এবং জল থেকে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তাঁদের কাছে দুর্লভ হবে যাঁদের আর্থিক সঙ্গতি নেই। 

অক্সফ্যামের ভারতের অথনৈতিক বৈষম্য সংক্রান্ত রিপোর্টটি কেবল শৈল শিলার চূড়াটা উন্মোচিত করেছে। যতক্ষণ না পরজীবী এবং মৃতপ্রায় একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজিবাদ লাগামহীনভাবে শোষণ-শাসন চালাতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পদের ব্যবধান কমানো বা দরিদ্রদের চরম দারিদ্র্য থেকে উন্নীত করা যাবে না। শুধুমাত্র উৎপাদনের উপায়ের সামাজিক মালিকানা, মুখ্য শিল্প গুলির সামাজিকীকরণ এবং একটি জনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশই পরিস্থিতিকে বদলাতে পারবে। 

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla