আজ আবার ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। নাৎসি জার্মানির ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক আডলফ হিটলারের স্বপ্নের রাজধানী শহর জার্মানিয়ার আদলে তাঁর স্বপ্নের সেন্ট্রাল ভিস্টার নির্মীয়মাণ প্রকল্পের সামনেই সেনা বাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখবেন ও সেলামি নেবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই সময়ে অবশ্য তাঁকে যে জিনিসটা আতঙ্কিত করবে তা কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কা নয়, বরং অতীতের ঘটনাবলী, ট্র্যাক্টরের ইঞ্জিনের শব্দ। এই প্রজাতন্ত্র দিবসেই ভারতের রাজধানী দিল্লীর বুকে কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের এক বছর পূর্তি হবে। প্রথম বার্ষিকী হবে লাল কেল্লার উপর শিখ ধর্মের পবিত্র নিশান সাহিব উত্তোলনেরও। 

এই কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের এক বছর পূর্তি কিন্তু মোদী কে ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার কে ভীত করেছে কিছু বিশেষ কারণে। প্রথমতঃ গত বছর, প্রায় দুই মাস ধরে দিল্লীর সীমান্তে মোদী সরকারের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান করে সরকারের উদাসীনতায় বিরক্ত হয়ে কৃষকেরা ট্র্যাক্টরে চেপে প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লীর ভিতর, ক্ষমতার আলিন্দে গিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা করে। এই ঘটনা মোদী সরকার কল্পনাও করতে পারেনি।  

দ্বিতীয়তঃ কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের পরে ও লাল কেল্লায় নিশান সাহিব উত্তোলনের পরে কিন্তু সরকার আর তার পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম ভেবে নিয়েছিল যে দিল্লীর সীমান্তে কৃষকদের বিক্ষোভ আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের চাপে আর জনগণের নিন্দার কারণে। তা হয়নি একেবারেই কারণ কৃষকেরা সাবর্ণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের হাত থেকে কৃষক আন্দোলনের রেশ সরিয়ে রেখেছিলেন, ফলে শহরের মধ্যবিত্তদের তাঁদের আন্দোলন নিয়ে কী মনোভাব তা নিয়ে কৃষকেরা মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। এ ছাড়াও তাঁদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেন জাট কৃষক নেতা ও অতীতে বিজেপির সহযোগী রাকেশ টিকায়েত। গাজীপুর বর্ডারের থেকে খেলা ঘুরতে শুরু করে আর মাস যেতেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ আর হরিয়ানায় বিজেপির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ফলে আজও বিজেপির ভয় পাছে কৃষকেরা আবার ফিরে আসেন।  

তৃতীয়তঃ দীর্ঘ ৩৭৮ দিন ধরে নিজেদের অবস্থান বিক্ষোভ চালানোর পরে রাজধানী দিল্লীর সীমান্তের থেকে গ্রামে চলে গেছেন কৃষকেরা। অবশ্যই খালি হাতে না। গত ২৯ নভেম্বরে ভারতের সংসদে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন বাতিল করা হয় আর নতুন আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনী গ্যারান্টি দেওয়ার দাবি, আন্দোলনরত অবস্থায় নিহত কৃষকদের পরিবার কে ক্ষতিপূরণ ও ন্যায় দেওয়ার দাবি ও সমস্ত পুলিশ কেস তুলে নেওয়ার কৃষকদের দাবি কে সরকার লিখিত ভাবে মেনে নেওয়ার পরেই এই কৃষকেরা দিল্লী ছেড়ে চলে যান। আর তাঁরা চলে যাওয়ার পর থেকেই নিজের অন্য রূপ দেখাচ্ছে বিজেপি। একদিকে কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র তোমর বলছেন যে কৃষি আইনগুলি আবার ফিরিয়ে আনা হবে আর অন্য দিকে ১৫ই জানুয়ারি ২০২২ অবধি সময় দেওয়া সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনের চালিকা সংগঠন সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম) সরকারের প্রতিশ্রুতি খেলাপির কারণে ক্রুদ্ধ ও পুনরায় আন্দোলন করার ডাক দিয়েছে। 

এহেন পরিস্থিতিতে, দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির কান্ডারি মোদী জানেন যে তাঁকে তাঁর বৃহৎ পুঁজিপতি পৃষ্টপোষক গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি, রতন টাটা, প্রভৃতির স্বার্থে, ও তাঁদের মালিক বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থে, দেশের কৃষির উপর কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্য কায়েম করতেই হবে। সাথে নিতেই হবে বৃহৎ সামন্তপ্রভুদের। তাই যে করেই হোক আসন্ন পাঞ্জাব আর উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের পালা শেষ হলেই মোদী সরকার নতুন করে কৃষির উপর কর্পোরেট আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত করতে ঝাঁপাবে। কিন্তু মোদী এটাও জানেন যে কৃষকেরা ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়। 

যাঁরা প্রজাতন্ত্র দিবসের দিল্লীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনী ঘোড়ায় চেপে আর ট্র্যাক্টরে চেপে ভেদ করে লাল কেল্লা দখল করতে পারে, সেই মানুষগুলোর কাছে যে পার্লামেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর সুদূরের কোনো বস্তু নয় তাও মোদী জানেন। তিনি চান না সেই কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চ এই বার সংসদ ভবনে আসুক। গত ১৫ই অগাস্ট, ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত দিল্লীর লাল কেল্লার বার্ষিক অনুষ্ঠানে বিশাল বিশাল শিপিং কন্টেনার দিয়ে দেওয়াল বানানো হয় মোদীর আতঙ্ক কমাতে। আজ তার চেয়েও বেশি আতঙ্ক নিয়ে তিনি আবার আসছেন। তিনি জানেন যে নির্বাচনের আগে কৃষকদের দরকার হলেও পরে আর নাই। তাঁকে শুধু কপোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে আর তাই মোদী জানেন ভালো করে তাঁকে অনেক সুদক্ষ ভাবে ট্র্যাপিজ ওয়াক করতে হবে। 

কিন্তু মোদী কি পারবেন গত বছরের ঐতিহাসিক কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের ঘটনা ভুলতে? তিনি কি পারবেন কৃষকদের ফসলের উপর কর্পোরেটদের বিজয় নিশান ওড়াতে? নাকি কৃষক আন্দোলনের একের পর এক ঢেউ তাঁকে আর তাঁর কর্পোরেট-তোষণকারী সরকার কে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অতল সমুদ্রের দিকে? কী হবে সেটা পরে জানা গেলেও, রাজধানী দিল্লীর বুকে কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চের এক বছর পূর্তি কিন্তু কাউকেই ভুলতে দেবে না কত কষ্ট, অত্যাচার, দুঃখ, যাতনা সহ্য করে কৃষকেরা লাল কেল্লা দখল করেছিলেন ভারতের মোদী সরকারের থেকে, যে সরকার ওই লাল বাড়িও বিক্রি করে দিয়েছে ডালমিয়া গোষ্ঠী কে। আর এই কষ্টের ফলে তাঁরা থামেননি কিন্তু, তাঁরা বরং এগিয়ে চলেছেন তাঁদের বকেয়া দাবি আদায় করার দাবিতে।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla