পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্ব তাঁদের দলের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উপর তীব্র আক্রমণ করেছে। হিন্দুত্ব-চালিত দলটির এবং এর পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দ্বারা পশ্চিমবঙ্গে আমদানি করা রাম নবমী নামক একটি উত্তর ভারতীয় হিন্দু উৎসব উপলক্ষে বন্দোপাধ্যায়ের সরকার ছুটি ঘোষণা না করায় এবং সেই উৎসবের দিনেও তাঁর দুইদিন-ব্যাপী কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী ধর্ণা চলায় মুখ্যমন্ত্রীর ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে গেরুয়া শিবিরের তরফ থেকে।

যদিও বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা বন্দোপাধ্যায়কে সতর্ক করেছিলেন যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি রাজ্য জুড়ে রাম নবমী উপলক্ষ্যে সশস্ত্র সমাবেশের আয়োজন করবে  –– যা প্রায়শই সহিংস হয়ে ওঠে এবং ২০১৮ সাল থেকে রাজ্যে ব্যাপক মুসলিম বিরোধী হিংসার কারণ হয় –– মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সতর্ক করেছিলেন যে প্রতিটি সংগঠনের সমাবেশ করার অধিকার আছে কিন্তু যদি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসার একটিও ঘটনা ঘটে, তাহলে তাঁর সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। 

যাই হোক, তার সতর্কতা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু বিরোধী সহিংসতার ঘটনাগুলি কলকাতার পার্শ্ববর্তী হাওড়া জেলা থেকে রিপোর্ট করা হয়েছে।  রিপোর্ট হচ্ছে যে একটি রাম নবমী মিছিল সংখ্যালঘু মুসলিম-অধ্যুষিত কাজিপাড়া এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মুসলিম বিরোধী সহিংসতা ছড়ায়। এটি অভিযোগ করা হয়েছে যে মিছিলের থেকে উস্কানি দেওয়ার ফলে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল এবং এই বিবাদ থেকে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ শুরু হয়েছিল।

তাণ্ডবের ফলস্বরূপ বেশ কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয় এবং ভারী পুলিশ উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও হিংসাত্মক ঘটনা বাধাহীনভাবে চলে। অবশেষে, পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারগ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, কিন্তু অভিযোগ করা হয়েছে যে হিন্দিভাষী “বহিরাগতরা” নিরাপত্তা বাহিনীর শান্তি মিছিল শেষ হওয়ার পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর পুনরায় হামলা চালায়।

হাওড়া জেলায় সামগ্রিক পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ রয়ে গেছে, যেটি পূর্ববর্তী বছরগুলিতে অনুরূপ অনুষ্ঠানের সময় একই ধরনের পরিকল্পিত সহিংসতার শিকার হয়েছিল। যেহেতু বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) রাজ্যের হিন্দি-ভাষী হিন্দুদের বিজেপির শিবির থেকে নিজের দিকে টানতে সচেষ্ট তাই রাম নবমী এবং অন্যান্য উত্তর ভারতীয় হিন্দু উৎসবের সময় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নরম অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ।

বন্দোপাধ্যায়ের প্রাক্তন আস্থাভাজন শুভেন্দু অধিকারী, যিনি ২০২০ সালের শেষের দিকে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাক্তন নেত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন।  অধিকারী বন্দোপাধ্যায় কে রাজ্যে রাম নবমী উপলক্ষ্যে ছুটি ঘোষণা না করার জন্যে হিন্দু অনুভূতিতে আঘাত করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। ঘটনা হল যে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী হিন্দু সম্প্রদায় ২০১৭ সালের আগে তাদের উত্তরের সমকক্ষদের মতন রাম নবমী উদযাপন করেনি।

২০১৭ সাল থেকেই, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়কে উস্কানি দিতে ও হিংসার ঘটনা ঘটিয়ে রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ করার জন্যে বিজেপি ও আরএসএস পরিকল্পিত ভাবে এই ধর্মীয় উৎসব কে কাজে লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ। আপামর হিন্দু জনগণের এই রাজনৈতিক ভাবে চালিত উৎসবের প্রতি কোনো আকর্ষণ আছে কি না সেটা উপেক্ষা করেই এই উৎসব পালন ও তাতে অস্ত্র প্রদর্শন করার জন্যে বিজেপি ও আরএসএস সরকারের কাছে দাবি করে আসছে, ও রহস্যজনক ভাবে রাজ্য সরকার বা শাসক টিএমসি এই নিয়ে কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে রাম নবমী উদযাপনের সময় পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-বিরোধী একটি বৃহত্তর হিংসার ঘটনায় অনেক জন হতাহত হন। গুরুতর আহত হন উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মীরাও। সহিংসতার ঘটনায় নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন আসানসোলের একজন মুসলিম কিশোর, যার ইমাম বাবা একজন উল্লেখযোগ্য  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রবক্তা ও শান্তির বার্তা প্রেরকে পরিণত হয়েছিলেন। এটি লক্ষণীয় যে ২০১৮ সালের আসানসোল হিংসার জন্য অভিযুক্ত প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় পরে টিএমসিতে যোগ দিয়েছিলেন।

রাম নবমী মিছিলে সহিংসতা প্রতিবেশী হাওড়ায় সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে, মুখ্যমন্ত্রী, যিনি কলকাতার রেড রোডে বিআর আম্বেদকরের মূর্তির নীচে ধর্ণা দিচ্ছিলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন যে তাদের কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। যাই হোক, বেশিরভাগ উগ্র দক্ষিণপন্থী অপরাধীদের বিচার করার ক্ষেত্রে তার সরকারের রেকর্ড এবং অপরাধের শিকারদের ন্যায়বিচার প্রদানের ক্ষেত্রে, খুব আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না।

মতাদর্শগত স্তরে বিজেপি এবং আরএসএস-এর সাথে লড়াই করার পরিবর্তে, বন্দোপাধ্যায়ের টিএমসি এই দু’জনের কাছ থেকে হিন্দুত্বের আদর্শ গ্রহণ করেছে।  তারা আরএসএস-নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ব শিবিরের প্রতি একটি নরম মনোভাব বজায় রেখেছে যাতে টিএমসির হিন্দু ভোটার ভিত্তি বিরক্ত না হয়।  তদুপরি, বিজেপি তীব্রভাবে লড়াই করেও, উগ্র হিন্দুত্ববাদ কে ব্যবহার করেও ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসির কাছে হেরেছে।  গেরুয়া শিবিরের এখন রাজ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণ অংশে, যেখানে তারা সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে হারানো মাটি পুনরুদ্ধার অত্যন্ত প্রয়োজন।

যেহেতু বন্দোপাধ্যায়ের টিএমসি রাজ্যের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দিকে নজর রেখেছে, তাঁর সরকার সাম্প্রদায়িক হিংসার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে এবং কাজ করতে পারে কিনা তা এখনও দেখা বাকি আছে। ফলে রাম নবমীর মিছিলের অছিলায় আবার একটি মারাত্মক হিংসার ঘটনা ঘটিয়ে বিজেপি আর আরএসএস যে বহাল তবিয়তে থাকতে পারে তার নিদর্শন আবার দেখা যাবে।  

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা – People's Review Bangla