আজ ঈদ উল ফিতর, অর্থাৎ মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসের উপবাস শেষ হওয়ার উৎসব। স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বের নানা দেশের মুসলিমদের সাথে ভারতের মুসলিমরাও, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরাও, এই উৎসবে সামিল হয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রতিবারের মতন ঈদের নামাজের, বাচ্চাদের কোলাকুলির, বা হাসি খুশি দাঁড়িয়ে থাকার ছবি ছাপা হবে। তবে যেটা আড়ালে থাকবে সেটা হল ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের যন্ত্রণা ও বঞ্চনার ছবিটি।
ঈদের উপহার স্বরূপ ভারতীয় মুসলিমেরা পেয়েছেন গুজরাটের নারোদা গম গণহত্যায় ৬৭ জন হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী অভিযুক্তের বেকসুর খালাস। তার আগে অবশ্য ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার সময়ে বিলকিস বানো কে গণধর্ষণ করার ও তাঁর পরিবারের শিশু সহ সাত জন কে খুন করার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া ১১ জন কে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বলা হয় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনে এটাই নতুন ‘স্বাভাবিক”।
এ ছাড়াও ভারতীয় মুসলিমেরা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমেরা, ঈদের উপহার স্বরূপ পেয়েছেন রাম নবমী পালনের নামে জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর তরফ থেকে তাঁদের মসজিদ ও ঘরবাড়ির উপর আক্রমণ, আর সন্ত্রাস। নিজের পরিবার কে বাঁচাতে পাথর হাতে রাস্তায় নামা মুসলিমেরা সন্ত্রাসবাদী তকমা পেয়েছেন, এবং হিন্দুত্ববাদের আধুনিক গবেষণাগার হিসাবে পরিচিতি লাভ করা উত্তর প্রদেশে তো তাঁরা সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করা মাত্রই অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন এবং বুলডোজার দিয়ে তাঁদের বাড়ি ভাঙা হয়েছে, তাঁদের অর্থনৈতিক ভাবে নিঃশেষ করা হয়েছে।
একের পর এক রাজ্যে মুসলিমেরা কখনো নামাজ পড়তে গিয়ে, কখনো নিজের পছন্দের পোশাক পরতে গিয়ে, বা কখনো নিজের পছন্দের খাবার খেতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে, এবং সংবাদ মাধ্যম তাঁদের নিন্দা করেছে। কোথাও অবশ্য রাস্তা বন্ধ করে পূজার প্যান্ডেল, জাগরণ মঞ্চ, ইত্যাদি, বানানোর জন্যে কিন্তু একই রকম নিন্দার ঝড় বয়ে যায় না। অবশ্যই দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার দায় সারা ভারতের ক্ষেত্রে ১৪% মুসলিমের, বা পশ্চিমবঙ্গের ৩০% মুসলিমের যাঁদের সরকারি চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব কিন্তু ৬% এর বেশি হয় না কোনো অজ্ঞাত কারণে।
তাই অবশ্যই ঈদের দিন বেঁচে থাকার জন্যে, বা জেলের বাইরে থাকার জন্যে, বা তাঁদের বাড়ি, দোকান আর মসজিদ অক্ষত থাকার জন্যে ভারতের মুসলিমেরা তাঁদের ঈশ্বর কে ধন্যবাদ জানাবেন। অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে দেশের নানা কোনে অনেক হিন্দুরাই মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি যাবেন বিরিয়ানি আর কাবাব খেতে, যদিও অভাগা, হিসাবের বাইরে থাকা বাঙালি মুসলিমের বাড়িতে চালের রুটি, মুরগির ঝোল, সিমাইয়ের পায়েস, বা মেটের ঝোল খাওয়ার কথা কেউই বলবে না। যেমন বলবে না রাজস্থানে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা আফ্রাজুলের বাড়ির ঈদের কথা, বা আসানসোলের ইমাম রাশিদির বাড়িতে ঈদের কথা, যে বাড়ির ১৫ বছরের কিশোর কে খুন করেছিল উন্মুক্ত হিন্দুত্ববাদীরা পাঁচ বছর আগের এক রাম নবমীর মিছিলের সময়। বা বগটুই গ্রামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা গরীব মানুষগুলোর পরিবারের ঈদের কথা।
সঙ্ঘ পরিবারের জঙ্গীরা যখন বুক বাজিয়ে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে, মানুষ খুন করে, তখন অন্তত সবার জানা থাকে তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু যে সব দল সঙ্ঘ পরিবারের মুখে বিরোধিতা করে আর সুযোগ পেলে মুসলিমদের পুড়িয়ে মারে, তারা কিন্তু নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষ কে সেই সুন্দর দেখতে মখমলের মতন ধর্মনিরপেক্ষতার কম্বলে ভাল করে মুড়ে রাখতে পারে। অবশ্য ঈদের দিন এত কথা জিজ্ঞাসা করলেও সমস্যা। হঠাৎ সবাই বলতে পারে, চুপ… বিজেপি চলে আসবে।