গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদের একটি বিশেষ তদন্তকারী দলের (এসআইটি) আদালতে ২১ বছর আগের নারদা গম গণহত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার, ২০শে এপ্রিল, বেকসুর খালাস পেলেন অভিযুক্ত মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গী, জয়দীপ প্যাটেল সহ ৬৭জন অভিযুক্ত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নারোদা গম গণহত্যার অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস হওয়ার ঘটনা একটি নতুন মাত্রা যোগ করল।
২০০২ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, আহমেদাবাদের নারোদা গম অঞ্চলের কুম্ভার ভাস এলাকার মুসলিম মহল্লা বলে পরিচিত একটি বস্তিতে সেখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলিমদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ও ১১ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ওঠে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও তার যুব সংগঠন বজরং দলের বিরুদ্ধে। নারোদা গম থানায় এই ঘটনার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়।
গুজরাটের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী কোদনানি, বজরং দলের বজরঙ্গী ও ভিএইচপির প্যাটেল সহ ৮৬ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় চার্জশিট জমা দেওয়া হলেও, ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল করা হয় ও এক জন কে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে। এদের মধ্যে ৬৫ জন বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির ছিলেন।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৫.৩০ এ যখন এসআইটি আদালতের বিশেষ বিচারক শুভদা বক্সি এই ৬৭ জন নারোদা গম গণহত্যার অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করেন তখন তাঁরা ও বাইরে উপস্থিত তাঁদের সমর্থকেরা “জ্যায় শ্রী রাম” ও “ভারত মাতা কী জ্যায়” ধ্বনি তুলে এই রায় কে স্বাগত জানান। মামলায় সরকার পক্ষের উকিল গৌরাঙ্গ ভ্যাস সংবাদ মাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন যে গুজরাট সরকারের আইন বিভাগ মামলার রায় পড়ে সিদ্ধান্ত নেবে যে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে কিনা।
নারোদা গম গণহত্যার অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস হওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে আবার একটা এমন ঘটনা যোগ করল যার ফলে দেশের ন্যায় ব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্নটি নিয়ে আবার আলোড়ন সৃষ্টি হতে পারে। বিরোধী দলগুলো বিচার ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ নাম না করে অভিযোগ করে থাকে যে বিজেপির শাসনকালে বিচার ব্যবস্থার উপর শাসকদলের প্রভাব বিস্তার হয়েছে ও নানা মামলার রায়ে সেটা প্রতিফলিত হয়েছে। অনেক বিজেপি-বিরোধী দল বিচার ব্যবস্থার নাম না করে অভিযোগ করে যে বর্তমানে একই যাত্রায় পৃথক ফল দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের মামলায়।
উল্লেখ্য, প্রাক্তন বিজেপি মন্ত্রী ও বিধায়ক কোদনানি এর আগে নারোদা পাটিয়া গণহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন। নারোদা গম ও নারোদা পাটিয়া গণহত্যা একই দিনে —২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০০২—অনুষ্ঠিত হয়। নারোদা পাটিয়া গণহত্যায় সরকারি হিসাবে ৯৭ জন মুসলিম নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়, যদিও বেসরকারি হিসাবে শতাধিক মানুষ সেই দিন খুন হন হিন্দুত্ববাদী জঙ্গীদের আক্রমণে।
২০১২ সালে, নারোদা পাটিয়া গণহত্যার ঘটনায় নিম্ন আদালতে কোদনানি আর বজরঙ্গী দোষী সাব্যস্ত হন। তবে এপ্রিল ২০১৮ তে গুজরাট হাই কোর্ট কোদনানি কে নারোদা পাটিয়া গণহত্যার মামলায় বেকসুর খালাস করে, কিন্তু বজরঙ্গী দোষী সাব্যস্ত থাকেন। সেই মামলার শুনানিতে, ২০১৭ সালে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ কোদনানির পক্ষে সাক্ষী দেন এই বলে যে ঘটনার দিন তিনি নাকি বিধানসভায় সেই মহিলা কে দেখেছিলেন।
নারোদা গম গণহত্যায় কোদনানি বেকসুর খালাস হওয়ার পরে তাঁর নামে আর কোনো মামলা রইলো না। এর আগে সাংবাদিক রানা আইয়ুবের স্টিং অপারেশনের ভিত্তিতে লেখা “গুজরাট ফাইলস” বইতে কোদনানির অপরাধের তথ্য তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি হিসাবে নথিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু আদালতে এই সব কথা প্রমাণ হিসাবে যেমন গণ্য হয়নি, তেমনি রাজ্যের বিজেপি সরকারের উকিলেরাও মামলাটিতে অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণ করার কাজে বিশেষ উদ্যোগ দেখাননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০০২ সালের গুজরাটে ঘটে যাওয়া মুসলিম গণহত্যা নিয়ে কয়েক মাস আগে মুক্তি পাওয়া ব্রিটিশ মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমের একটি তথ্য চিত্র, যা আবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর—যিনি এই ঘটনার সময় সেই রাজ্যের নিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন—ভূমিকাকে সমালোচনা করে, ভারতে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও আলোড়ন সৃষ্টি করে।
যখন নারোদা গম গণহত্যার অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস হওয়ার ঘটনা একদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তখন অন্যদিকে গুজরাটের একটি নিম্ন আদালতে ২০১৯ সালের একটি মানহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নিজের সাংসদ পদ খুইয়েছেন কংগ্রেস পার্টির প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী। তিনি সেই রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা আদালতে আপিল করলেও সেই আপিল নাকচ করেছে আদালত। ফলে তাঁর জেলে যাওয়ার রাস্তা যেমন প্রশস্ত হয়েছে তেমনি বিজেপির শাসন আরও পোক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ।
এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০০২ সালের গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার সময় ঘটিত গুলবার্গ সোসাইটির গণহত্যার ঘটনায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ আহসান জাফরির বিধবা স্ত্রী জাকিয়া জাফরির দায়ের করা মামলা খারিজ করার সাথে সাথে মামলাকারীদের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে উল্লেখ করায় এই ঘটনার বিচারের দাবিতে সরব গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যেমন গুজরাটের বিজেপি সরকার পুলিশি দমনপীড়ন শুরু করে, তেমনি সরকার বিলকিস বানো নামক এক মুসলিম মহিলাকে গণধর্ষণ করার ও তাঁর পরিবারের—শিশু সহ—বহু সদস্য কে হত্যার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া ১১ জন কে জেল থেকে মুক্তিও দেয়।
ভারতের বুকে বর্তমান সময়ে চলমান তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণের ধারা কে রুখতে যেমন প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে—এবং এই বিষয়ে তার পরোক্ষ সমর্থন আছে—বলে অভিযোগ উঠেছে, তেমনি বিচার ব্যবস্থার কাছেও আর্জি জানিয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ কোনো ধরনের সাহায্য পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ উঠছে। বর্তমানে এই ঘটনাগুলোর থেকে বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যেমন লাভবান হচ্ছে তেমনি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে অপারগ বিরোধী শক্তির ব্যর্থতার কারনে জনগণের মূল দাবি দাওয়ার লড়াই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থ কে ক্ষুন্ন করছে।