বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি তাঁর মার্কিন সফরের শেষ লগ্নে সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের অভিযোগের প্রশ্নটি খারিজ করে দেন। তিনি জানান যে ভারত বৈচিত্রে ভরা দেশ এবং এখানে সরকার কারুর সাথে বৈষম্য করে না এবং তার প্রমাণ হিসাবে তিনি তুলে ধরেছেন যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সমস্ত জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর লাভ নাকি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সমস্ত গরিব মানুষই পাচ্ছেন।

জয়শঙ্কর ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের অভিযোগটি খারিজ করতে আরও বলেন যে যেহেতু ভারত ঐতিহাসিক ভাবে তর্কশাস্ত্রে বিশ্বাস করে এসেছে তাই এখানকার বৈচিত্রও নানা ধরণের তর্কের জন্ম দেয়, যা নাকি পশ্চিমারা সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য হিসাবে প্রচার করছে। তিনি পশ্চিমাদের স্ববিরোধিতা ও ন্যাক্কারজনক ভূমিকার সমালোচনাও করেন। 

কিন্তু পশ্চিমারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ভারতের সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতায় তিতিবিরক্ত হয়ে, যতই অপপ্রচার করে থাকুক না কেন, মোদী সরকারের আমলে যে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখ সম্প্রদায়, নানা ভাবে নিপীড়িত হচ্ছে সে কথা কিন্তু বলছে দেশেরই মানুষ, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, হাতে গোনা কিছু সংবাদমাধ্যম – যারা এখনো বিকিয়ে যায়নি। জয়শঙ্কর তাঁর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাধ্যকতার কারণে এই ঘটনাগুলো কে যতই অস্বীকার করুন না কেন, তার ফলে সেগুলো বদলে যায় না। 

২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বাধীন চরম দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ইউনিয়নে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে কী ভাবে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ বেড়েছে সেই ফিরিস্তি দিতে গেলে সেই পুরানো কাসুন্দি ঘাটতে হবে। এই তথ্য বিগত নয় বছর ধরে বারবার উল্লেখিত হয়ে আসছে নানা ভাবে, নানা পত্র-পত্রিকা আর ভিডিওয়। সেই তথ্য যে কেউই ইন্টারনেটে দেখতে পারেন। কিন্তু ঘটনা হল যে জয়শঙ্করের যুক্তি কতটা যুৎসই?

ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে কে কি আমরা নস্যাৎ করে দিতে পারি এই বলে যে মোদী সরকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত গরিব মানুষকে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় থেকে বিনামূল্যে রেশনে চাল আর গম দিয়েছে? কোনো বৈষম্য ছাড়া রেশন দিলে কি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে নানা জায়গায় নানা ধরণের ভীতি তৈরি করে তাঁদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে ক্ষেপিয়ে তোলার অনুমতি পাওয়া যায়? সরল করে জানতে চাইলে – বিনামূল্যে রেশন দিলে কি একটি সম্প্রদায়ের আত্মসম্মান কে ভুলন্ঠিত করা যায়? 

জনকল্যাণমূলক প্রকল্পর গল্প

জয়শঙ্কর ফলাও করে যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর কথা ঘোষণা করেছেন তার ফলে দেশের কত মানুষ সত্যিই লাভবান হয়েছেন? মোদী সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রমাগত জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোতে সরকার বরাদ্দ ছেঁটে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতন বিরোধী শাসিত রাজ্যের থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের মতন বিজেপি-শাসিত রাজ্যেও নানা কারণে ১০০-দিনের কাজের মতন প্রকল্পের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে মোদী সরকার। অন্যদিকে, দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মহিলাদের জন্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা উজ্জ্বলা যোজনা, যার মাধ্যমে বিনামূল্যে তাঁদের রান্নার গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়, বিশ বাওঁ পানিতে, কারণ দরিদ্র মহিলারা চড়া হারে বৃদ্ধি পাওয়া রান্নার গ্যাসের দামের ফলে সিলিন্ডার ভরাতে অপারগ হয়েছেন। 

বারবার মোদী ও তাঁর বিজেপির নেতারা কোভিড মহামারীর সময় শুরু করা বিনামূল্যে রেশনের কথা বলে থাকেন। কৃতিত্ব নেন দেশের ৮০ কোটি গরিব মানুষকে বিনামূল্যে চাল-গম দেওয়ার। কিন্তু কেন সেই প্রকল্পে চাল আর গম ছাড়া কিছুই জোটেনি, এবং কী ভাবে গরিব মানুষ মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এই বিনামূল্যের চাল বা গম দিয়ে খাবার বানিয়েছেন সেই নিয়ে কোনো কথা সরকার বলে না। আর এর উপর যে ভাবে রেশন তোলার জন্যে আধার কার্ডের সংযুক্তি ও আঙুলের ছাপ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তাতে যে রেশন থেকেই বহু গরিব মানুষ বঞ্চিত হন সে কথাও সরকার স্বীকার করেনি। 

এ ছাড়াও মুখে গরিব কল্যাণের কথা বলা মোদী সরকারের আমলেই জ্বালানি তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যাপক হারে একদিকে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তেমনি আবার অন্যদিকে বেকারত্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। শহরের বেকারত্বের সাথে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর ব্যাপক বরাদ্দ ছাঁটের কারণে গ্রামীণ বেকারত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামগ্রিক ভাবে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে দেশের গরিবদের যেখানে বিপুল সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেখানে কী ভাবে মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘুরা ভাল থাকতে পারেন?

জনকল্যাণমূলক প্রকল্প কি সরকারের উদারতার প্রতীক?

যে কয়েকটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প মোদী সরকার এখনো চালিয়ে যাচ্ছে তা কি সরকারের উদারতার পরিচয় দিচ্ছে না বাধ্যকতা দেখাচ্ছে? যদি সরকার কোভিড অতিমারীর সময় বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার বন্দোবস্ত না করতো তাহলে কি ব্যাপক হারে ক্ষুধার্থ মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যেতেন না? লকডাউনের ফলে জীবিকা হারানো মানুষ কী ভাবে নিজেদের পরিবারের পাতে খাবার তুলে দিতেন?

বর্তমানে যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো মোদী সরকার চালাচ্ছে সেগুলো মূলত জনগণের দেওয়া করের টাকায় চলছে। এই প্রকল্পগুলো চালানো মোদীর উদারতার নিদর্শন নয় বরং বাধ্যকতা, কারণ ভারতের সংবিধান অনুসারে সরকার যেমন জনকল্যাণের কাজ করবে তেমনি কোনো ভাবেই ভারতের নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারবে না। 

ফলে, যে বৈষম্যহীন সরকারি প্রকল্পের কথা জয়শঙ্কর বললেন, বা বিজেপির অন্যান্য নেতারা বলে থাকেন, তা সংবিধানের কৃতিত্ব, মোদীর নয়। যদি ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কে মোদী সরকার সংবিধান সংশোধন করে সরিয়ে দেয়, যার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে বিজেপি নিয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করে থাকেন, তাহলে কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা, যাঁরা নিজেদের হিন্দু ধর্মের অনুসারী হিসাবে দাবি করেননা, সমস্ত ধরণের সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তখন জয়শঙ্কর কি আবার একই দাবি করতে পারবেন?

বিবিধতা আর বিতর্ক 

জয়শঙ্কর ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের অভিযোগ কে নস্যাৎ করতে দেশের মধ্যে বিবিধতা ও বিতর্কের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু এই বিবিধতা এবং সুস্থ বিতর্ক কি বিজেপি বা তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) মানে? তারা তো নিজেরাই বিবিধতা কে স্বীকার করে না বরং এক ভাষা, হিন্দি, ও এক ধর্মের, হিন্দু, প্রতিপত্তি চায়। তারা ভারতের নানা প্রান্তের বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো কে নির্মূল করে উত্তর ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দু সংস্কৃতিকে সবার উপর চাপিয়ে দিতে চায়। 

তাহলে বিতর্ক বলতে জয়শঙ্কর কী বুঝিয়েছিলেন? তিনি কি বলতে চেয়েছেন যে উত্তর ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দু আচার ও সংস্কৃতি কে সব ধর্ম ও জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিয়ে বিতর্ক চলছে? তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এই নিয়ে চিন্তিত বলেই তাঁরা এই বিষয়ে বিতর্ক করছেন?

জয়শঙ্কর যাই বলার চেষ্টা করুন না কেন, দেশের গত নয় বছরের ঘটনাবলী ইঙ্গিত করছে যে আরএসএস-র আদর্শে দীক্ষিত সমগ্র হিন্দুত্ববাদী শিবির নানা ভাবে, নানা কায়দায় ভারতের বৈচিত্র্য কে, জনগণের বিবিধতা কে ধ্বংস করার প্রয়াস করছে আর এর জন্যে তাদের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে, এবং কখনো শিখদের বিরুদ্ধে, ব্যাপক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কে ক্ষেপিয়ে তুলতে হচ্ছে। ফলে বারবার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন ভারতের সংখ্যালঘুরা।

ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের ঘটনাবলী বিজেপির একমাত্র হাতিয়ার

আগামী দিনে যদি বিজেপি সংখ্যালঘু নিপীড়ন বন্ধ করার চেষ্টা করে, যদি তারা মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখদের বিরুদ্ধে নানা কায়দায় হিন্দুদের তাঁতিয়ে তুলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভোটের মেরুকরণ না করে, তাহলে কি দলটি নির্বাচনে শুধু “উন্নয়ন” আর “জনকল্যাণমূলক প্রকল্পর” কথা বলে জিততে পারবে? তাহলে জয়শঙ্কর নিজে কি আবার মন্ত্রী হতে পারবেন? বিজেপি কি কোনোদিনই ইসলামবিদ্বেষ, খ্রিস্টানবিদ্বেষ বাদ দিয়ে নিজের কাজের হিসাব দিয়ে ভোটে লড়তে পারবে?

কিছুদিন আগেই তাঁর সরকারের এক সাংসদ সংসদ ভবনের ভিতরেই আলোচনা চলার সময় এক মুসলিম সাংসদ কে বিদ্বেষমূলক কটূক্তি করেন ধর্ম তুলে। সেই ঘটনা নিয়ে যদিও বিজেপি বিড়ম্বনায় পড়ে, কিন্তু সেই সাংসদ কে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে পার্টি জানান দেয় যে তাঁর বক্তব্যে দলের সায় আছে। জয়শঙ্কর কি সেকথা ভুলে গেছেন নাকি মার্কিন মুলুকে সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন এই প্রবীণ কূটনীতিবিদ?

জয়শঙ্কর নিজেও জানেন যে এই কাজ সম্ভব নয়। তিনি জানেন যে তাঁর দল সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি না করে কোনোদিনই রাজনীতির আঙিনায় টিকে থাকতে পারবে না। তিনি জানেন যে মোদীর ভোটব্যাঙ্ক বলতে যেটা রয়েছে সেটা হল চরম ইসলামবিদ্বেষী ভোটব্যাঙ্ক, তাই একান্ত না চাইলেও বিজেপিকে এই ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতে ঘৃণার ফসল ফলাতেই হবে, বৈষম্যের রাজনীতি করতেই হবে। তাই তিনি গোল-গোল আলোচনা করে মূল প্রশ্নটির থেকে, অর্থাৎ ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতনের ঘটনার থেকে, দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

এই প্রবন্ধটি কি আপনার ভাল লেগেছে?

তাহলে মাত্র ৫০০ ভারতীয় টাকার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্য মতন এই ব্লগটি কে সহযোগিতা করুন

যেহেতু আমরা FCRA-তে পঞ্জীকৃত নই, অতএব ভারতের বাইরের থেকে সহযোগিতা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

CAPTCHA


পিপলস রিভিউ বাংলা