সুপ্রিম কোর্টে অসমে বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার যে ব্যবস্থা নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারায় রয়েছে সেটার বৈধতা নিয়ে মামলার শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত এমন অনেক তথ্য চেয়েছে যা শাসক বিজেপিকে বিপদে ফেলতে পারে।
ভারতের আইনে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো বাধ্যকতা না থাকলেও কেন নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারায় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১লা জানুয়ারি ১৯৬৬ থেকে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত অসমে প্রবেশ করা বাংলা-ভাষী শরণার্থীদের জন্যে নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেই প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসম ও উত্তর পূর্বের অন্যান্য রাজ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক চলমান, এবার নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারা কে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট যে প্রশ্নগুলো তুললো তাতে পশ্চিমবঙ্গে আসা বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব কেন দেওয়া হয়নি সে কথাও উঠলো, আর এখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারের মুখোশ খুলে পড়ার ঘটনা হয়তো ঘটতে চলেছে।
বৃহস্পতিবার, ৭ই ডিসেম্বর, অসম চুক্তি অনুসারে ৬(ক) ধারা নাগরিকত্ব আইনের অংশ হওয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার শুনানি চলছিল প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়-র নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে। এই শুনানির সময়ে বেঞ্চ ইউনিয়ন সরকারের কাছে অসমে ৬ক(২) ধারায় কতজন উদ্বাস্তু বাঙালি নাগরিকত্ব পেয়েছেন সে তথ্য চেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব নিয়ে বা আইনি ভাবে শরণার্থী আর বেআইনি অভিবাসীদের তথ্য প্রকাশ্যে আনেনি ইউনিয়ন সরকার।
এর মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ও অপামর বাঙালি নমঃশূদ্র সম্প্রদায় কে ঠকাতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদের দুই কক্ষে পাশ করায় নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯)। একদিকে এই আইনের ফলে মুসলিমরা দেশজোড়া জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এনআরসি) তৈরির সময় বাদ যাবেন আর হিন্দুরা নাগরিকত্ব রক্ষা করতে পারবে, এই রকম বিভ্রান্তিকর প্রচার চালিয়ে যেমন মুসলিমদের ভীত করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে অন্যদিকে এই আইনে নাগরিকত্বের টোপ খুড়োর কলের মতন মতুয়া ও অন্যান্য নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের সামনে ঝুলিয়ে তাঁদের বিভ্রান্ত করে নিজের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াস করে বিজেপি।
অথচ এই আইনে সর্বোচ্চ ৩১,৩১৩ জন বৈধ ভাবে শরণার্থী ছাড়া আর কারোরই নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সে কথা কিন্তু ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) প্রতিনিধি যৌথ সংসদীয় দলকে জানিয়েছিলেন। আর এর ফলেই এই আইন পাশ করার চার বছর পরেও এর কোনো নিয়মাবলী ইউনিয়ন সরকার বের করেনি, ফলে মতুয়াদের মধ্যেও বিজেপির প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে, যদিও তা ঠেকা দিতে ইউনিয়নের জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর মতুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করার হাস্যকর যুক্তি দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টে অসম চুক্তি অনুযায়ী ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারা নিয়ে যে মামলা হয়েছে তাতে অভিযোগ করা হয়েছে যে শুধু অসমের ক্ষেত্রেই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা আইনে আছে, অথচ সেই দিক থেকে দেখতে গেলে অসমের চেয়েও বেশি―ইউনিয়ন সরকারের হিসাব অনুসারে―শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করলেও তাঁদের নাগরিকত্বের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
তেমনি রোহিঙ্গা, তামিল, তিব্বতী, চাকমা, প্রভৃতি শরণার্থীদের আইনি স্বীকৃতি থাকলেও যেহেতু নাগরিকত্বের কোনো সুযোগ নেই বর্তমান নাগরিকত্ব আইনে তাই ৬(ক) ধারাও কোনো ভাবেই প্রয়োজন নয় বলে দাবি করা হয়েছে।
এবার প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ যেহেতু ইউনিয়ন সরকারের কাছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে ও পরবর্তী কালে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী আর অভিবাসীদের তথ্য চেয়েছে, তাই যে ভাবে আইবি আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আইনি ভাবে শরণার্থী হয়ে ভারতে এসে বসবাস করা লোকেদের সংখ্যা গোপন করে এসেছে বিজেপির স্বার্থে, সেই দেওয়াল ভাঙতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এই ভাবে দেখতে গেলেই বোঝা যাবে যে বিতর্কিত সিএএ ২০১৯ অনুসারে―বা আইনটিকে বাদ দিলেও―এনআরসি থেকে রক্ষা পাবেন হাতে গোনা কিছু বাঙালি উদ্বাস্তু, বাকিদের ভাগ্যে ঝুলছে বেনাগরিক হওয়ার কোপ, যা অসম এনআরসি দেখিয়েছে।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন কোনো ভাবেই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ওকালতি করেনি, করেও না। বরং নিঃশর্ত জন্মগত ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা ধরণের বাঁধা সৃষ্টি করেছে ভিটে মাটি খুইয়ে দেশ ভাগের ফলে ভারতে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্যে। যদিও এই দেশে এসে অসংখ্য উদ্বাস্তু রেশন কার্ড-ভোটার কার্ড প্রভৃতি জোগাড় করে ফেলেছেন, তবুও তাঁরা বৈধ নাগরিক যেহেতু নন, যেহেতু তাঁরা ১৯৫০ সালের নাগরিকত্ব আইনের বা তার পরবর্তী সংশোধনের শর্ত পূরণ করেন না, তাই এই সব কাগজপত্র থাকলেও এনআরসিতে ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের আগের কাগজ না দেখাতে পারায় তাঁদের ঠাঁই হবে বেনাগরিকদের তালিকায়, যাঁদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে কর্পোরেটদের উপঢৌকন দিতে চায় মোদী সরকার।
আর যদি আইবি-র তথ্য থেকে, সরকারের হলফনামা থেকে আইনি ভাবে স্বীকৃত বাঙালি শরণার্থীদের সংখ্যা জানা যায়, তাহলে সেটা বিজেপির স্বরূপ উন্মোচন করতে ও আপামর মতুয়া ও নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের কাছে সিএএ ২০১৯ এর ভাওতাবাজি তুলে ধরতেও সাহায্য করবে, যা অবশ্যই বিজেপি চাইবে না।
এর মধ্যে আবার সর্বোচ্চ আদালতের সংবিধানিক বেঞ্চের সামনে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাঙালি শরণার্থী, যাঁদের সিংহভাগই বেআইনি অভিবাসী হিসাবে নাগরিকত্ব আইনের ২০০৩ সালের সংশোধনীর পরে চিহ্নিত হয়েছেন, বনাম রোহিঙ্গা, তামিল, তিব্বতী বা চাকমা শরণার্থীদের, সেখানেও একটা বড় গলদ রয়েছে যা কিন্তু বাঙালি উদ্বাস্তুদের আরও বড় বিপদে ফেলতে পারে।
জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে যদি অন্য জাতির শরণার্থীরা নাগরিকত্ব না পান, তাহলে বাঙালিরা কেন পাবেন। সে ক্ষেত্রে যেটা সব চেয়ে আগে বিবেচনা করা দরকার তা হল চাকমা আর বাঙালি বাদে আর কোন জাতি দেশ ভাগের ফলে বিস্থাপিত হয়েছেন আর নাগরিকত্ব পাননি। এমনকি জম্মুতে, দিল্লীতে ও অন্য নানা শহরে আসা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, প্রভৃতি জাতির উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু ঝুলে রয়েছে বাঙালিদের নাগরিকত্বের বিষয়টি। তার কারণ এদের সংখ্যা বেশি এবং এটি একটি ক্রমাগত চলমান প্রক্রিয়া যা বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি।
তা ছাড়াও, সেই আইনে অসমে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ এর পরে আসা কোনো বাঙালির নাগরিকত্ব বা ভোটাধিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। যদিও মূল অসম চুক্তির সাথে, সময়ের হিসাবে এই আইনের অনেক অসঙ্গতি আছে।
আগামী দিনে যে ইউনিয়ন সরকার নানা কায়দায় বাঙালি উদ্বাস্তুদের বেকায়দায় ফেলবার তোড়জোড় করছে সেটা সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দাদের যে ভাবে নিয়মিত ভাবে রাষ্ট্রীয় হয়রানির শিকার হতে হয় সেটা দেখেই বোঝা যায়। তবে এখনো নাগরিকত্বের আশায় যাঁরা বিজেপির মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছেন তাঁদের অবস্থা যে অসমের লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দুদের এনআরসি-র ফলে হয়েছে, সেই পরিণাম হবে সেটা আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার আর নেই। এবার সুপ্রিম কোর্ট যদি ৬(ক) ধারা কে বেআইনি ঘোষণা করে, তাহলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুরা আবার ভিটে মাটি থেকে উৎপাটিত হবেন, যা আবার বিজেপির জন্যে বিপদজনক হতে পারে।