প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার সংসদে ব্যাপক হট্টগোলের মধ্যে নির্বাচনী সংস্কার সংক্রান্ত আইন পাশ করিয়ে নিল। সোমবার, ২০শে ডিসেম্বর আধার আর ভোটার কার্ড লিঙ্কের ভিত্তি স্থাপনকারী এই আইনের ফলে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) তৈরি করা আরও সহজ হয়ে যাবে। অথচ এই এনপিআর আর এনআরসি নিয়ে একটিও কথা খরচ না করে ভারতের মূলস্রোতের সংসদীয় দলগুলো “বেনাগরিকরা” ভোট দিতে পারবে বলে রব তুলে জাতি দাঙ্গা উস্কানোর কাজে মোদী সরকার কে সাহায্য করছে। ফলে, মোদী সরকারের কাছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ ২০১৯), কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মতন একটি সুযোগ তৈরি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করার ও উদ্বাস্তুদের বোকা বানানোর।
মোদী সরকার বহুদিন ধরে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ (সিএএ ২০০৩) এর ১৪(ক) ধারা অনুসারে এনআরসি করে কোটি কোটি মানুষ কে বেনাগরিক করতে চায়। এই প্রবন্ধে আমরা দেখিয়েছি কেন ভারতে বসবাস করা কোটি কোটি গরিব মানুষ, যাঁদের কাছে ভারতের সংবিধানের ধারা ৬(খ) অনুযায়ী ১৯শে জুলাই ১৯৪৮ এর আগের কোনো কাগজ নেই বা ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১লা জুলাই ১৯৮৭ এর মধ্যে ভারতে জন্মের প্রমাণপত্র নেই, কেন এনআরসি অভিযানের শিকার হবেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।
এই সিএএ ২০০৩ এর নিয়মাবলী—নাগরিকত্ব নিয়মাবলী ২০০৩—অনুসারে এনআরসি করার প্রথম ধাপ হল এনপিআর তৈরি করা যা দেশে বসবাসকারীরা কে কোথায় থাকেন, কী করেন, প্রভৃতির তথ্যভান্ডার তৈরি করবে। বর্তমানে এই তথ্য আধারের মাধ্যমে সরকারের ঘরে মজুত থাকলেও সেই তথ্য যাচাই করা হয়নি। সেই তথ্য জনগণনার সময় আদমশুমারির সময়ে যাচাই করা হবে।
আঙুলের ছাপ আর চোখের মণির ছাপ নিয়ে তৈরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় নজরদারির প্রকল্প হল আধার। এই আধারের সাথে ভোটারদের তথ্য যোগ করার ফলে সরকারের হাতে প্রতিটি ভোটারের বংশ তালিকা চলে আসবে। তার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার সহজেই ১৯৫১ সালের ভোটার তালিকা, যার থেকে তৎকালীন সময়ে প্রায় ২৮ লক্ষ মানুষের, বিশেষ করে মহিলাদের, নাম বাদ গিয়েছিল, মিলিয়ে দেখবে কে ভারতের নাগরিকত্বের জন্যে যোগ্য। এই কারণেই ভারত সরকার কয়েক বছর আগে ১৯৫১ সালের ভোটার তালিকা পুনরায় প্রকাশ করেছে।
দ্য ওয়্যার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই খবরে জানা যাচ্ছে যে ১৯৬১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতে প্রায় চার কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এই জনসংখ্যার ৪০% হল আদিবাসী জনগণ, যাঁরা ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা হলেও তাঁদের কাছে ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই এর আগে ভারতে থাকার বা জমির মালিকানার কোনো দলিল নেই। তাঁদের পূর্বপুরুষদের নাম যদিও বা ১৯৫১ সালের ভোটার তালিকায় থেকে থাকে, তা সত্ত্বেও ছিন্নমূল হওয়ার কারণে তাঁদের পক্ষে তাঁদের বংশের ভারতের নাগরিক হওয়ার প্রমাণ দেওয়া কঠিন। ২০১৯ সালেই ভারতে ৫০ লক্ষের উপর মানুষ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আর না হয় হিংসার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এহেন বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্রে বাস করা মানুষেরা এনপিআর হলে চরম সমস্যায় পড়বেন।
এ ছাড়াও কোটি কোটি বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের থেকে বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে দেশভাগের শিকার হয়ে ভারতে এসে বসবাস করলেও তাঁদের বেশির ভাগ মানুষই কোনোদিনই আঞ্চলিক বিদেশী পঞ্জীকরণ দফতর (এফআরআরও) থেকে ভারতে থাকার জন্যে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নেননি। ফলে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে আসলেও বিদেশী নিয়মাবলী, ১৯৪৮, ও পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) নিয়মাবলী, ১৯৫০, এর ২০১৫ ও ২০১৬-র সংশোধনীতে তাঁরা ছাড় পাননি। ফলে মোদীর আনা ও বর্তমানে ঠান্ডা ঘরে রাখা সিএএ ২০১৯ অনুযায়ী যে ৩১,৩১৩ জন ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারবেন, তাঁদের মধ্যে এদের কেউই প্রায় নেই।
এহেন অবস্থায় আধার আর ভোটার কার্ড লিঙ্কের ফলে এই রকম অসংখ্য মানুষ এনপিআর তালিকায় “সন্দেহজনক” হয়ে যাবেন, সিএএ ২০০৩ অনুসারে, এবং এনআরসি তালিকায় তাঁদের ঠাঁই হবে না। আর আধার আর ভোটার কার্ড লিঙ্কের সাহায্যে মোদী সরকার অসম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, প্রভৃতি রাজ্যের ভোটার তালিকার থেকে সহজেই “সন্দেহজনক ভোটার” বা ডি-ভোটার তকমা দিয়ে কোটি কোটি মানুষ কে ছেঁটে ফেলতে পারবে।
এর ফলে শাসক বিজেপির প্রভুত সুবিধা হবে, কারণ যাঁদের ছেঁটে ফেলা হবে তাঁদের বেশির ভাগই হবেন হয় দলিত না হয় আদিবাসী, যাঁদের খুব সহজেই সস্তা, অধিকারহীন, দরদামের ক্ষমতাহীন, দাস শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা যাবে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থে। এর ফলে মোদীর বিজেপি কর্পোরেট সংস্থাগুলোর থেকে আরও বেশি অনুদানও পাবে।
এনআরসি হল মোদী সরকারের আর বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। আধার আর ভোটার কার্ড লিঙ্কের মাধ্যমে সেই কাজই এগিয়ে নিয়ে যেতে চলেছে মোদী সরকার। ২০২২ সালে ডিজিট্যাল জনগণনা শুরু হচ্ছে আর তার সাথেই হবে এনপিআর যাচাই এর কাজ। একবার এনপিআর যাচাই হয়ে গেলে এনআরসি শুধুই সময়ের অপেক্ষা। মোদী সরকার ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচনের আগেই এই এনপিআর তৈরি করে এনআরসি-র ভিত্তি প্রস্তুত করে রাখতে চায়।
এহেন অবস্থায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সিএএ ২০১৯ আর এনআরসি নিয়ে, সংবিধান বাঁচানোর নামে, যে বিরোধীরা আর আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমেছিলেন, যাঁরা এনআরসি কে শুধুই মুসলিম-বিরোধী হিসাবে দেখিয়ে ব্যাপক দলিত ও আদিবাসীদের এবং বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের মনে বিজেপি তাঁদের বাঁচাবে এই ধারণা ঢুকিয়েছিলেন, আজ যখন এনপিআর দুয়ারে, তখন পথে ঘাটে কোথাও তাঁদের দেখা নেই। কোনো আন্দোলনও নেই। তাঁরা যদি এই আধার আর ভোটার লিঙ্কের বিরোধিতা করছে শুধু মাত্র ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার হবে বলে। যখন একটি মানুষ নাগরিকই থাকবে না তখন তার ব্যক্তিগত তথ্যের উপর কী অধিকারই বা থাকবে?
এই বিপদের মুহূর্তে, আধার আর ভোটার কার্ড লিঙ্কের বিরুদ্ধে যদি জনমত গড়ে প্রত্যেক ভারতবাসীর নাগরিকত্বের অধিকার নিঃশর্ত ভাবে সুনিশ্চিত করার দাবি তুলে আন্দোলন না করা হয়, যদি সর্বনাশা সিএএ ২০০৩ বিরোধী আন্দোলন না গড়া হয়, তাহলে কোটি কোটি গরিব মানুষ কে বৃহৎ কর্পোরেটদের দাস শ্রমিকে পরিণত হওয়া কে আটকানো যাবে না। কিন্তু যাদের এই কাজ করার কথা, তাঁরা কোথায়?