গত ১৭ থেকে ১৯শে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত হল ধর্ম সংসদ। পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কুখ্যাত দাঙ্গাবাজ য়েতি নরসিংহানন্দ সরস্বতী ওরফে দীপক ত্যাগী ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে কয়েকশো গেরুয়া বসনধারী স্বঘোষিত ধর্মগুরু নামক ব্যবসায়ীরা যোগ দেন এবং ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেন।
“ইসলামী ভারতে সনাতনের ভবিষ্যত: সমস্যা ও সমাধান” কে বিষয় হিসাবে তুলে ধরে এই “ধর্ম সংসদ” ডাকা হয়, যার থেকে ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেন নানা কুখ্যাত প্রতিনিধিরা। যেহেতু হরিদ্বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনাধীন, তাই আইনের ফাঁপরে পড়বেন না জেনেই এই সম্মেলন সেখানে অনুষ্ঠিত হয় ও খোলাখুলি সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হিংসার প্ররোচনা দেওয়া হয়।
বিষয়বস্তুর থেকেই স্পষ্ট যে উদ্যোক্তরা দাবি করেছেন যে ভারত একটি ইসলামী দেশ হয়ে গেছে বা হতে চলেছে, যা বিজেপির ও তার পিতৃ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) ভারতের মতন হিন্দু প্রধান দেশে “হিন্দু খাত্রে মে হ্যায়” বা হিন্দুরা আক্রান্ত, এই রাজনৈতিক লাইন কে স্থাপন করতে চেয়েছেন।
খবরে প্রকাশ, য়েতি ছাড়াও এই ধর্ম সংসদে যোগ দেন হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদিকা পূজা শকুন পাণ্ডে, যিনি আবার সাধ্বী অন্নপূর্ণা মা বলে নিজের পরিচয় দেন এবং নিরঞ্জনী আখড়ার তিনি মহামন্ডলেশ্বরী। এ ছাড়াও যোগ দেন হিন্দু রক্ষা বাহিনীর প্রধান স্বামী প্রবধানন্দ মহারাজ, সাগর সিন্ধু মহারাজ, প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট প্রচারকরা।
হরিদ্বারের “ধর্ম সংসদে” য়েতি বলেন যে হিন্দু শ্রীলঙ্কার তামিল গেরিলা নেতা প্রভাকারণ বা শিখ খালিস্তানি জঙ্গী নেতা ভিন্দ্রেলওয়ালে বা শাবেগ সিংহের মতন আত্মহুতি দিতে পারবেন, তাকে তিনি ₹১ কোটি উপহার দেবেন। তিনি বলেন যে তলোয়ার খেলা মঞ্চেই ভাল লাগে আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে জিততে গেলে অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে।
য়েতি ভারতের রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য “সত্যমেভ জয়তে” কে নিজের মতন করে সাজিয়ে স্লোগান দেন “শস্ত্র মেভ জয়তে”, অর্থাৎ অস্ত্রেরই শেষ পর্যন্ত জয় হবে। তবে এই অস্ত্রের জয়জয়কার শুধুই য়েতি নয়, অন্যান্যরাও করেন। যেমন পাণ্ডে বা প্রবধানন্দ হিন্দু সম্প্রদায় কে সশস্ত্র হওয়ার ডাক দেন। ডাক দেন মুসলিম গণহত্যার আর ভারতবর্ষে এক হার্মাদ বাহিনী গড়ারও ডাক দেন।
আজ প্রায় এক মাস হতে চললেও এই ধরনের গণহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার ঘটনা ঘটে গেলেও বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের পুলিশ আজ অবধি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এই তথাকথিত ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে। বরং বহাল তবিয়তে য়েতি, পাণ্ডে, প্রভৃতি, আসন্ন উত্তর প্রদেশ আর উত্তরাখণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কে মদদ করতে একের পর এক এই রকম ধর্ম সংসদ করে চলেছে। আগামী দিনেও উত্তর প্রদেশের আলীগড় সহ নানা জায়গায় এই রকম ধর্ম সংসদ করে ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়া হবে বলে আরএসএস-আশ্রিত এই দুষ্কৃতীরা জানিয়েছে।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বরিষ্ঠ আইনজীবী ও কংগ্রেস দলের নেতা কপিল সিবাল ও আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ একটি যাচিকা দায়ের করেন এই ধর্ম সংসদ গুলোর থেকে ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে। জানা গেছে যে ভারতের প্রধান বিচারপতি নাকি জানিয়েছেন যে সর্বোচ্চ আদালত কিছুদিনের মধ্যেই এই মামলার শুনানি শুরু করবে। তবে এই মামলা কে প্রধান বিচারপতি আবার বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানো নিয়ে চলমান আরও একটি মামলার সাথে জুড়েও দিতে পারেন। তার ফলে কিন্তু এই অপরাধের গুরুত্ব অনেক কমে যাবে।
জয়সিংহ শুনানির সময়ে আদালত কে জানিয়েছেন যে সাধারণ বিদ্বেষমূলক ভাষণ আর এই ধর্ম সংসদ থেকে ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কারণ এখানে শুধু মাত্র একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়নি, সেই সম্প্রদায়ের সকল সদস্য কে হত্যা করার ডাক দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর ফলে এটি শুধুই বিদ্বেষমূলক একটি ভাষণের ঘটনা নয়, বরং আরও ভয়ানক একটি ব্যাপার, দেশে আইনের শাসন কে এই ধর্ম সংসদ সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কে ধ্বংস করার চেষ্টা যেমন করেছে তেমনি সংবিধানের শাসন উচ্ছেদ করে দেশে ব্রাক্ষণ জাতির ধনিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে।
ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক কিন্তু শুধু এই ধর্ম সংসদেই দেওয়া হয়নি, নিত্যদিন, নানা কায়দায়, বিজেপির পিতৃ প্রতিম সংগঠন আরএসএস কিন্তু গোটা ভারতেই গোঁড়া হিন্দুদের মুসলিম গণহত্যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁতিয়ে তুলছে। মুসলিম গণহত্যার ডাক দিলেই এই দেশে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করা সম্ভব ও অতি সহজেই নির্বাচন জেতা সম্ভব। বর্তমানে উত্তর প্রদেশ আর উত্তরাখণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির ডুবন্ত জাহাজ থেকে এমনিই লাফিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে বহুজন সমাজ পার্টি আর সমাজবাদী পার্টির থেকে ডিগবাজি খেয়ে ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগে। তাই এই বিজেপির আজ আবার ধর্ম সংসদ চাই, মুসলিম নিধন যজ্ঞের ডাক চাই, মানুষের মধ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রবাহ বয়ে যাওয়া চাই।
যেহেতু মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ালে ভোট পাওয়া যায়। তাই তো এই ধর্ম সংসদের সাথে সাথেই উঠে এসেছে ছত্তিশগড়ে অনুষ্ঠিত অন্য একটি ধর্ম সংসদের কথা যার সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত আছে কংগ্রেস দলের নাম। এই সংসদ থেকেও একের পর এক বক্তা শ্রোতাদের মুসলিম আর খ্রিস্টান নিধনের ডাক দেন, কংগ্রেস নেতাদের সামনেই। কিন্তু মামলা হয় কালী চরণ মহারাজের নামে, মোহনদাস গান্ধীর হত্যার সমর্থন করার জন্যে, ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়ার জন্যে নয়।
অতএব, শুধু মাত্র বিজেপি না, এই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর কাজের সাথে মোটামুটি ভাবে সব সংসদীয় দলই কমবেশি জড়িত। যাঁরা মুখে মুসলিম গণহত্যার ডাক দিচ্ছেন না, তাঁরাও চাদরের তলায় হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ কে প্রচ্ছন্ন মদদ দিচ্ছেন, তাঁরাও বারবার হিন্দু প্রেমী সেজে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে।
ফলে, আজ উত্তর প্রদেশের বহুজন আন্দোলনের স্বঘোষিত নেত্রী ও বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) সুপ্রিমো মায়াবতীর নির্বাচনী সভায় অযোধ্যার বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী আরএসএস যে রাম মন্দির গড়ছে, তার কাজ কে ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, ব্রাক্ষণদের স্বার্থ রক্ষার ডাক দেওয়া হচ্ছে আর “জয় শ্রী রাম” স্লোগান তোলা হচ্ছে। তাই আজ সমাজবাদী পার্টি (এসপি) নেতা অখিলেশ যাদব বলছেন “রাম রাজত্ব” নাকি তাঁর পার্টির অধীনে স্থাপিত সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই আসতে পারে। আম আদমী পার্টি (আপ) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন যে তিনি একজন “হিন্দু” তাই তিনি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে যে রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে তাতে যেতে কুণ্ঠা বোধ করেন না।
ভারতের এহেন সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো যখন জনগণের সাথে এই ভাবে ধর্মের নাম দিয়ে প্রতারণা করে, যখন সেই দলের নেতারা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে, তখন তো আরএসএস দ্বারা লালিত-পালিত দুষ্কৃতীরা সন্ন্যাসী সেজে “ধর্ম সংসদ” করার নামে বিজেপির স্বার্থে ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেবেই। আর ভারতের যে বিচার ব্যবস্থা খোলাখুলি ভাবেই বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানোর আরএসএস এর পরিকল্পনায় আইনী সিলমোহর লাগায়, আর তার পরে সেই সব বিচারপতিরা বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেলে গিয়ে “আদালতের রায়” উদযাপন করেন, সেখান থেকে যে এই গণহত্যার ডাক দেওয়া রুখতে কোনো বিহিত করা হবে না তা আন্দাজ করতে কাউকেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হয় না।
ভারতের মাটির ভিতর গভীরে শিকড় গেড়ে বসে থাকা সামন্তবাদী ব্যবস্থার সামাজিক ভিত্তি হল জাতি ব্যবস্থা। এই জাতি ব্যবস্থা কে টিকিয়ে রাখা ও শক্তিশালী করা হল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কাজ। ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দিয়ে যে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করার ডাক দেওয়া হচ্ছে, সেই হিন্দু রাষ্ট্রে, নর্দমা পরিষ্কার করা শম্ভু হেলা বা কারখানায় রক্ত ঘাম এক করা লোকনাথ পাসওয়ান আর গৌতম আদানী বা মুকেশ আম্বানি আইনের চোখে বা সমাজের চোখে এক হবেন না। সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বর্তমানের মতনই এই নির্যাতিত, বঞ্চিত ও শোষিত ৮০% দলিত, আদিবাসী আর অনগ্রসর জাতির জনগণের কোনো অধিকার বা ক্ষমতা থাকবে না। শুধু সামন্ত শ্রেণী আর মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের, যাঁদের প্রত্যেকেই উচ্চ জাতির হিন্দু, হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকবে।
তাই হিন্দু রাষ্ট্র যে তাঁর স্বার্থের পরিপন্থী, হিন্দু রাষ্ট্র যে তাঁর মুখে খাবার, পরনের কাপড়, মাথার উপর ছাদ, সন্তানদের শিক্ষা, পরিবারের স্বাস্থ্য, প্রভৃতির কোনো নিশ্চয়তাই তাঁদের দেবে না, এই কথা ভারতের শোষিত ও বঞ্চিত দলিত, আদিবাসী আর অনগ্রসর জাতির মানুষদের, যাঁদের বেশিরভাগ কৃষক, শ্রমিক বা মেহনতি জনগণ, বোঝানো আজ দরকার। শুধুই আরএসএস আর বিজেপিকে মুসলিম-বিরোধী বললেই সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁদের ধর্মীয় মতান্ধতার কারণেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করবেন না। তাঁরা বিরোধিতা করবেন, আর হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ কে নিশ্চিহ্ন করবেন, তখনই যখন তাঁরা বুঝবেন যে এই গেরুয়া শিবির আসলে ব্যাপক হিন্দু সমাজের শত্রু, দলিত, আদিবাসী আর অনগ্রসর শ্রেণীর জনগণের শত্রু।
শুধু মাত্র যেদিন এই সংখ্যাগুরু দলিত, আদিবাসী আর অনগ্রসর শ্রেণীর খেটে খাওয়া জনগণ, যাঁদের আরএসএস আর বিজেপি মুসলিম নিধন যজ্ঞে পদাতিক বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতিগত আর আর্থিক প্রতিপত্তি কে কাজে লাগিয়ে, জেগে উঠবেন গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে, যখন তাঁরা ব্রাক্ষণত্ববাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবেন, তখনই সম্ভব ভারতে মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়া এই ধর্ম সংসদের পান্ডাদের রাজত্ব শেষ করা।