প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বর্তমানে চাপে পড়েছেন। একদিকে যখন তিনি আডলফ হিটলারের স্বপ্নের রাজধানী “জার্মেনিয়া”-র আদলে তৈরী নয়া দিল্লীর ভিতর এক নতুন রাজধানী ——সেন্ট্রাল ভিস্টা——বানাচ্ছেন ৩০,০০০ কোটি টাকা খরচ করে তখন অন্যদিকে দেশের মানুষ, তাও আবার তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি-র (বিজেপি) শাসনাধীন উত্তরপ্রদেশের মানুষ, মোদীর উত্তরসূরী হিসাবে চিহ্নিত যোগী আদিত্যনাথ ওরফে অজয় সিংহ বিশ্ত-শাসিত উত্তরপ্রদেশের মানুষ, সৎকারের খরচ বহন করতে অপারগ হওয়ায় গঙ্গায় তাঁদের পরিজনদের দেহ ভাসিয়ে দিচ্ছেন, জঙ্গলে ছেড়ে যাচ্ছেন আর নদীর ধারে পুঁতে দিচ্ছেন। তাও যদি কোন বিরোধী-শাসিত রাজ্যে এই ঘটনা ঘটতো তাহলে বিজেপি ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে সেই রাজ্যের সরকার কে তুলোধুনো করতো। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ! এ তো স্বর্গে বিশৃঙ্খলা। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে এসে এই উত্তরপ্রদেশ মডেলের মাধ্যমে “সুনার বাংলা” গড়ার কথা বলেছিলেন বিশ্ত, মোদীও বলেছেন, তাহলে এখন এই কাণ্ডে তো সত্যিই সরকারের চাপে পড়া হয়।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায়, বিনা অক্সিজেনে, না খেয়ে, পিপাসিত হয়ে হাসপাতালে গড়ে কয়েক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। এর মধ্যে ধরা পড়েছে যে মোদীর রাজ্য গুজরাট, যা আগে মডেল রাজ্য ছিল আর যে মডেলের কথা বিজেপি আজ আর ভুলেও বলে না, সেই রাজ্যে নাকি মৃত্যুর ঘটনা চেপে যাওয়া হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ জুড়ে যোগী ওরফে বিশ্ত হুকুম দিয়েছেন যে কেউ যদি সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেন যে অক্সিজেন বা হাসপাতালের বেডের যোগান নেই, তাহলে তাঁর সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে। অন্যদিকে যাঁদের বাড়িতে চিকিৎসা চলছে তাঁরা হন্যে হয়ে অক্সিজেন জোগাড় করার জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে জেলা শাসকের থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে। আর জেলা শাসকেরা নিজের জেলায় অকালের ছবি না দেখাতে যেহেতু বদ্ধপরিকর তাই তাঁরা এক আধজন কে বাদ দিয়ে, অর্থাৎ সাবর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্তদের একাংশ কে ছাড়া, আর কাউকেই অনুমতি দিচ্ছেন না। ফলে মানুষ শুধু নিশ্বাস না নিতে পারার জন্যে মারা যাচ্ছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে মোদী পড়েছেন চাপে। সত্যিই তো এখন তাঁর কাছে জুলাই অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া কোন রাস্তা নেই। জুলাই মাসে আশা করা হচ্ছে এই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ স্তিমিত হয়ে উঠবে আর শয়ে-শয়ে দেহ দাহ করার দৃশ্যও বিরল হয়ে যাবে। আবার সব কিছু নাকি “স্বাভাবিক” হয়ে যাবে আর ঠিক তখনই হয়তো পাকিস্তান বা চীনের সাথে একটা সীমান্ত সংঘর্ষ, বা পুলওয়ামা কায়দার কোন জঙ্গী হানা, বা বালাকোটের তথাকথিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” এর মতন কোন উত্তেজক দৃশ্য বা কোন মুসলিম নিধন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত করে মোদী আবার তাঁর ভক্তদের ও ভোটারদের স্বজন হারানোর স্মৃতি ভুলিয়ে দেবেন। তাঁরা আবার সোচ্চার হবে যে “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়” (মোদী আছে তাই সম্ভব) বলে। আবার মানুষ জীবনধারায় ব্যস্ত হয়ে যাবেন। আর থেকে যাবে ছবিগুলো। মানুষের মরে যাওয়ার স্মৃতিগুলো।
আবার পশ্চিমবঙ্গে গো-হারা হেরে যাওয়ার দুঃখ বিজেপি ভোলেনি। মোদীও না। তাই রাজ্যপাল জগদীপ ধনখোরের ঘাড়ে চেপে, কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান ব্যুরো (সিবিআই) কে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে খুবই চালাকি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কে তাঁতিয়ে তোলা হচ্ছে যাতে তিনি নিজেই লকডাউন ভেঙে নিজের সমর্থকদের নিয়ে ধর্না দেন আর ভাঙচুর করেন। এর ফলে ধনখোর সুযোগ পাবে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো গল্পের সাথে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের কারণে যে রাজ্যে সাংবিধানিক এক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে সেই অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার ওকালতি করার। ফলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতন করে, পিছনের দরজা দিয়ে বিজেপি কেল্লা দখল করতে চাইছে। কিন্তু এখন কেন?
ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে সে কথা কিন্তু এখন গোটা বিশ্ব জানে। ফলে নানা ভাবে মোদী কে আক্রান্ত হতে হচ্ছে দুইটি বিষয়ে, এক হল গত এক বছর ধরে সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের খাতে কোন খরচ করেনি আর দুই হল মোদী কী ভাবে জনগণ কে বোকা বানিয়ে নিজের নামে গরিবদের জন্যে দান করা অর্থের——পিএম ফান্ডে প্রাপ্য——থেকে কোন জনকল্যাণ না করে আত্মস্মাৎ করে ফেলেছেন। এর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির প্রসঙ্গ তুলে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কে উত্তেজিত করে কেন্দ্রের সাথে সংঘাতে রাস্তায় নামিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার পরিকল্পনাও কিন্তু এই ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, মানুষের শবদেহ গঙ্গায় ভাসা আর অক্সিজেনের অভাবে রুগীর মৃত্যুর ঘটনার থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখবে। কী নিদারুন প্রচেষ্টা! যদি এর এক সিকি ভাগও জনতার স্বাস্থ্য ও রোজগারের জন্যে করা হত!
বলা হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে আর তাতে নাকি শিশুরা বড় বেশি আক্রান্ত হবে। অবশ্যই যদি হতভাগ্য মানুষ তাঁদের শিশুদেরও বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে দেখেন তাহলেও তাঁরা কোনদিনই মোদী আর বিজেপি কে উচ্ছেদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। বরং ইষ্টদেবতার ইচ্ছা ভেবে ভুলে যাবেন। আবার স্বমহিমায় মোদী বন্দনা শুরু হবে। তারপরে অপরীক্ষিত সমস্ত টিকা লাগিয়ে মানুষ ভাববেন তাঁরা এই যাত্রা বেঁচে গেলেন কিন্তু দেখা গেল হঠাৎ ২০২২ সালে আসা চতুর্থ ঢেউ এর ধাক্কায় সব প্রতিষেধকের বাঁধ ভেঙে গেল কারণ ভাইরাস তখন নতুন রূপে বিবর্তিত হয়ে এসে আরও বেশি মানুষ কে আক্রমণ করবে আর সেই ভেঙে পড়া, কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকবে খিল্লির পাত্র হতে বা মানুষের সরল মন নিয়ে খিল্লি করতে। তবুও মোদীর টিকে থাকার রাস্তা বের হয়ে যাবে ঠিকই। টিকা কাজ করুক বা না করুক।
এহেন সমাজে, যখন নদী পথে হাজারো শবদেহ ভেসে যায়, শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খায় মাটিতে পোঁতা দেহ, তখন মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদী সন্ত্রাসী আক্রমণে শয়ে শয়ে ফিলিস্তিনি কে মরতে দেখে অদ্ভুত ধরণের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন মোদী-র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ভক্তরা। যত বেশি ফিলিস্তিনি শিশু, বৃদ্ধ, মহিলাদের লাশ তাঁরা দেখে তত বেশি তাঁরা উল্লসিত হয়। ভুলে যায় অক্সিজেনের অভাবে, ওষুধের অভাবে, ন্যূনতম চিকিৎসার অভাবে তাঁদের স্বজনদের বেদনাদায়ক মৃত্যু। স্বজনের মৃত্যু কে মুসলিম মৃত্যু দেখার আনন্দে তাঁরা ভুলতে বসেন। আর তাঁদের সম্রাট জানলার ধারে বসে হ্যামিলটনের বাঁশি ওয়ালার মতন বাঁশি বাজান মনের আনন্দে নিজের নতুন প্রাসাদ গড়ে উঠতে দেখে।
তাই এই দেশেই বিপ্লব চাই। তাই এই দেশেই পরিবর্তনের জন্যে জন জাগরণ চাই। কারণ যেখানে সব ঠিক আছে, যেখানে মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে, সেখানে পরিবর্তনের কী প্রয়োজন? কিন্তু যেখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মানুষ ছটপট করতে করতে মারা যাচ্ছে, সেই খানে দরকার পরিবর্তন আজ জরুরী। আর তাই যে দেশের মসনদে বসা জনতার ভোটে জিতে আসা শাসক নিজেকে সম্রাট ভাবে। শুধু ভাবে স্বমহিমায় সে সকল সমালোচনা কে ভস্ম করে দেবে, যে মানুষের মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেই নিজের প্রাসাদ বানানো নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে, সেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসক কে সিংহাসন থেকে টেনে নামানো গণতন্ত্রের পক্ষে ন্যায় করা আর তা করতে হবেই আজ কারণ না হলে প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়বে মৃত্যু। আর এই মৃত্যুর থেকে বাঁচতেই আজ দরকার পরিবর্তন।