হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের খিচুড়িতে ডাল কম পড়লে আসে ‘রাম মন্দির’ আর চাল কমে গেলে আসবে পাকিস্তান, চীন ও কাশ্মীরি পন্ডিত। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, সবারই রাজনীতির ধারালো হাতিয়ার হলো এই ‘কাশ্মীর’। ভারতের মূল ধারার রাজনীতিতে যখনই শাসকেরা বেকায়দায় পড়েছে, তখনই কাশ্মীরকে আড়াই প্যাঁচে ব্যবহার করেছে একবার করে। এটা শাসকের পুরানো নীতি। আর বর্তমানে বাজার তোলপাড় করা ‘কাশ্মীর ফাইলস’ নামক সিনেমাটিও সেই পুরানো বোতলেই পুরানো মদ পরিবেশনেরই একটি প্রচেষ্টা।
ঠিক ৩১ বছর আগে ঘটে যাওয়া কুনান পোশপোরা গণধর্ষণের ১৮ দিন বাদে মুক্তি পেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) পোষ্য বিবেক অগ্নিহোত্রি’র ‘কাশ্মীর ফাইলস’ (Kashmir Files) সিনেমাটি। আরএসএস-এর পরিচালকের বর্তমানে হঠাৎ “কাশ্মীরি পন্ডিতদের দেশত্যাগ” নিয়ে সিনেমা বানানো কি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়? নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য? দেশের এই রকম ভরাডুবি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ‘ভারতীয় ফাইলস’ না বের করে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি বের করার মূল উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
তবে কি পরিচালক বাবু ভারতের বদলে কাশ্মীর নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে জট পাকানো হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের খিচুড়ি ও ভারতের আসল সমস্যা গোপন করার মারপ্যাঁচ কৌশল? যা দেখে মোদী অগ্নিহোত্রির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, সাথে সাথে কিছু আরএসএস পণ্ডিতরা পাঁচ বার কোমরও দোলালেন! যাদের স্বভাব, হাবভাব ও কথা বলার ধরণ বলে দিচ্ছিল সিনেমাটি তাঁদের উদ্দেশ্য সাধন করার জন্যে ভাল হওয়ার সাথে সাথেই ভাল হয়েছিল সেই সময়ের বাস্তবিক চিত্রে কাশ্মীর ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিও। একজন স্বয়ংসেবক তো হিন্দি মশলা টেলিভিশনে বলেই ফেললেন, “মোদীজি হ্যায় ইসলিয়ে হি সাব মুমকিন হ্যায়”।
পুলওয়ামা ও পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে গল্প ফেঁদে, ইসলামবিদ্বেষী উগ্রজাতীয়তাবাদী সামাজিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার ক্ষমতায় আসে ৪৪.৯% ভোট নিয়ে। যার মধ্যে বিজেপির ঝুলিতে যায় ৩৭.৪% ভোট। লোকসভা ভোটের পরে লোকনীতি-সিএসডিএস-এর নির্বাচন-পরবর্তী সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী বিজেপির ৩৭.৪% ভোটের মধ্যে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের রাজনীতির কারণে বিজেপি পায় ৫০%, মানে বাকি ১৮.৭% ভোট বিজেপিকে মানুষ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে দেননি। তাহলে কেন তাঁরা বিজেপি কে ভোট দিয়েছিলেন?
সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ বাদে বিজেপি ভোট পেয়েছিল সমাজ-কল্যাণ মূলক প্রকল্পগুলোর কারণে ও অঞ্চল-ভিত্তিক রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে। তার মানে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মোদী আর বিজেপি এত কিছু করেও দেশের মোট ভোটের ৮১.৩% হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের রাজনীতির কারণে পায়নি, এটা তথ্যের ফলেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অযোধ্যায় রাম মন্দির, কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান (৩৭০ ধারা তুলে), তীব্র ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অবাধ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে পেরে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পায় মোট ৩৮.১% ভোট। যার মধ্যে বেশির ভাগটা তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই ছিল। সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে ৪% ভোট পায় বিজেপি, বামেরা উঠে আসে ১০% ভোট পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধীর স্থানে (কেন বিজেপির এমন ভরাডুবি তা নিয়ে অন্য আলোচনা করা যাবে)। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের টোপ মানুষ গেলেননি।
সদ্য সমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের গড় উত্তর প্রদেশে বিজেপি ৫৮.২% মানুষের ভোট না পেয়েও দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। লক্ষণীয় হল বিজেপি বিরোধী ভোট উত্তর প্রদেশে ২০১৭ সালের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। পাঞ্জাবের মানুষ বিজেপিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তা ছাড়াও ভারতের সমস্ত জায়গায় আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের ও দেশি-বিদেশী কর্পোরেটদের দালালির রাজনীতির বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম-শিখ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তা আগলে সবসময় দাঁড়িয়েছে, যার উদাহরণ ২০১৯ সালের শাহীনবাগ আন্দোলন থেকে ২০২০-২১ সালের দিল্লীর কৃষক আন্দোলন।
তবে কি আরএসএস-বিজেপি সামগ্রিক ভাবে বুঝতে পারছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা হিন্দুত্বের মোহে বোকা হওয়া ছেড়ে দিচ্ছে? হিন্দুরা বেশি চালাক হয়ে উঠছে? এইভাবে চললে “হিন্দু খাতরে মে হ্যায়” স্লোগান বদলে মোদী সাহেবদের “বিজেপি খাতরে মে হ্যায়” স্লোগান দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি! এই মরশুমে হঠাৎ “কাশ্মীর ফাইলস” মুক্তি পাওয়া কী ইঙ্গিত করে?
প্রসঙ্গত, কাশ্মীরের আত্ম মর্যাদা সংক্রান্ত দুইটি ধারা——৩৭০ ও ৩৫এ——মোদী সরকার বিলোপ করার আগে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আলোচনা হয় কাশ্মীরের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে। সেই আলোচনায় ট্রাম্প খানকে বলেন “কাশ্মীর প্রসঙ্গ ভীষণই স্পর্শ কাতর, আপনি যদি বলেন তাহলে আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে দেখতে পারি”।
কাশ্মীরের সমস্যার মূল বিষয় ছিল এককালে গণভোট করানো। মুসলিম প্রধান কাশ্মীরে হিন্দু রাজতন্ত্রের শাসন কালে ভূস্বামী হয়ে রাজত্ব করে কাশ্মীরের উচ্চ জাতির পণ্ডিতেরা। এমন কী সকল ধরণের সরকারি চাকরি ও ব্যবসায় তাঁদেরই রমরমা ছিল। হতদরিদ্র কাশ্মীরের মুসলিমেরা অবিভক্ত বাংলার মুসলিমদের মতনই বেশির ভাগই ছিলেন হয় ভূমিহীন কৃষক আর না হয় হস্ত শিল্পের কারিগর। সেই বন্দিদশার থেকে তাঁদের মুক্তি হয়েছিল যখন মুসলিম ফ্রন্ট থেকে বামপন্থায় দীক্ষিত হয়ে কাশ্মীরের তৎকালীন “শের” বলে আখ্যা পাওয়া ও জওহরলাল নেহরুর এক কালের বন্ধু শেখ আব্দুল্লাহ জাতীয় ফ্রন্ট (ন্যাশনাল ফ্রন্ট) গঠন করে ভারতের সাহায্যে ক্ষমতায় আসীন হয়ে একটি ব্যাপক ভূমি সংস্কার কর্মসূচী চালান। এর ফলেই আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে কাশ্মীরের মুসলিম কৃষকেরা গত শতকের ছয়-সাতের দশক থেকে নিজেদের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে সক্ষম হন ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে সামাজিক ও আর্থিক ভাবে প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খা কে চিরকালই দিল্লী দমন করে রাখে। গণভোটের খুড়োর কল যখন কাজ করা বন্ধ করে তখন একদিকে শেখ কে বন্দি করা হয়, কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদ লোপ করে দেওয়া হয় ও ভারতের কাশ্মীরের দৈনিক রাজনীতিতে ব্যাপক হস্তক্ষেপ বাড়ে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষ থেকে একটি বামপন্থী সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত কাশ্মীরে। তার নেতৃত্বে ছিলেন মাকবুল ভাট। আটের দশকে যখন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার তাঁকে ফাঁসি দেয় দিল্লীতে, কাশ্মীরের মানুষের আবেদনে সারা না দিয়ে, তার পরেই সশস্ত্র লড়াইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন কাশ্মীরের যুবরা। তাঁদের সামনে শান্তিপূর্ণ রাজনীতির দরজা কিন্তু দিল্লী বন্ধ করে দেয় সেই ১৯৭১ সাল থেকে।
১৯৭১ সালে পুনরায় ‘গণভোট ফ্রন্ট’ কে আবার নতুন করে ভারতের মূল ধারার রাজনীতিতে ‘ভোটে’ প্রবেশ করানোর প্রস্তাব দেন শেখ। অনেক কায়দা করে রাজনৈতিক মুনাফা করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গান্ধী আটকে দেন ‘গণভোট ফ্রন্টের’ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ। ১৯৭৩-এ জামাত-এ-ইসলামিকে প্রধান বিরোধী (পাঁচটি আসন দিয়ে) বানিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে জম্মু ও কাশ্মীরে। পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীতে পুরো ঘটনাটি স্বীকার করেন সেই সময়কার কংগ্রেসের কাশ্মীরি মুখ্যমন্ত্রী মীর কাসেম।
মূলত ছিন্নভিন্ন, সংগঠন-বিহীন জামাত-এ-ইসলামি কে বিরোধী বানানোর পিছনে সেই সময়ে কংগ্রেসের উদ্দেশ্যটা কী ছিল? তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরি মুসলিম ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মধ্যে অনৈক্য তৈরি করা। সেই থেকে কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন শুরু করে ভারত সরকার, যার মাথায় তখন শ্রীমতি গান্ধী ও তাঁর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। যা পুরোপুরি কাশ্মীরের রাজনৈতিক ময়দানে শক্ত পোক্ত হয় কাশ্মীরি পন্ডিত রাজ্যপাল বিকে নেহরু কে সরিয়ে গান্ধীর কাছের লোক, কুখ্যাত আরএসএস নেতা জগমোহন মালব্যকে ১৯৮৩ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল বানানোর মধ্যে দিয়ে।
১৯৮৩ এর ভোটে শ্রীমতি গান্ধী প্রচার করেন দেশ জুড়ে, “মুসলিম ও শিখ বিচ্ছিনতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর ভার হিন্দুদের কাঁধে তুলে নিতে হবে এবার”। কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় ১৯৮৬ সালের দাঙ্গার বিষয়ে একটি মানবাধিকার টিম রিপোর্ট করতে যায়। সেই তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী এই দাঙ্গার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মুসলিমরা হিন্দুদের মন্দির পুনরায় বানিয়ে দিতে চায় এবং সেই রিপোর্টে টিমটি আরো জানায় যে এই দাঙ্গার কাজ তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের পরিকল্পনা মাফিক করা হয়। এই দাঙ্গার পর তৎকালীন রাজ্যপাল, বিজেপির নেতা মালব্য, বেছে বেছে কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করা শুরু করে। মুসলিমদের ইসলামী পরিচয় রাজনীতিতে ইন্ধন দিতে, তাঁদের ইসলামী সত্তা জাগিয়ে তুলে, তাঁদের হিন্দুদের উপর ক্ষেপিয়ে তুলতে জগমোহন মুসলিমদের অধিকার ও সরকারি ক্ষমতা খর্ব করে এক এক করে।
এই দিকে ইয়াসিন মালিক সহ আরো চারজন ১৯৮৭-তে কাশ্মীর কে ধর্ম নিরপেক্ষ মুক্তি সংগ্রামী ভাটের তৈরী জন্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) পথে ‘মুক্ত’ করবার ডাক দেন পুনরায়। তাঁদের ডাকে সারা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরো হাজারো-হাজারো কাশ্মীরি। কাশ্মীর পুনরুজীবিত হয় সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাতেই। ১৯৮৯ সালে জেকেএলএফ বিজেপির দাঙ্গাবাজ নেতা টিকে টাপলু এবং মাকবুল ভাটের ‘হত্যাকারী’ বলে অভিযুক্ত প্রাক্তন বিচারপতি নীলকান্ত গুঞ্জকে হত্যা করে। সেইসময় থেকেই কাশ্মীরের মানুষের উপরে আরো বেশি পরিমানে দমন-পীড়ন শুরু করা হয়। আর তার সাথেই, জেকেএলএফ-এর থেকে স্বতন্ত্র, ইসলামী জঙ্গী হিজবুল মুজাহিদীন সহ নানা গোষ্ঠী কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে নিজেদের জায়গা করা শুরু করে।
কাশ্মীরে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় বার রাজ্যপাল হয়ে ফিরে কুখ্যাত জগমোহন সেখানকার হিন্দু পন্ডিতদের জঙ্গীদের ভয় দেখিয়ে ও মুসলিমদের থেকে সুরক্ষা না দিতে পারার কারণ দেখিয়ে উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য করে এবং প্রশাসনের সমস্ত কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে সামরিক অভিযানের ডাক দেয় কাশ্মীরে। সেই সময় কাশ্মীর ছেড়ে যাওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংখ্যা নিয়ে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার মতন একটি নোংরা হিংসাত্মক রাজনীতি শুরু করে।
এইসব কিছুর মাঝে, কাশ্মীরে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল অবধি ভারত সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী মারা যায় পাঁচ লক্ষের বেশি কাশ্মীরি, যাঁদের বেশির ভাগই নিরীহ কাশ্মীরি মুসলমান। সন্ত্রাস দমনের নামে সেনা বাহিনীর নিরীহ মানুষের গণহত্যা করার ও তাঁদের উপর দমন পীড়ন করার নানা অভিযোগ নানা সময়েই উঠেছে। কয়েক বছর আগে করা একটি তথ্যের অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত প্রশ্নের উত্তরে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ জানিয়েছিল যে মোট ৮৯ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত ১৯৮৯-৯০ থেকে কাশ্মীরে খুন হয়েছেন। তবুও জগমোহন থেকে বর্তমান বিজেপির নেতারা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গণহত্যা নিয়ে একটি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত মুসলিমদের উপর হওয়া অত্যাচারের পক্ষে ওকালতি করতে।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলির হিসাবে কাশ্মীরের বর্তমানে হিন্দু পণ্ডিতদের সংখ্যা প্রায় তিন থেকে চার হাজার। সেই সংবাদ মাধ্যমেই দেখা গেছিল অনেক হিন্দু পণ্ডিতদের ২০১৬ সালে হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গী নেতা বুরহান ওয়ানির জানাজায়, যাদের হাতে পোস্টার ও মুখে স্লোগান ছিল “ফ্রি কাশ্মীর” কিংবা “গো ব্যাক ইন্ডিয়ান আর্মি”।
হিন্দি মিডিয়ার সূত্র অনুযায়ী, অগ্নিহোত্রির ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। সেই নিয়ে আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রাজ্যে ব্যাপক মিটিং ও প্রচারও করা হয় নভেম্বরের শেষ থেকে। তারপরই সিনেমার মুক্তির দিন পিছিয়ে যায় ভারতে, অবশেষে ঠিক হয় সিনেমাটি বেরোবে ২০২২ সালে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। ইতিমধ্যেই আমেরিকার বেশ কিছু নামকরা মূলস্রোতের দক্ষিণপন্থী পত্রিকা “কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিত জেনোসাইড” সম্বন্ধে খবরও বার করেছে মুসলিম ‘জঙ্গি’ সংগঠন গুলির বিরুদ্ধে, এবং জানিয়েছে কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের বিচার পাওয়া জরুরী।
কাশ্মীরের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ধরে ২০১৩ সালের ৩১শে আগষ্ট ইকোনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় লেখিকা সাদাফ মুন্সী লিখেছিলে, “নিঃসন্দেহে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশান্তরে যাওয়া কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংস্কৃতির এবং কাশ্মীরিত্বের অত্যন্ত শক্তিশালী চেতনার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত।… দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমান সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জন্মেছে যা ১৯৯০-এর আগে সম্প্রীতির সমাজে ছিল না।”
কাশ্মীরে হিজবুল নেতা ওয়ানি থেকে জেকেএলএফ নেতা মালিক, কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের কাশ্মীরে পুনরায় বসবাস শুরু করা এবং সমস্ত নিরাপত্তা-সুরক্ষা দেওয়া নিয়ে বারবার আশ্বস্ত করার পরেও “হিন্দু-মুসলমান সবার এই কাশ্মীর”- স্লোগানের পরেও, ভারতে বসবাসকারী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীরে ফিরে না যাওয়ার আসল কারণটি কী হতে পারে?
২০১৬ সালে নেতা ওয়ানীকে হত্যা, ২০১৯ সালে নেতা মালিক কে ভারতীয় জেলে বন্দি করে জেকেএলএফ নিষিদ্ধ করে, কাশ্মীরকে জঙ্গী মুক্ত করার নামে ৩৭০ ও ৩৫এ বিশেষ ধারা দুইটি বিলোপ, কাশ্মীরের সমস্ত নেতাদের গৃহ বন্দী করে, ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে, কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি কে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী “দেশপ্রেম” দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করার পরে আজ যখন ২০২২ সালে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি বের হয়েছে তখন তো এটি একটি সিনেমা থাকে না, হয়ে ওঠে রাজনীতি প্রচারের এক মিডিয়াম।
মোদী বলেছেন দেশের “প্রত্যেক হিন্দুর” এই সিনেমা দেখা উচিত। কিন্তু তাঁকে জনগণের, বিশেষ করে আপামর শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি হিন্দুদের প্রশ্ন করা উচিত যে্ন এই সিনেমা সব হিন্দুরা দেখবে কী করে বর্তমানে দেশের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে? সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্য অনুযায়ী ভারতে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭.২%। তাদের তথ্যে আরও বলা হচ্ছে এই বছরে বেকারের সংখ্যা আরো বাড়বে, তার মধ্যেই সরকার মধ্যবিত্তের প্রভিডেন্ট ফান্ডেও থাবা মেরেছে মোদী সরকার।
সুতরাং মানুষের হাতে কাজ না থাকার দরুন পকেটে টাকাও নেই। তার সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধির ফলে, দৈনন্দিন খাওয়া-পরার সমস্যায় দেশের ৮৫% মানুষ জর্জরিত। মানুষ পেট না ভরিয়ে অগ্নিহোত্রির ‘কাশ্মীর ফাইলস’ দেখবে কী করে? নাকি সাহেবের এই ইস্যুকে ধরে দেশ জুড়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে? বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মুখ থুবড়ে পড়ার কারণে এখন কোনো না কোনো ফন্দি দরকার জনগণ কে তাঁতিয়ে মূল ইস্যুগুলোর থেকে তাঁদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের আবহের আমেজে, কর্পোরেটদের লুঠের রাজত্ব চালাবার ব্যবস্থা করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে, দেশের ভেতরে হিন্দুদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার শখ আবার সাহেবের মনে জেগেছে। তবে কি সাহেব ও তাঁর সাগরেদরা দেশের হিন্দুদের বেশি চালাক হয়ে যাওয়া ও হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের খিচুড়ি কম খাওয়া নিয়ে খুবই আতঙ্ক গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন?
গ্যাঁটের টাকা খরচ করে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ দেখার আগে দেশের হিন্দুদের, ও সমস্ত জনগণকেই আজ এই প্রশ্নগুলো করতে হবে “নির্বাচিত” সরকার কে আর তার প্রধান, সাহেব কে।